ছবি : মেসেঞ্জার
হে দারিদ্র্য, তুমি মোর করেছ মহান। তুমি মোরে দানিয়াছ খ্রীষ্টের সন্মান। কন্টক-মুকুট শোভা। দিয়াছ, তাপস, অসঙ্কোচ প্রকাশের দুরন্ত সাহস, নজরুলের এই দু'টি লাইন বলছে দারিদ্র্যতার কষাঘাতে সন্মানের সাথে আপোষহীন কলম ধরে যুদ্ধ করে বেঁচে থাকা সত্য প্রকাশের দুরন্ত সাহস। যা সাংবাদিকতাকে উজ্জীবিত করে ফুটিয়ে তোলে।
রাষ্ট্রের চতুর্থ স্তম্ভ বলা হয় সাংবাদিকতাকে। তবে সেই সাংবাদিকতায় যখন নীতি-নৈতিকতা, নিয়ম-শৃঙ্খলা না জেনেই পেশা দায়িত্ব কে নেতিবাচক সমালোচনার মুখোমুখি দাঁড় করায় ঠিক তখনই জেগে ওঠে লাল সবুজ সোসাইটি। উদ্যোগ নেয় তরুণদের নিয়ে সংবাদ সাংবাদিকতায় হাতেখড়ি শেখানোর।
রংপুরের ব্র্যাক লানিং সেন্টারে ১০ মে থেকে শুরু করে ১৪ মে পর্যন্ত আবাসিক পাঁচদিনের ইয়ুথ জার্নালিস্ট বুট ক্যাম্পে অংশ নেয় বরিশাল ও রংপুর বিভাগ থেকে সেরা তরুণ সংবাদকর্মীরা।
এর আগে বরিশাল ও রংপুরে পাঁচদিনের একটি ট্রেনিং হয়। যেখানে রংপুর ও বরিশালের বিভিন্ন জেলা থেকে প্রায় ৭০জন অংশগ্রহন করেন। তাদের থেকে সেরাদের বাছাই করে দুই বিভাগ থেকে ২০জন তরুণ সংবাদকর্মীকে নেয়া হয় এই বুট ক্যাম্পে।
যেখানে দেশের বিভিন্ন গণমাধ্যমে কর্মরত সিনিয়র সাংবাদিক, বিশ্ববিদ্যালয়ের গণযোগাযোগ ও সাংবাদিকতা বিভাগের প্রফেসর, মানবাধিকার বিশেষজ্ঞ, রংপুর বিভাগের বিভাগীয় প্রধান ও মাঠ পর্যায়ে কাজ করা সিনিয়র সংবাদকর্মীদের দ্বারা পরিচালিত সেশন গুলোতে হাতে কলমে মাট পর্যায়ে শেখানো হয়েছে নানা বিষয়।
একটি রিপোর্টে শুরু থেকে কি কি জানা প্রয়োজন, ভিডিও, বক্তব্য, বাইট, পিটিসি, পে অফ থেকে শুরু করে রিপোর্টকে মনোমুগ্ধকর তথ্যবহুল গড়ে তুলতে ভূমিকা রাখে। গুরুত্ব দেওয়া হয় ফিচার রিপোর্টের উপর। অবহেলিত, বঞ্চিত ও সামাজিক ভাবে পিছিয়ে পড়া মানুষের উপর। অধিকার আদায়ে তুলে ধরার কৌশল গুলো শেখানো হয় নিখুঁত ভাবে।
'সাংবাদিকতার নতুন দিগন্তে দেখা হবে রংপুরে' এমন স্লোগানকে ধারণ করে এই বুট ক্যাম্পে নির্বাচিত ২০ জন প্রশিক্ষণার্থী অংশগ্রহণ করেন দক্ষিণের উপকূলীয় জেলা ঝালকাঠির নলছিটি, খুলনার বাগেরহাটের শরণখোলা রংপুর, লালমনিরহাট, বরিশাল, দিনাজপুর, ঢাকা, রাঙামাটিসহ বিভিন্ন জেলা থেকে তরুণরা এই ক্যাম্পে অংশগ্রহণ করেন। এর মধ্যে অনেকেই কলেজ, বিশ্ববিদ্যালয়ে অধ্যায়নরত শিক্ষানবিশ সাংবাদিক ও তরুণ সাংবাদিকরা অংশ নেয়।
লাল সবুজ সোসাইটি ও মানুষের জন্য ফাউন্ডেশনের সহযোগিতায় আয়োজিত এই বুট ক্যাম্পে সংবাদকর্মীরা যেন এক টুকরো বাংলাদেশে পরিনত হয়েছে। মূলত তরুনদের উৎসাহিত করতে, সাংবাদিকতা ও গণমাধ্যমের ওপর থেকে সাধারণ মানুষের আস্থা ফিরিয়ে আনতে এই প্রচেষ্টা।
বুট ক্যাম্পের প্রথম দিনে ছিল মানবাধিকার ও শিশু রিপোর্টিং, এতে প্রশিক্ষক ছিলেন উইনিসেফ রংপুর ও রাজশাহীর প্রধান তৌফিক আহমেদ এবং গবেষক ও পলিসি মেকার ফাল্গুনী রেজা। বুট ক্যাম্পের দ্বিতীয় দিনে ব্র্যাক লার্নিং সেন্টারের অডিটোরিয়ামে রংপুরের সিনিয়র সাংবাদিক, সুশীলসমাজের প্রতিনিধি ও বেগম রোকেয়া বিশ্ববিদ্যালয়ের গণযোগাযোগ ও সাংবাদিকতা বিভাগের শিক্ষকদের সঙ্গে প্রশিক্ষণার্থীদের মতবিনিময় সভা হয়।
সভায় অংশ নিয়ে আলোকিত বাংলাদেশ রংপুর প্রধান আবদুর রহমান মিন্টু বলেন, 'সাংবাদিকতা করতে হলে সবার আগে দেশপ্রেম জরুরি। এর পাশাপাশি প্রচুর পড়তে ও জানতে হবে, তাহলেই একজন ভালো সাংবাদিক হতে পারবে। নিউজ সেন্স খুব জরুরি। সাংবাদিকতা করতে হলে এটি থাকা প্রয়োজন, আর প্রতিনিয়ত নতুন কিছু শিখতে হবে।
বুট ক্যাম্পের তৃতীয় দিনটি ছিল খুবই গুরুত্বপূর্ণ। মোবাইল জার্নালিজম (মোজো) আদ্যোপান্ত আলোচনা এবং প্রাক্টিক্যাল দেখিয়েনছেন ড্যাফোডিল ইন্টারন্যাশনাল ইউনিভার্সিটির সাংবাদিকতা ও গন-যোগাযোগ বিভাগের সহযোগী অধ্যাপক ড. জামিল খান। এই সেশন থেকে প্রশিক্ষণার্থীরা শিখেছেন কীভাবে নিজেদের হাতে থাকা মোবাইল দিয়ে সাংবাদিকতা করা যায়।
ক্যাম্পের চতুর্থ দিনে ভার্চুয়ালি যুক্ত ছিলেন যমুনা টেলিভিশনের বিশেষ প্রতিনিধি মহসিন উল হাকিম ও চ্যানেল-২৪-এর ব্রডকাস্ট জার্নালিস্ট আশ্বাস চৌধুরী। ভার্চুয়ালি যুক্ত হয়ে তারা তরুণ সাংবাদিকদের বিভিন্ন প্রশ্নের উত্তর দেন এবং তাদের অভিজ্ঞতার কথা শেয়ার করেন ও দিকনির্দেশনামূলক বক্তব্য দেন।
বিকেলে প্রশিক্ষণার্থীরা চারটি গ্রুপে ভাগ হয়ে যায় এবং নগরীর মানবাধিকার বিষয়ক বিভিন্ন সমস্যা নিয়ে তারা রিপোর্ট তৈরি করেন। সর্বশেষ পঞ্চম দিনে প্রশিক্ষণার্থীরা তাদের রিপোর্ট জমা দেন এবং ফিডব্যাক গ্রহণ করেন। বিকেলে সমাপনী অনুষ্ঠানে উপস্থিত থেকে প্রশিক্ষার্থীদের মাঝে সার্টিফিকেট বিতরণ করেন যমুনা টেলিভিশন রংপুর ব্যুরোপ্রধান সরকার মাজারুল মান্নান এবং সময় টেলিভিশনের রংপুর ব্যুরোপ্রধান নাজমুল ইসলাম নিশাত।
বেগম রোকেয়া বিশ্ববিদ্যালয় থেকে অংশগ্রহণ করা সাদিয়া আক্তার (২২) বলেন, 'এই বুট ক্যাম্পে অংশগ্রহণ করে নতুন অনেক কিছুই শিখতে পেরেছি রিপোর্টিংয়ের বিষয়ে যেটা আগে জানতাম না। রিপোর্ট করার ক্ষেত্রে অনেক কিছুই অজানা ছিল আমাদের। এখন জানতে পেরেছি। সব মিলিয়ে পুরো প্রশিক্ষণটা অনেক শিক্ষণীয় ছিল। সামনের দিনগুলোতে আরো ভালো কিছু করতে পারব ইনশাআল্লাহ।
বরিশাল থেকে প্রশিক্ষণে অংশ নেওয়া রাতুল ইসলাম (২৩) বলেন, 'ট্রেইনারদের কাছ থেকে অনেক গুরুত্বপূর্ণ বিষয় জানতে পেরেছি, মাঠপর্যায়ে কাজ করতে গিয়ে কীভাবে চ্যালেঞ্জগুলো মোকাবিলা করতে হয় এবং রংপুরে ফিল্ড ভিজিটে গিয়ে মাঠপর্যায়ে কাজ করার অভিজ্ঞতা অর্জন করতে পেরেছি। বিভিন্ন জেলার অনেক তরুণ সাংবাদিকের সঙ্গে পরিচিত হতে পেরেছি খুবই ভালো লাগছে।
লালমনিরহাট জেলা থেকে আসা তরুণ সংবাদকর্মী আহসান সাকিব হাসান তিনি বলেন, 'এই প্রশিক্ষণ নতুন মাত্রায় অনুপ্রেরণা জোগায়। পিছিয়ে পড়া মানুষকে নিয়ে বারবার লিখতে এবং সমস্যা আর সম্ভাবনা তুলে ধরতে সাহায্য করবে। সেশন, গানের আড্ডা, মাঠের রিপোর্টি, সবার স্নেহ, ভালোবাসা সবকিছু বারবার ফিরে আসুক। বিশেষ করে পুরো প্রোগ্রাম মিলে বেস্ট পার্টিসিপেন্ট পুরস্কার পেয়েছি। এটি আমার জন্য বড় অনুপ্রেরণা।
লাল সবুজ সোসাইটির প্রতিষ্ঠাতা ও সভাপতি তাহসিন উদ্দিন বলেন, 'তৃণমূলের তরুণদের সাংবাদিকতায় আসা জরুরি। এ ক্ষেত্রে দক্ষতাবৃদ্ধির সুযোগ বা আয়োজন হচ্ছে না। সে কারণেই আমাদের এই ক্যাম্প। এখানে ৫ দিন ইনডোর ও আউটডোর নানা কার্যক্রমের মাধ্যমে আমরা তরুণদের দক্ষ করার চেষ্টা করেছি। সামনে আরও ভালো কিছু করার চেষ্টা অব্যহত থাকবে।
মেসেঞ্জার/আপেল
