![অভিজ্ঞতা ছাড়াই আওয়ামী লেজুরবৃত্তিতে সক্রিয় সড়কের প্রধান প্রকৌশলী সৈয়দ মঈনুল হাসান অভিজ্ঞতা ছাড়াই আওয়ামী লেজুরবৃত্তিতে সক্রিয় সড়কের প্রধান প্রকৌশলী সৈয়দ মঈনুল হাসান](https://www.dailymessenger.net/media/imgAll/2024February/08-2502111253.jpg)
ছবি : মেসেঞ্জার
৫ আগস্ট আওয়ামী লীগ সরকারের পতন হলেও বহাল তবিয়তে রয়েছেন আওয়ামী সরকারের পদায়নকৃত সড়কের প্রধান প্রকৌশলী সৈয়দ মঈনুল হাসান। সরকারের প্রায় সব দপ্তরে সংস্কার কাজ চললেও সড়কে চলছে সংস্কারের নামে লোক দেখানো পদায়ন ও আওয়ামী পুনর্বাসন। অথচ সড়ক ও জনপথ অধিদপ্তরের অধীনে বাস্তবায়িত উন্নয়ন প্রকল্পের নির্মাণ কাজে সর্বনিম্ন ২৯ হাজার ২৩০ কোটি থেকে সর্বোচ্চ ৫০ হাজার ৮৩৫ কোটি টাকার দুর্নীতি হয়েছে বলে গত বছরের ৯ অক্টোবর এক প্রতিবেদনে জানিয়েছে ট্রান্সপারেন্সি ইন্টারন্যাশনাল বাংলাদেশ (টিআইবি)।
এছাড়াও সওজের উন্নয়ন প্রকল্পের নির্মাণ কাজে সার্বিক দুর্নীতির হার ২৩-৪০ শতাংশ বলেও জানিয়েছে সংস্থাটি। টিআইবি’র এমন প্রতিবেদনের পরেও সড়ক প্রধানের পদে বহাল তবিয়তে থাকাটা ইতোমধ্যেই ব্যাপক চাঞ্চল্যের সৃষ্টি করেছে। প্রশ্ন উঠেছে তার ক্ষমতার উৎস নিয়ে।
সড়ক ও জনপথ অধিদপ্তরের প্রধান প্রকৌশলী মঈনুল হাসান শুধু বহাল তবিয়তেই নেই। বরং অভিযোগ রয়েছে তিনি সরাসরি নের্তৃত্ব দিচ্ছেন এই আওয়ামী পুনর্বাসনে। উল্টো আওয়ামীপন্থীদের পুরস্কারস্বরুপ পদায়ন-পুনর্বাসনকে নতুন সরকারের উপদেষ্টা-সচিবের চোখে ধুলো দিয়ে চালিয়ে দিচ্ছেন সংস্কার বলে। তিনি আওয়ামী আশির্বাদপুষ্ট ‘কাদের চক্র’ সিন্ডিকেটের হোতা সড়কের প্রধান প্রকৌশলী।
সৈয়দ মঈনুল হাসান ১৯৯৬ এ লীগ সরকারের সময় ১৮ তম বিসিএসে নিয়োগ পান। পরবর্তীতে ২৫ জানুয়ারি ১৯৯৯ সালে সড়ক ও জনপথ অধিদপ্তরে সহকারী প্রকৌশলী হিসেবে যোগদান করেন। তিনি সেন্ট্রাল বঙ্গবন্ধু প্রকৌশলী পরিষদের চলমান সদস্য। আইইবি ২০২২-২৩ এর নির্বাচনে বঙ্গবন্ধু প্রকৌশলী পরিষদের (সবুর-মঞ্জুর প্যানেল) শেখ হাসিনার মতই বিনাভোটে নির্বাচন করে নির্বাচিত হয়েছিলেন কাউন্সিল মেম্বার (আইইবি মেম্বার নং ১৪৫৫০)। এছাড়া শেখ মুজিবুর রহমানের জন্মশতবার্ষিকী উদযাপনে গঠিত সড়ক কমিটির উপদেষ্ঠা পরিষদের সদস্য হিসাবে দায়িত্ব পালন করেন তিনি।
এরশাদ আমলে বুয়েট ছাত্রলীগ নেতাও ছিলেন সওজের এই প্রধান প্রকৌশলী। স্বপ্রণোদিত হয়ে কর্মকর্তাদের বহর নিয়ে বারবার মুজিবের মাজারে পুষ্পস্তবক অর্পণ করে ব্যাপক সমালোচনার স্বীকার হোন। অভিযোগ রয়েছে সরাসরি ওবায়দুল কাদেরের চাটুকারিতা ও কারণে-অকারণে শেখ মজিবের বিভিন্ন প্রতিকৃতিতে ভক্তি অর্পন করেই তিনি সড়কের প্রধান প্রকৌশলী।
অভিযোগ রয়েছে, তার পরিবারের অধিকাংশ সদস্য আওয়ামী লীগের রাজনীতির সঙ্গে জড়িত। মঈনুল হাসানের ভাই শামসুল আলম কচি মল্লিকপুর ইউনিয়ন আওয়ামী লীগের সভাপতি এবং নড়াইল জেলা পরিষদের সদস্য। সাধারণ ব্যাংক কর্মকর্তা হিসাবে কর্মজীবন শেষ করলেও জেলা পরিষদ নির্বাচনে প্রতিটি ভোট দেড় থেকে দুই লাখ টাকায় কিনে ব্যাপক সমালোচনার জন্ম দেন তিনি।
মঈনুল হাসানের ভাগ্নে সহকারী প্রকৌশলী সৈয়দ মুনতাসির হাফিজ সড়ক ডিপ্লোমা প্রকৌশলী সমিতির আওয়ামী প্যানেলের দু’বারের নির্বাচিত সভাপতি। এর আগেও ছিলেন একই সমিতির পর পর দু’বারের নির্বাচিত সাধারণ সম্পাদক। অভিযোগ রয়েছে সড়ক নিয়ন্ত্রণের জন্যই মঈনুলের বিশেষ হস্তক্ষেপে মুনতাসীরের উত্থান হয়। মধ্যমসারির যে কোনো কর্মকর্তার পদায়ন বা বদলিতে মঈনুলভাগ্নে মুনতাসিরের আর্শিবাদপুষ্ট হতে হতো। বদলি কিংবা পদায়নে আর্থিক লেনদেন এর মূল দায়িত্বে থাকতেন সৈয়দ মুনতাসির। বিরোধী মতাদর্শের মধ্যমসারির কর্মকর্তা-কর্মচারীদের শায়েস্তা করতে মুনতাসিরের ছক অনুযায়ী করা হতো ওএসডি কিংবা শাস্তিমূলক বদলিও। মুনতাসিরের একক দৌরাত্বে ঢাকা সড়কজোন পরিণত হয় ‘মামাভাগ্নে জোন’ সিন্ডিকেটে। অভিযোগ রয়েছে মঈনুল-মুনতাসিরের সরাসরি নের্তৃত্বে সড়ক ডিপ্লোমা সমিতির ব্যানারে চলতো লোক দেখানো দুস্থদের মাঝে খাদ্য ও ত্রাণসামগ্রী বিতরণের নামে দেশব্যাপী শেখ হাসিনা বন্দনা ও প্রচারণা।
অবাক করার মতো তথ্য হচ্ছে, ৫ আগস্টের আগে মহাখালীর সেতু ভবন, ঢাকা সড়ক বিভাগ, দূর্যোগ ব্যবস্থাপনা অধিদপ্তর ও বনানী এলিভেটেড এক্সপ্রেসওয়ের টোল প্লাজাসহ বিভিন্ন স্থাপনায় নাশকতার নেপথ্যের নায়ক ছিল সড়ক ও সেতুমন্ত্রী ওবায়দুল কাদের নিজে। আর তিনি এ কাজে সহযোগিতা নিয়েছেন সড়ক ভবনের ‘কাদের সিন্ডিকেট’ সদস্যদের। ওবায়দুল কাদেরের নির্দেশে তিতুমীর কলেজ ছাত্রলীগ স্থাপনাগুলোতে ব্যাপক ভাংচুর, অগ্নিসংযোগ ও লুটপাট চালায়। অভিযোগ রয়েছে এই নাশকতার পুরো অর্থায়নই করেন মঈনুল হাসান। মহাখালী এলাকাজুড়ে বৈষম্যবিরোধী ছাত্রদের আন্দোলনকে প্রশ্নবিদ্ধ করতে ছাত্রলীগ নাশকতা চালালেও সেতু ভবনের ৫০ মিটার রেডিয়াসের মধ্যে অবস্থিত মঈনুল হাসানের সরকারি বাসভবন ছিলো সম্পূর্ণ সুরক্ষিত। এরকম পালা করেই ছাত্রলীগ-যুবলীগ পাহারা দিতো তার বাসভবন। মহাখালী জলখাবার মোড়ে এ নিয়ে ব্যাপক গুঞ্জন রয়েছে।
সড়ক সূত্রের তথ্যমতে, ট্রেইনিং এর নামে অর্থ পাচারে ৩০ কর্মকর্তাকে পাঠানো হয় বিদেশে। গত ৫ই আগস্টের পর ট্রেনিং ও উচ্চশিক্ষার নামে বিভিন্ন মেয়াদে ৩০ কর্মকর্তার বিদেশ গমনের অনুমোদন ব্যাপক চাঞ্চল্যের সৃষ্টি করেছে। প্রধান প্রকৌশলী সৈয়দ মঈনুলের সরাসরি তত্ত্বাবধানে ৩০ জন আওয়ামী সুবিধাভোগী কর্মকর্তার মাধ্যমেই শেখ পরিবার ও ওবায়দুল কাদেরের বিপুল অবৈধ অর্থ বিদেশে পাচার করা হয়েছে। তাদের অর্থপাচারে সরাসরি যুক্ত ছিলেন সৈয়দ মঈনুল হাসান। এজন্যই সড়কের একজন নিয়মিত সিভিল ইঞ্জিনিয়ার হওয়ার পরেও আওয়ামী বিশেষ মহলের সরাসরি হস্তক্ষেপে তাকে চাকুরিজীবনের অধিকাংশ সময় ডেপুটেশনে বিভিন্ন পদে স্থানান্তর করা হয়। সংযুক্ত করা হয় মিনিস্ট্রি অফ ফরেন অ্যাফেয়ার্স এর ডিরেক্টর পদে।
এরপর তাকে পোস্টিং করা হয় রোমের বাংলাদেশ দূতাবাসের কাউন্সিলর পদে। আওয়ামী সরকারের অর্থপাচার আরো নির্বিগ্ন ও ত্বরান্বিত করতে তার সাথে পরবর্তীতে যুক্ত করা হয় তারই স্ত্রী ফেরদৌসী শাহরিয়ারকে। ফেরদৌসী শাহরিয়ারও ছিলেন বিসিএস পররাষ্ট্র ক্যাডারের কর্মকর্তা। তিনি দীর্ঘদিন ওয়াশিংটন ডিসিতে ডেপুটি চিপ অফ মিশন হিসেবে বাংলাদেশের যুক্তরাষ্ট্র দূতাবাসে কর্মরত ছিলেন। সরকারের বিশেষ নেক নজর ছাড়া আমেরিকার মতো দেশের দূতাবাসে ডেপুটি চিপ অফ মিশন হিসাবে কর্মরত থাকার সুযোগ নেই। তৎকালীন সরকারের সময় তাকে আমেরিকার নানা সভা, সেমিনার ও অনুষ্ঠানে আওয়ামী তথা শেখ হাসিনা বন্দনার বক্তব্য দিতেও দেখা যায়।
গুঞ্জন রয়েছে ওবায়দুল কাদেরের প্রত্যক্ষ তত্ত্বাবধানে সাবেক প্রধানমন্ত্রী পুত্র সজীব ওয়াজেদ জয়ের আমেরিকায় অর্থপাচার করা হতো এই মঈনুলের স্ত্রী ফেরদৌসী শাহরিয়ার ও ওবায়দুল কাদেরের স্ত্রী ইসরাতুন নেছা কাদেরের ভাতিজি কামরুন্নেসা ও ভাস্তি জামাই এজেএম ওবায়দুর রহমান খান শাওনের নেতৃত্বে।
সড়কের নিয়মিত অফিসার না হয়ে ও কর্মজীবনের অধিকাংশ সময় ডেপুটেশনে অন্যত্র কর্মরত থেকে সরাসরি অভিজ্ঞতা ছাড়াই সিরিয়ালের দোহাই দিয়ে সড়ক ও জনপথের মত একটি গুরুত্বপূর্ণ অধিদপ্তরে শুধুমাত্র আওয়ামী আর্শিবাদপুষ্ট হওয়ায় রাতারাতি প্রধান প্রকৌশলী করা হয় সৈয়দ মঈনুল হাসানকে। যা তৎকালীন সময় সড়কের কর্মকর্তা-কর্মচারীদের মাঝে ব্যাপক ক্ষোভ ও চাঞ্চল্যের সৃষ্টি করে।
সড়কের এ আলোচিত প্রধান প্রকৌশলী সৈয়দ মঈনুল হাসানের গ্রামের বাড়ী নড়াইল জেলার লোহাগড়া উপজেলার মল্লিকপুর ইউনিয়নের পাঁচুড়িয়া গ্রামে। সরেজমিনে অনুসন্ধান করে পাওয়া যায় আরো বেশকিছু চাঞ্চল্যকর তথ্য।
নড়াইল জেলা বিএনপি’র সাংগঠনিক সম্পাদক এসএম ফেরদৌস রহমান বলেন, ‘উনি যেহেতু সরকারি দল করেছেন, সরকারি দলের নেতা হিসেবে ওনার সবসময়ই নড়াইল জেলায় দাপট ছিলো। উনি অর্থশালী মানুষ, উনাদের বহুবিধ ব্যবসা আছে। জেলার প্রায় সবাই জানে মঈনের পুরো পরিবার এলাকায় সুদের ব্যবসার সাথে জড়িত। উনার এক চাচাতো ভাই হাইকোর্টে কর্মরত ছিলো, তখন হামলা-মামলা, তদবির, দালালী করে বহু টাকা জোগাড় করেছে। ঢাকার গুলশান-বনানীর মতো অভিজাত এলাকায় তার একাধিক আবাসিক হোটেল ব্যবসা আছে। যেখানে বারসহ মেয়েলী ঘটনা ঘটে।’
তিনি আরও বলেন, ‘ছাত্রজীবনে মঈনুল সাহেব সরাসরি ছাত্রলীগের রাজনীতির সাথে জড়িত ছিলেন। উনি এখন চিফ ইঞ্জিনিয়ার। তিনি প্রচুর অবৈধ অর্থ উপার্জন করেছেন। যা উনি উনার ভাইদের পিছনে বিনিয়োগ করেন। উনার ভাই (কচি) বিগত সময়ে জেলা পরিষদের কাউন্সিলর নির্বাচনে দেড় কোটি টাকা ব্যয় করেও পরাজিত হন। এবার উনি (কচি) উনার নিজের মূখের বক্তব্য অনুযায়ী প্রায় দুই কোটি টাকা ব্যয় করে জয়ী হন। একেকটা ভোট উনি দুই লক্ষ টাকা করে কিনেছেন। উনি (কচি) একজন ব্যাংকার মানুষ ছিলেন। এই পরিমাণ টাকার উৎস কোথায়? এটা আসলেই কঠিন ব্যাপার। উনার ভাই মঈনুল হাসানই মূলত এই অর্থায়ন করেন। প্রতিপক্ষের বিরুদ্ধে হামলা-মামলা সবই উনারা করতো। উনার বিরুদ্ধে পাঁচুড়িয়ার মানুষ ভয়ে কথা বলতে চাইতো না। কথা বললে নাশকতার মামলা হবে এমন ভীতি মানুষের মাঝে কাজ করতো।’
একই ইউনিয়নের (মল্লিকপুর) বিএনপি’র সভাপতি মো. খিজির আহমেদ বলেন, ‘উনার পুরো পরিবার আওয়ামী রাজনীতির সাথে সম্পৃক্ত। পুরো পরিবার আওয়ামী লীগ আমলে নির্যাতনের সাথে জড়িত। এখানে আওয়ামী রাজনীতির মূল অর্থদাতাই সড়কের চিফ ইঞ্জিনিয়ার মঈনুল হাসান। তার ভাই যে জেলা পরিষদ নির্বাচনে জয়ী হয়েছে, সব তো টাকার বিনিময়ে।’
সওজের প্রধান প্রকৌশলী সৈয়দ মঈনুল হাসানের বিরুদ্ধে যুক্তরাষ্ট্রে অর্থপাচার, বাড়ি কেনা, সন্তানদের আমেরিকায় পড়াশোনা করানোসহ রাষ্ট্রদ্রোহের সব অভিযোগের তদন্ত এবং তদন্তের আগে তিনি যেনো যুক্তরাষ্ট্রে পালিয়ে যেতে না পারেন সেই ব্যবস্থা করতে জোর দাবি জানিয়েছেন জুলাই আন্দোলনের ছাত্র জনতার প্রতিনিধিরা।
এ ব্যাপারে অনেক চেষ্টার পর মঈনুল হাসানের মুঠোফোনে যোগাযোগ করা হলে তিনি বলেন, প্রতিপক্ষ আমার ইমেজ নষ্ট করার জন্য এসব মিথ্যা অভিযোগ দিয়েছে। এ অভিযোগ শুধু আপনার বিরৃুদ্ধেই কেন, এমন প্রশ্নের জবাবে তিনি কোনো মন্তব্য করেননি।
মেসেঞ্জার/তুষার