
ছবি : টিডিএম
অবৈধ জাল রেভিনিউ স্ট্যাম্প তৈরি চক্রের মূলহোতা সোহেল কাজীসহ ১০ সদস্যকে আটক করেছে র্যাপিড অ্যাকশন ব্যাটালিয়ন (র্যাব-৪)। এসময় তাদের কাছ থেকে ২২ কোটি টাকার অধিক মূল্যমানের জাল রেভিনিউ স্ট্যাম্প, জাল রেভিনিউ স্ট্যাম্প তৈরির মেশিন ও বিপুল পরিমাণ অন্যান্য সরঞ্জামাদি উদ্ধার করা হয়।
বুধবার (১৪ জুন) বিকেল ৪টায় এক প্রেস বিজ্ঞপ্তির মাধ্যমে এ তথ্য জানান র্যাব-৪, সিপিসি-২ এর কোম্পানি কমান্ডার লেফটেন্যান্ট কমান্ডার রাকিব মাহমুদ খান। এর আগে, মঙ্গলবার রাতে সুনির্দিষ্ট গোয়েন্দা তথ্যের ভিত্তিতে ঢাকার আশুলিয়া ও মানিকগঞ্জের বিভিন্ন এলাকায় অভিযান পরিচালনা করে তাদের আটক করে র্যাব-৪ এর একটি দল।
আটককৃতরা হলেন- মানিকগঞ্জের সদর থানার খালেক কাজীর ছেলে মো. সোহেল কাজী (৩১), একই থানার মৃত চাঁন মিয়ার ছেলে মো. জাহাঙ্গীর আলম ওরফে জাহিদ (৪০), মানিকগঞ্জের ঘিওর থানার সিদ্দিকুর রহমানের ছেলে মো. সোহেল রানা (৩৫), মানিকগঞ্জের দৌলতপুর থানার আবু তালেবের ছেলে মো. সাব্বির হোসেন (২২), মানিকগঞ্জের সদর থানার সোহেল কাজীর স্ত্রী মোছা. সাবিনা ইয়াছমিন (৩০), মানিকগঞ্জের সদর থানার জাহাঙ্গীর আলমের স্ত্রী মোছা. শাহনাজ আক্তার (৩১), মানিকগঞ্জের হরিরামপুর থানার মৃত ইউসুফ আলীর ছেলে মো. কামরুল হাসান (২৬), একই থানার মৃত শেখ জমিরের ছেলে মো. সুমন (২২), মৃত চাঁন মিয়ার ছেলে বিল্টু (১৯) এবং মো. সেন্টু মিয়া (২৫)।
র্যাব জানায়, সাম্প্রতিক সময়ে র্যাব গোয়েন্দা তথ্যের ভিত্তিতে জানতে পারে যে, এক শ্রেণীর প্রতারক চক্র দীর্ঘদিন যাবত আশুলিয়ার বলিভদ্র এলাকায় অবৈধ জাল রেভিনিউ স্ট্যাম্প ও কোর্ট ফি তৈরি করে সাধারণ জনগণের নিকট বিক্রয় করে বিপুল পরিমান অর্থ আত্মসাৎ করার মাধ্যমে প্রতারণামূলকভাবে সরকারকে বিপুল পরিমান রাজস্ব হতে বঞ্চিত করছে। এ প্রেক্ষিতে র্যাব উক্ত প্রতারক চক্রকে আইনের আওতায় নিয়ে আসার লক্ষে গোয়েন্দা নজরদারী বৃদ্ধি করে। এরই ধারাবাহিকতায় মঙ্গলবার রাতে র্যাব সদর দপ্তরের গোয়েন্দা শাখা এবং র্যাব-৪ এর একটি আভিযানিক দল ঢাকার আশুলিয়া ও মানিকগঞ্জের বিভিন্ন এলাকায় অভিযান পরিচালনা করে অবৈধ জাল রেভিনিউ স্ট্যাম্প তৈরী চক্রের মূলহোতা সোহেল কাজীসহ ১০ সদস্যকে আটক করা হয়।
এসময় তাদের কাছ থেকে ৫০০ টাকা মূল্যমানের ৩ লাখ ৮০ হাজার ৮৬০টি স্ট্যাম্প, ২০০ টাকা মূল্যমানের ৬২ হাজার স্ট্যাম্প, ১০০ টাকা মূল্যমানের ৯২ হাজার ২০০টি স্ট্যাম্প, ৫০ টাকা মূল্যমানের ৬০ হাজার ৭৬০টি স্ট্যাম্প, ২০ টাকা মূল্যমানের ৩২ হাজার ২০০টি স্ট্যাম্প, ১০ টাকা মূল্যমানের ৪ লাখ ২১ হাজার ৯০০টি স্ট্যাম্প, ৫ টাকা মূল্যমানের ৯ হাজার স্ট্যাম্প, ৪ টাকা মূল্যমানের ৩৬ হাজার ৯০০টি স্ট্যাম্প, ২ টাকা মূল্যমানের ৫ হাজার ৬০০টি স্ট্যাম্প, ৩টি পারফেক্ট মেশিন ও ২০টি স্ট্যাম্প তৈরীর প্যাটেন্ট উদ্ধার করা হয়। উদ্ধার হওয়া সর্বমোট ১১ লাখ ১ হাজার ৪২০টি নন-জুডিসিয়াল স্ট্যাম্পের মূল্যমান ২২ কোটি ১ লাখ ৪৫ হাজার ৮০০ টাকা। এসময় স্ট্যাম্পের পাশাপাশি নগদ ৩০ হাজার ৭৪৫ টাকা ও বিপুল পরিমান অন্যান্য সরঞ্জামাদি উদ্ধার করা হয়।
র্যাব-৪, সিপিসি-২ এর কোম্পানি কমান্ডার লেফটেন্যান্ট কমান্ডার রাকিব মাহমুদ খান জানান, প্রাথমিক জিজ্ঞাসাবাদে আটক ব্যক্তিরা জালিয়াতির মাধ্যমে ভুয়া জাল রেভিনিউ স্ট্যাম্প ও কোর্ট ফি তৈরীর সাথে তাদের সম্পৃক্ততার বিষয়ে তথ্য প্রদান করে। প্রাথমিক জিজ্ঞাসাবাদে জানা যায়, চক্রটি প্রায় ২ বছর যাবত ঢাকার আশুলিয়ার বলিভদ্র এলাকায় অবৈধ জাল রেভিনিউ স্ট্যাম্প ও কোর্ট ফি তৈরী করে দেশের বিভিন্ন স্থানে সরবরাহ করে বিপুল পরিমান অর্থ হাতিয়ে নেয়। এভাবে তারা প্রতারণার মাধ্যমে সরকারকে বিপুল পরিমাণ রাজস্ব হতে বঞ্চিত করে আসছিলো। চক্রটি মূলত সোহেল কাজীর মাধ্যমে পরিচালিত হত। অবৈধ জাল রেভিনিউ স্ট্যাম্প তৈরি ও বিক্রয়ে অন্যান্যরা সোহেল কাজীর সহযোগি হিসেবে কাজ করত।
আটক সোহেল কাজী পূর্বে বিভিন্ন প্রিন্টিং প্রেসে চাকুরীর সুবাদে সেখান থেকে সে বিভিন্ন রেভিনিউ স্ট্যাম্প তৈরীর কাজ রপ্ত করে। অবৈধ জাল রেভিনিউ স্ট্যাম্প চিহ্নিতকরণ সহজ না হওয়ায় এবং অধিক মুনাফা লাভের আশায় সে নিজ ব্যবস্থাপনায় অবৈধ জাল রেভিনিউ স্ট্যাম্প তৈরি ও বিক্রয়ের পরিকল্পনা করে। আশুলিয়াস্থ 'কনফিডেন্স প্রিন্টিং' প্রেসের মালিক ও অন্যান্য কর্মচারীদের সাথে পরিচয়ের সুত্র ধরে সে উল্লেখিত ছাপা খানায় অবৈধ জাল রেভিনিউ স্ট্যাম্প মূদ্রণের কাজ শুরু করে। 'কনফিডেন্স প্রিন্টিং' প্রেসে তার অবৈধ জাল রেভিনিউ স্ট্যাম্প মূদ্রণের কাজে নিয়োজিত ছিল আটককৃত সাব্বির, সুমন, কামরুল, সেন্টু ও বিল্টু। অবৈধ জাল রেভিনিউ স্ট্যাম্প মূদ্রণের পর পারফেক্ট মেশিনের মাধ্যমে কাটিং ও ছিদ্রকরণ করা হত। পরবর্তীতে আটক জাহাঙ্গীরের মাধ্যমে রাজধানীর উত্তরা, বনানী, গুলশান, সাভার ও টঙ্গীসহ দেশের বিভিন্ন আদালতে কোর্ট ফি ও অবৈধ জাল রেভিনিউ স্ট্যাম্প সরবরাহ করা হত। বিভিন্ন সময় অবৈধ জাল রেভিনিউ স্ট্যাম্প সরবরাহ করার সুবাদে জাহাঙ্গীর এর সাথে জাল রেভিনিউ স্ট্যাম্প তৈরী করতে পারে এমন অনেক ব্যক্তির পরিচয় হয় এবং তারা সহযোগী হিসেবে কাজ শুরু করে। এভাবে তারা ১০-১৫ জনের একটি চক্র গড়ে তুলে। এছাড়াও তার সাথে বিভিন্ন অনুমোদিত ভেন্ডরদের সাথে সু-সম্পর্ক থাকায় সে তাদের নিকট কমমূল্যে অবৈধ জাল রেভিনিউ স্ট্যাম্প ও কোর্ট ফি সরবরাহ করত। ভেন্ডরগণ এ সকল অবৈধ জাল রেভিনিউ স্ট্যাম্প প্রতারণার মাধ্যমে সাধারণ মানুষের নিকট বিক্রি করত।
তিনি আরও জানান, প্রাথমিক পর্যায়ে ১ রীম কাগজের মাধ্যমে অবৈধ জাল রেভিনিউ স্ট্যাম্প তৈরি করতে গড়ে তাদের ৩০-৪০ হাজার টাকা খরচ হত যা আটক সোহেল তৈরি করে জাহিদের নিকট ১ লাখ টাকায় বিক্রি করত। পরবর্তীতে আটক জাহিদ উক্ত অবৈধ জাল রেভিনিউ স্ট্যাম্পগুলো রাজধানীসহ দেশের বিভিন্ন স্থানে আনুমানিক ২ লক্ষ ৫০ হাজার টাকায় বিক্রি করত। এভাবে তারা প্রতি মাসে ৮-১০ রীম কাগজ দিয়ে অবৈধ জাল রেভিনিউ স্ট্যাম্প তৈরি করে রাজধানীসহ দেশের বিভিন্ন অঞ্চলে বিক্রি করে আসছিল।
র্যাব কর্মকর্তা রাকিব মাহমুদ খান আরও জানান, আটক সোহেল কাজী প্রায় ১৬ বছর পূর্বে মানিকগঞ্জ হতে ঢাকায় এসে বিভিন্ন প্রিন্টিং প্রেসে কাজ শুরু করে। তার নেতৃত্বে বিগত প্রায় ২ বছর যাবত চক্রটি অবৈধ জাল রেভিনিউ স্ট্যাম্প ও কোর্ট ফি তৈরি ও বিক্রয়ের কার্যক্রম পরিচালনা করছিল। একপর্যায়ে অবৈধ জাল রেভিনিউ স্ট্যাম্প তৈরীর চাহিদা বেড়ে গেলে সোহেল কাজী সে এই কাজে স্ত্রী সাবিনা ইয়াছমিনসহ স্ত্রীর বড় ভাই সোহেল রানাকেও সম্পৃক্ত করে। তার স্ত্রী সাবিনা ইয়াছমিন বাসা হতে মালামাল ডেলিভারী ও আর্থিক বিষয় দেখাশুনা করত। প্রিন্টিং প্রেসে অবৈধ জাল রেভিনিউ স্ট্যাম্প ও কোর্ট ফি মূদ্রণের পর সোহেল রানার বাসায় পারফেক্ট মেশিনের মাধ্যমে কাটিং ও ছিদ্রকরণসহ পরবর্তী ধাপের কার্যক্রম সম্পন্ন করত। এছাড়াও তার একটি নিজস্ব ট্রাক রয়েছে। উক্ত ট্রাকের মাধ্যমে দেশের বিভিন্ন স্থানে মালামাল পরিবহনের আড়ালে সে বিভিন্ন সময় অবৈধ জাল রেভিনিউ স্ট্যাম্প সরবরাহ করত। আটক সোহেল কাজীর বিরুদ্ধে মানিকগঞ্জ থানায় একটি মামলা রয়েছে এবং উক্ত মামলায় সে কারাভোগ করেছেন।
আটক জাহাঙ্গীর ৫-৬ বছর পূর্বে মানিকগঞ্জ হতে ঢাকায় এসে একটি প্রেসের কারখানায় চাকুরী শুরু করে। ইতোপূর্বে অবৈধ জাল রেভিনিউ স্ট্যাম্প তৈরি ও বিক্রির দায়ে সে একবার কারাভোগ করেছে। পরবর্তীতে জেল থেকে বেরিয়ে এসে সোহেলের সাথে অবৈধ জাল রেভিনিউ স্ট্যাম্প ও কোর্ট ফি তৈরি ও বিক্রয়ের সাথে যুক্ত হয়। অবৈধ জাল রেভিনিউ স্ট্যাম্প তৈরির পর আটক জাহাঙ্গীরের মাধ্যমে তা রাজধানীর বনানী, গুলশান, উত্তরা, টঙ্গী ও সাভারসহ দেশের বিভিন্ন স্থানে তার পরিচিত ভেন্ডরদের নিকট বিক্রি করা হত। তার স্ত্রী আটক শাহনাজ স্বামীর সহযোগি হিসেবে অবৈধ জাল রেভিনিউ স্ট্যাম্প তৈরী, বিক্রয় ও বহনকারী হিসেবে সহযোগিতা করে আসছিল। তারা স্বামী-স্ত্রী উভয়ে উক্ত জালিয়াতির মাধ্যমে মানিকগঞ্জ জেলা সদরে প্রায় অর্ধ কোটি টাকা মূল্যের একটি বাড়ী নির্মাণ করেছে বলে জানা যায়।
আটক সাব্বির বিগত ২-৩ বছর যাবত 'কনফিডেন্স প্রিন্টিং' প্রেসে মূদ্রণ ও বাইন্ডিং এর কাজ করে আসছে। সে বিগত প্রায় ২ বছর পূর্বে আটক সোহেল কাজীর মাধ্যমে এই চক্রের সাথে জড়িত হয়ে অবৈধ জাল রেভিনিউ স্ট্যাম্প তৈরীর কাজ করে আসছিল। আটক কামরুল, সুমন, সেন্টু ও বিল্টু উক্ত প্রিন্টিং প্রেসে কাজ করত। আটককৃতরা অধিক মুনাফা লাভের আশায় সাব্বির এর তত্ত্বাবধানে আটক কামরুল, সুমন, সেন্টু ও বিল্টু উক্ত প্রিন্টিং প্রেসে অবৈধ জাল রেভিনিউ স্ট্যাম্প ও কোর্ট ফি মূদ্রণের কার্যক্রম করে আসছিলো।
এ ঘটনায় আটককৃতদের বিরুদ্ধে আইনানুগ ব্যবস্থা প্রক্রিয়াধীন।
টিডিএম/এএম