ছবি : মেসেঞ্জার
বাংলাদেশ ও ভারতে অবৈধভাবে কিডনি ট্রান্সপ্ল্যান্ট চক্রের সঙ্গে জড়িত থাকার অভিযোগে ভারতীয় পুলিশের হাতে কুষ্টিয়ার ভেড়ামারার যুবক রাসেল গ্রেপ্তার হয়েছেন। সে নিজ এলাকায় ভালো মানুষ ও দানবীর হিসেবে পরিচিত।
বিভিন্ন সময় এলাকার অসহায়দের মাঝে আর্থিক সহায়তার কারণে জনপ্রিয়তা রয়েছে তার। গ্রেপ্তারের খবর শুনে অবাক হচ্ছেন সবাই।
শুক্রবার (১২ জুলাই) বিকালের দিকে ভেড়ামারা উপজেলার স্থানীয় বাসিন্দাদের সঙ্গে কথা বলে এমন তথ্য পাওয়া গেছে। তবে এ বিষয়ে মুখ খোলেননি রাসেলের মা আলেকা বেগম।
গ্রেপ্তার রাসেল কুষ্টিয়ার ভেড়ামারা উপজেলার ধরমপুর ইউনিয়নের চার নম্বর ওয়ার্ডের রামচন্দ্রপুর গ্রামের মৃত আবুল কালামের ছোট ছেলে।
রাসেলের প্রতিবেশী হানিফ আলী বলেন, রাসেল প্রায় ১০ বছর ধরে বাইরে থাকে। আগে ঢাকায় থাকতো, পরে ভারতে থাকতো এবংসেখানকার হাসপাতালে চাকরি করতো বলে শুনেছি।
গত ঈদে রাসেল দুইটা দামি প্রাইভেট গাড়ি নিয়ে বাড়িতে এসেছিল। আগে লোকাল বাসে আসতো। এলাকায় তেমন কোনো সম্পদ নেই। শুনেছি, ঢাকায় নাকি বাড়ি গাড়ি আছে। থাকতেও পারে। কারণ আগে সাধারণভাবে চলাচল করতো। এখন তো ভিআইপি হয়ে গেছে। মনে হয় বড় অফিসার।
তিনি আরও বলেন, সে পরিচয় দিত ভারতের হাসপাতালের বড় অফিসার। কয়েক বছর ধরে তার চলাফেরা ভিআইপিদের মতো। সে এলাকায় ভালো কাজ করতো, গরীবদের দান কিরতেন। তাকে নিয়ে তদন্ত করা উচিৎ।
তদন্ত করলে হয়তো অবৈধভাবে গড়া। সম্পদের খোঁজ পাওয়া যেতেও তো পারে। কারণ সে কিডনি পাচার চক্রের লোক। তাকে ভারতের পুলিশ গ্রেপ্তার করেছে। এলাকায় তার বিরুদ্ধে কোনো অভিযোগ নেই। সে এলাকায় কোনো খারাপ কাজ করেনি। ভদ্র ও ভালো মানুষের মতো চলাফেরা করতো।
স্থানীয় সাহেব আলী নামের এক বৃদ্ধা বলেন, রাসেল গ্রামেই বেড়ে উঠেছে। এলাকায় পড়াশোনা করত। এসএসসি পরীক্ষার পর ২০১৩ সালে ঢাকায় তার বড় ভাইয়ের কাছে চলে যায়। তার কয়েকবছর পরে ভারতে চলে যায়।
সেখানে একটা হাসপাতালে চাকরি করতো। এমনটাই আমরা জানতাম। আগে জানতাম ভারতের হাসপাতালের বড় অফিসার, এখন দেখি কিডনি পাচারকারী। ভারতের পুলিশ তাকে গ্রেপ্তার করেছে। এলাকায় আসলে দামি গাড়ি নিয়ে আসতেন।
ঈদে গরিবদের শাড়ি, লুঙ্গিসহ নগদ টাকা দিতেন। দান খয়রাত করতেন। আগে যাত্রীবাহী বাসে আসতেন। কিন্তু কয়েকবার ধরে দামি প্রাইভেট গাড়ি নিয়ে আসেন। গত ঈদেও প্রাইভেট গাড়ি নিয়ে এসেছিল। ভিআইপিদের মতো চলাফেরা করতেন, পোশাকাশাক পরতেন।
স্থানীয় মরিয়ম খাতুন ও সাবিনা বেগম বলেন, রাসেল এলাকায় আসলে ভালো কাজ করতো, গরীবদের মাঝে দান খয়রাত করতে। আমরা তাকে ভালো মানুষ হিসেবে জানতাম। সে কখনো এলাকায় খারাপ কাজ করেনি। কিন্তু সে কিডনি চক্রের সাথে যুক্ত সেটা কয়েকদিন আগে জানতে পেরেছি। তাকে ভারতের পুলিশ গ্রেপ্তার করেছে। তবে সে এলাকায় কোনো খারাপ কাজ করেনি। খুব ভদ্র মানুষ।
এ বিষয়ে কথা বলার জন্য ধরমপুর ইউনিয়নের চেয়ারম্যান সামসুল হকের মুঠোফোনে একাধিকবার কল করলেও তিনি রিসিভ করেন নি।
স্থানীয় ৪ নম্বর ওয়ার্ডের ইউপি সদস্য জিয়াউর রহমান বলেন, কিডনি পাচারের অভিযোগে রাসেলকে ভারতের পুলিশ গ্রেপ্তার করেছে বলে শুনেছি। এ বিষয়ে আমি কিছুই জানি না। তবে আমার জানা মতে এলাকায় তার বিরুদ্ধে কোনো অভিযোগ নেই। এলাকার মানুষ তাকে ভালো ও ভদ্র মানুষ হিসেবেই জানেন।
এ বিষয়ে কথা বলার জন্য রাসেলের গ্রামের বাড়িতে গিয়ে তার মা আলেকা বেগমকে পাওয়া যায়। সাংবাদিক পরিচয় পাওয়ার পর তিনি কোনো কথা বলতে রাজি হননি।
ভেড়ামারা থানার ভারপ্রাপ্ত কর্মকর্তা (ওসি) জহুরুল ইসলাম বলেন, রাসেলকে ভারতের পুলিশ গ্রেপ্তার করেছে বলে জানতে পেরেছি। এলাকায় তার বিরুদ্ধে কোনো অভিযোগ পায়নি। এলাকার মানুষ তাকে ভালো মানুষ হিসেবে জানে। তার বিরুদ্ধে কোনো অভিযোগ পেলে আইনগত ব্যবস্থা গ্রহণ করা হবে।
প্রসঙ্গত, ভারতের রাজস্থানে একটি কিডনি চক্র ধরা পড়ে। সেখান থেকে তথ্য পায় পুলিশ। এই তথ্যের ভিত্তিতে পুলিশ প্রায় তিন মাস আগে কাজ শুরু করে। বাংলাদেশ ও ভারতে অবৈধভাবে কিডনি ট্রান্সপ্ল্যান্ট চক্রের সঙ্গে জড়িত থাকার অভিযোগে গত সপ্তাহে দিল্লির ইন্দ্রপ্রস্থ অ্যাপোলো হাসপাতালের চিকিৎসক বিজয়া কুমারী (৫০) ও তিন বাংলাদেশিকে গ্রেপ্তার করেছে দিল্লি পুলিশ।
এই চক্র দালালদের মাধ্যমে বাংলাদেশি রোগীদের দিল্লির বিভিন্ন সেরা হাসপাতালে কিডনি ট্রান্সপ্ল্যান্টের প্রলোভন দেখিয়ে বিজয়া কুমারী ও তার সহযোগীদের কাছে নিয়ে আসতেন। আল শিফা নামে একটি মেডিকেল ট্যুরিজম প্রতিষ্ঠানের মাধ্যমে দাতা ও গ্রহীতার মধ্যে সমন্বয়, চিকিৎসা, মেডিকেল পরীক্ষার কাজগুলোর ব্যবস্থাপনা করা হতো।
কুষ্টিয়ার ভেড়ামারার রাসেল (২৯), মোহাম্মদ সুমন মিয়া ও ইফতি নামের তিন বাংলাদেশি এবং ত্রিপুরার বাসিন্দা রতিশ পাল তাদের নিজ নিজ এলাকা থেকে আগ্রহী কিডনিদাতাদের মোটা অঙ্কের অর্থের প্রলোভন দেখিয়ে দিল্লিতে নিয়ে আসতেন।
কিডনিদাতাদের চক্রটি চার থেকে পাঁচ লাখ রুপি দিলেও গ্রহীতাদের কাছ থেকে ২৫ থেকে ৩০ লাখ রুপি আদায় করতেন তারা। ইফতি ছাড়া অভিযুক্ত বাকি তিন ব্যক্তিকে গ্রেপ্তার করা হয়েছে।
বাংলাদেশের কুষ্টিয়ার ভেড়ামারার বাসিন্দা রাসেলের পাশাপাশি মিঞা (২৮) ও মোহাম্মদ রোকন (২৬) নামে দুই ব্যক্তি জিজ্ঞাসাবাদের সময় একই অ্যাপার্টমেন্টে ছিলেন।
গ্রেপ্তারের সময় রাসেলের কক্ষ থেকে একটি ব্যাগে নয়টি পাসপোর্ট, দুইটি ডায়েরি ও একটি রেজিস্টার খাতা উদ্ধার করা হয়। এর মধ্যে তিনটি পাসপোর্ট কিডনিদাতা ও গ্রহীতার এবং ডায়েরিতে তাদের মধ্যে (দাতা ও গ্রহীতা) আর্থিক লেনদেনের বিস্তারিত লেখা ছিল।
রোকনের কাছ থেকে উদ্ধার করা ব্যাগে ২০টি সিল দেওয়ার স্ট্যাম্প ও দুইটি স্ট্যাম্প প্যাড (নীল ও লাল) পাওয়া যায়। অভিযোগ মতে, জাল নথি তৈরিতে এসব উপকরণ ব্যবহার করা হতো। রোকনকেও গ্রেপ্তার করা হয়েছে।
মেসেঞ্জার/রাজু/আপেল
