ঢাকা,  রোববার
০৮ সেপ্টেম্বর ২০২৪

The Daily Messenger

চার বছরে গাইবান্ধা পৌর এলাকার ৩৫০ বিঘা কৃষি জমি বিপন্ন

তাসলিমুল হাসান সিয়াম, গাইবান্ধা

প্রকাশিত: ১১:৩৮, ১১ জুন ২০২৪

আপডেট: ১৩:১৭, ১১ জুন ২০২৪

চার বছরে গাইবান্ধা পৌর এলাকার ৩৫০ বিঘা কৃষি জমি বিপন্ন

ছবি : মেসেঞ্জার

উন্নত ও আধুনিক জীবনের স্বাদ নিতে ৮০ এর  দশকের মাঝামাঝি সময় থেকে গাইবান্ধা জেলা শহরে শুরু হয় শহরায়ন প্রক্রিয়া। সময়ের সাথে এই প্রক্রিয়া বাড়তে থাকায় বর্তমানে দেখা দিয়েছে নানা সংকট। অপরিকল্পিত ভাবে কৃষি জমি দখল করে ঘর বাড়ি ও রাস্তা নির্মাণ হওয়া গত গত ৩ দশকে শহরায়নের প্রভাবে গাইবান্ধা জেলা শহরের কৃষি জমির পরিমাণ আশঙ্কা জনক ভাবে কমেছে। ফলে একসময়ের বিস্তীর্ণ ফসলের ক্ষেত এখন জনাকীর্ণ আবাসিক এলাকায় পরিণত হয়েছে।

১৯৮৪ সালে মহকুমা থেকে জেলায় রুপান্তরিত হওয়ার পর গাইবান্ধা শহরের গড়ে উঠেছে সরকারি ও বেসরকারি মিলে শতাধিক প্রতিষ্ঠানের দাপ্তরিক কার্যালয়। প্রয়োজনের তাগিদেই ধীরে ধীরে জেলার বিভিন্ন উপজেলার মানুষ কেবল জীবনযাত্রায় আধুনিক সুযোগ-সুবিধার সন্নিবেশ ঘটাতে প্রত্যন্ত গ্রাম অঞ্চল থেকে শহরে জমি কিনে বাড়ি নির্মাণ শুরু করার ফলে কমতে থাকে কৃষি জমির পরিমাণ।

গাইবান্ধা সদর উপজেলা কৃষি সম্প্রসারণ অধিদপ্তরের এক জরিপ সুত্রে জানা যায়, গাইবান্ধা পৌরসভায় ২০২০ সালে মোট কৃষি জমির পরিমাণ ছিল ৪৫০ হেক্টর যা বর্তমানে কমে দাঁড়িয়েছে ৩৫০ হেক্টরে। ঐ জরিপ বিশ্লেষণে দেখা যায় মাত্র চার বছরে ৫০ হেক্টর বা ৩৫০ বিঘা কৃষি জমির উপর বিভিন্ন স্থাপনা নির্মাণ করা হয়েছে ।

শুধু আবাদি জমি নয় গত কয়েক দশকে শহরের পার্শ্ববর্তী এলাকার পুকুর বা খালবিল ভরাট করে ভবন নির্মাণ হওয়ায় ধ্বংস হয়েছে মাছসহ বিভিন্ন জলজ প্রাণীর আবাসস্থল।

জানা যায়, ১০ দশমিক ৫৪ বর্গ কিলোমিটার আয়তনের গাইবান্ধা পৌরসভায় মোট জনসংখ্যা ৫৯২৮৯ জন। জনসংখ্যার ঘনত্ব বিবেচনায় এই সংখ্যা প্রতি বর্গ কিলোমিটারে প্রায় ৫৬০০ জন। দ্রুত শহরায়নের প্রভাবে জনসংখ্যা বৃদ্ধির হার প্রতিনিয়ত বাড়ছে। এই জনসংখ্যার চাপ সামলাতে প্রতি বছর প্রায় শত শত বিঘা কৃষি জমিতে ফসল উৎপাদন স্থায়ী ভাবে বন্ধ হয়ে যাচ্ছে। এতে খাদ্য ঘাটতিসহ এ অঞ্চলের কৃষি বৈচিত্র্য হুমকির মুখে পড়েছে।

সরেজমিনে গাইবান্ধা জেলা শহরের বিভিন্ন স্থান ঘুরে দেখা যায় মুল সড়কের পার্শ্ববর্তী কোন কৃষি জমিতে আর ফসল উৎপাদন হচ্ছে না। প্রায় সব জমিতে গড়ে উঠেছে ঘরবাড়ি। যেসব জমি ফাঁকা আছে সেখানেও ঝুলছে বিক্রির নোটিশ। 

গাইবান্ধা শহরের সুন্দরজাহান মোড় এলাকার অবসরপ্রাপ্ত সরকারি চাকরিজীবী আব্দুর রউফ চৌধুরী বলেন, ১৯৯৫ সালে আমার দুই ছেলে গাইবান্ধা সরকারি বালক উচ্চ বিদ্যালয়ে ভর্তি হয়, তাদের পড়াশোনার জন্য পরিবারসহ গাইবান্ধা শহরে এসে মাত্র ২৫ হাজার টাকায় ৬ শতাংশ জমি কিনে বাড়ি করেছিলাম। তখন এই এলাকায় হাতে গোনা কয়েকটি বাসা ছিল । বর্তমানে এই এলাকায় শতাধিক বাসা রয়েছে যার অধিকাংশই গত পাঁচ-ছয় বছরে তৈরি হয়েছে।

গাইবান্ধা বাস টার্মিনাল এলাকার, বেসরকারি চাকরিজীবী রফিক রহমান বলেন, ৩০ বছর আগে যে জমিতে ফসল উৎপাদন দেখেছি আজ সেখানে পুরো একটা মহল্লা তৈরি হয়েছে।

গাইবান্ধা মাস্টার পাড়ার বাসিন্দা, খুরশিদ আলম বলেন, আমার এলাকায় বাড়ি করার জন্য আর জায়গা খুঁজে পাওয়া যাবে না। শহরে এখন লাখ লাখ টাকা দিয়েও পছন্দের জমি পাওয়া যায় না। শহরে এখন জমির মূল্য এখন স্থান ভেদে প্রতি শতক ৫ থেকে ১০ লাখ টাকা।

এদিকে গাইবান্ধা পৌরসভার ভিতরে কর্তৃপক্ষের বিল্ডিং কোড না মেনেই অনেকে অপরিকল্পিত ভাবে বাসা বাড়ি নির্মাণ হচ্ছে। পৌরসভার ভিতরে ঘর বাড়ি নির্মাণের আগে পৌর কর্তৃপক্ষের  কাছ থেকে সরকার নির্ধারিত ফি পরিশোধ করে প্লান পাস করার নিয়ম থাকলেও বর্তমানে যেসব ঘরবাড়ি নির্মাণ হচ্ছে এদের বেশিরভাগই পৌর কর্তৃপক্ষের অনুমতি না নিয়ে কৃষি জমির উপর গড়ে তুলছে বহুতল ভবন।

গাইবান্ধা পৌরসভার অ্যাসেসমেন্ট শাখা সুত্রে জানা যায়, ৯ টি ওয়ার্ডে মোট ১৫ হাজার ৪ শত ঘরবাড়ি রয়েছে ‌এর মধ্যে বেশির ভাগই ঘরবাড়ি নির্মাণের আগে পৌর কর্তৃপক্ষের কাছ থেকে বাড়ি তৈরির প্লান গ্রহণ করেনি ।

গাইবান্ধা পৌরসভার মেয়র মতলুবার রহমান বলেন, মাননীয় প্রধানমন্ত্রী কৃষি জমির সর্বোত্তম ব্যবহার নিশ্চিত করতে বরাবরই নির্দেশনা দিয়ে আসছেন আমরাও এই নীতি অনুসরণে বদ্ধ পরিকর। পৌরসভায় ঘর বাড়ি নির্মাণের বেশ কিছু আইন ও নীতিমালা অনুসরণ করেই ঘর বাড়ি নির্মাণের অনুমোদন দেওয়া হয়। এর বাইরেও পৌরসভা ভেতরে ব্লিডিং কোড না মেনে যেসব স্থাপনা তৈরি হয়েছে সেগুলো ভেঙ্গে ফেলার জন্য আমরা ভবন মালিকদের নোটিশ দিয়েছি।

শহরায়ন প্রক্রিয়ায় চলমান সংকট নিরসনের বিষয়ে জানতে চাইলে, গাইবান্ধা সরকারি কলেজের সমাজ বিজ্ঞানের শিক্ষক অধ্যাপক হারুন উর রশীদ জানান, শহরায়ন প্রক্রিয়া কখনো বন্ধ হয়ে যাবে না এটা চলতেই থাকবে। মানুষ আধুনিক জীবনের আকাঙ্ক্ষা পূরণ করতে গ্রাম থেকে শহরে আসছে। বড় বড় শহর গুলোতে বিল্ডার্স কোম্পানি গুল অল্প জায়গায় বহুতল ভবন নির্মাণ করে ফ্ল্যাট বিক্রি করে এতে একই জায়গায় অনেক পরিবারের আবাসস্থল তৈরি হয় এবং কৃষি জমি ভরাট করে বাড়ি নির্মাণের প্রয়োজন পড়ে না। গাইবান্ধায় এখনো এমন প্রকল্প নেওয়া হয়নি তাই শহরায়নের ক্ষতিকর প্রভাব সরাসরি কৃষি জমির উপর পড়ছে।

গাইবান্ধা কৃষি প্রশিক্ষণ ইনস্টিটিউটের ভারপ্রাপ্ত অধ্যক্ষ মাহাবুবার রহমান বলেন, কৃষি উৎপাদন বৃদ্ধি করার জন্য জমির সর্বোত্তম ব্যবহার নিশ্চিত করা খুবই জরুরি। তিন ফসলি জমির উপর মাটি ফেলে কোন স্থাপনা নির্মাণ করা হলে সেখানে ফসল উৎপাদন সম্ভব হবে না এতে শস্য উৎপাদন কমে যাওয়ার পাশাপাশি দেখা দিতে পারে খাদ্য সংকট।

মেসেঞ্জার/আজিজ/শাহেদ

×
Nagad