ঢাকা,  রোববার
২২ ডিসেম্বর ২০২৪

The Daily Messenger

ধরা ছোঁয়ার বাইরে পিরোজপুরের মহারাজ-মিরাজ 

মেসেঞ্জার অনলাইন

প্রকাশিত: ১৩:৫৫, ১৯ সেপ্টেম্বর ২০২৪

ধরা ছোঁয়ার বাইরে পিরোজপুরের মহারাজ-মিরাজ 

ছবি : সংগৃহীত

পিরোজপুর জেলার নানা অপকর্মের গডফাদার এবং স্থানীয় সরকার প্রকৌশল অধিদপ্তরের বিভিন্ন উন্নয়ন কাজে লুটপাটকারি হিসেবে পরিচিত মিরাজুুল এবার নতুন কৌশলে লুটপাটের আয়োজন করেছেন। 

নিজের বিভিন্ন অপকর্মের শাস্তি হতে পারে এমন ভয়ে সরকার পতনের পর থেকেই পলাতক এই মিরাজুল। বিগত সরকারের সময়ে নেওয়া বিভিন্ন কাজ কৌশলে শেষ করার জন্য বিএনপির নেতাদের উৎকোচ দিয়ে আড়ালে থেকেই কাজ উদ্ধার করতে চান তিনি। এরই মধ্যে পিরোজপুর জেলার বিএনপির দুই শীর্ষ  নেতাকে দুইটি হেরিয়ার জিপ গাড়ি এবং এক কোটি করে টাকা দিয়েছেন বলে অভিযোগ উঠেছে। জানা গেছে নিজের স্ত্রীর মাধ্যমে এই লেনদেন করেছেন মিরাজুল। বিগত আওয়ামী লীগ সরকার পতনের প্রায় দেড়  মাস অতিবাহিত হলেও ধরাছোঁয়ার বাইরে আছে ন বিতর্কিত মহিউদ্দিন মহারাজ ও মিরাজুল ইসলাম। দুইজনকে দ্রুত গ্রেপ্তারের দাবি এলাকাবাসীর।

তারা জানিয়েছেন, মহারাজ-মিরাজ এই দুই ভাইয়ের অত্যাচারের পিরোজপুর বাসি অতিষ্ঠ। দুবাইয়ের তাদের অবৈধ ব্যবসা বানিজ্য আছে। আর দেশে মাদককারবারী থেকে শুরু করে সব ধরনের অপকর্মের হোতা এই দুই ভাই এখনো অধরা। 

খোঁজ নিয়ে জানা গেছে, মিরাজুল পিরোজপুর জেলার ভান্ডারিয়া উপজেলার সাবেক উপজেলা চেয়ারম্যান। ভান্ডারিয়রা-কাউখালী এলাকার সাবেক সংসদ সদস্য মহারাজ এর ছোটো ভাই। দু’ভাই আওয়ামী রাজনীতির সাথে জড়িত। এই মহারাজ একসময় জাতীয় পার্টির আনোয়ার হোসেন মঞ্জুর ব্যক্তিগত সহকারী ছিলেন। স্বতন্ত্র প্রার্থী হিসাবে সংসদ সদস্য নির্বাচিত হন। অবশ্য এই নির্বাচনে জেতার জন্য তার ভাই ২৫০ কোটি টাকা ব্যয় করেন। আওয়ামী লীগের আবুল হাসনাত আব্দুল্লাহ, শেখ হেলাল, সাবেক প্রধানমন্ত্রীর মূখ্য সচিব, সাবেক নির্বাচন কমিশনার আহসানের হাবিবকে বিপুল অর্থ দিয়ে মহারাজ এমপি হন। 

বিগত সরকারের সময়ে এলজিইডির বিভিন্ন উন্নয়ন কাজের মান খারাপ হওয়ার জন্যও দায়ী এই মহারাজের ভাই মিরাজুল। 

এলজিইডি সূত্রে জানা গেছে, মিরাজের সাথে এলজিইডির সকল দুর্নীতিগ্রস্থ কর্মকর্তার সম্পর্ক আছে। পিরোজপুর জেলায় এলজিইডির নির্বাহী প্রকৌশলীর পোষ্টিং হতো এই দুই ভাইয়ের ইচ্ছানুযায়ী। বিগত ১৫ বছরে এলজিইডির দুর্নীতিগ্রস্থ অফিসারদের খুঁজে বের করে পোষ্টিং দেওয়া হয়। প্রথমদিকে নির্বাহী প্রকৌশলী হিসেবে নিয়ে আসেন আব্দুল হাইকে। তার সাথে মতবিরোধ হলে নিয়ে আসেন নির্বাহী প্রকৌশলী রফিকুল হাসানকে। তিনি সেখানে প্রায় চার বছর ছিলেন, তার সময়ের এলজিইডি পিরোজপুরের কাজের মান খুব খারাপ হলে তাকে প্রধান প্রকৌশলী তুলে নিয়ে আসেন। নির্বাহী প্রকৌশলী হিসাবে নিয়ে আসা হয় এলজিইডির সবচেয়ে সমালোচিত প্রকৌশলী জনাব সুশান্ত রঞ্জন রায়কে। তিনি টেন্ডারবাজি, অপ্রয়োজনীয় রিভাইস, ওভারপেমেন্ট, ডুপিকেশন (একই স্কীম একের অধিক প্রকল্প থেকে টেন্ডারকরণ) ইত্যাদি অনেক ভয়ানক অপরাধে সম্পৃক্ত। সুশান্তের বিরুদ্ধে অভিযোগের পাল্লা ভারী হলে কর্তৃপক্ষ তাকে সরানোর উদ্যোগ নেয়, আরেক দুর্নীতিপরায়ন নির্বাহী প্রকৌশলী আব্দুস সাত্তার হাওলাদারকে নিয়ে আসা হয়। তিনি গত জুন মাসে অবসরে গিয়েছেন। এরপর নিয়ে আসা হয় অনৈতিক কাজের মাস্টারমাইন্ড বর্তমান নির্বাহী প্রকৌশলী রনজিত দেকে। 

পরবর্তীতে মিরাজুল ইসলাম তৎকালীন মন্ত্রী তাজুল ইসলাম, প্রধান প্রকৌশলী রশীদের সহযোগীতায় (কোটি টাকার বিনিময়ে) সুশান্ত রঞ্জন রায়কে ‘বরিশাল-ঝালকাঠী-পিরোজপুর’ প্রকল্পের প্রকল্প পরিচালক হিসাবে নিয়োগ পাইয়ে দেন। এই প্রকল্পের আওতায় পিরোজপুর জেলায় ইফতি. ইটিসিএল (প্রাঃ) লিমিটেড কাজ পায়। যাহার প্রোপ্রাইটর মিরাজুল ইসলাম। দেশের দক্ষিণাঞ্চলে যোগাযোগ ব্যবস্থার উন্নতির জন্য (ওইজচ) নামে একটি প্রকল্প চালু হয়। এই প্রকল্পের প্রকল্প পরিচালক ছিলেন আহমদ আলী। তাকে এই প্রকল্পের দায়িত্ব থেকে সরিয়ে সুশান্ত রঞ্জন রায়কে অতিরিক্ত দায়িত্ব দেওয়া হয়। কারণ আহমেদ আলী জানতে পারেন তার প্রকল্পের প্রায় ১৫/২০টি ব্রীজের কাজ শুরু হয়নি। অথচ ৮৫% পেমেন্টের জন্য চাপ প্রয়োগ করেন। এই কাজগুলো করার জন্য নির্বাচিত হয়েছিলেন ইফতি. ইটিসিএল (প্রাঃ) লিমিটেড। কাজগুলোর ওভারপেমেন্ট, ডুপিকেশন, টেন্ডারিং ইত্যাদি ঘাপলাসহ আহমেদ আণলীর বিষয়টি পুণঃতদন্ত করে দেখা উচিত বলে সংশিষ্টরা জানান। 

পিরোজপুরে ইউওজডঝচ প্রকল্প এর কাজ শুরু হয় ২০২২ সালে। শুরুতেই এই প্রকল্প থেকে প্রায় ১৫০ কোটি টাকার স্কীম বাস্তবায়নের জন্য দরপত্র আহ্বানের নিমিত্তে অনুমোদন দেয়া হয়। ঐ অর্থ-বছরেই পিরোজপুর জেলায় প্রকল্প পরিচালক ১১০ কোটি টাকা ছাড় করেন। কাজগুলোর বেশিরভাগই নামে-বেনামে বাস্তবায়ন করছে ইফতি. ইটিসিএল (প্রাঃ) লিমিটেড। তাদেরকে বরাদ্দকৃত টাকার প্রায় পুরোটাই দিয়ে দেওয়া হয়। অথচ তখন পর্যন্ত মাঠে ৫% কাজও বাস্তবায়িত হয়নি। তাকে প্রকল্প পরিচালক নিয়োগ করার জন্য মিরাজ কোটি টাকার বেশি মন্ত্রীকে প্রদান করেন। ওই প্রকল্পের দায়িত্বে ছিলেন মো. সেলিম মিয়া। এ প্রকল্পের অধীনে পিরোজপুর জেলায় ১৮টি ব্রীজ নির্মাণের জন্য অনুমোদন দেয়া হয়। প্রায় সবগুলোর কাজ করার দায়িত্ব পায় ইফতি. ইটিসিএল (প্রাঃ) লিমিটেড। এসব স্কীমের ১৪টি তারা নিজে করছে। এই ১৪টি কাজের কোনো কাজই শুরু হয়নি অথচ পরিশোধ করা হয় চুক্তিমূল্যের প্রায় ৮৫% টাকা । ছ্যাফড্রিপ প্রকল্পের মাধ্যমে পিরোজপুর জেলায় ৭০ এর অধিক স্কীম বাস্তবায়িত হচ্ছে। এই প্রকল্পের প্রকল্প পরিচালক মো. রফিকুল হাসান। আশ্চর্যজনক হলেও সত্য এর মধ্যে প্রায় ৬৫টি স্কীম ইফতি. ইটিসিএল (প্রাঃ) লিমিটেড পেয়েছে। এ প্রকল্পের কাজগুলোর টেন্ডারিং প্রক্রিয়াসহ গুণগতমান নির্ধারণেের জন্য সংশিষ্ট কর্তৃপক্ষ সরেজমিনে পরিদর্শন করলে আসল রহস্য বেরিয়ে আসবে। 

এদিকে পিরোজপুর জেলার পল্লী অবকাঠামো উন্নয়ন প্রকল্পের প্রকল্প পরিচালক মো. ইব্রাহীম। মিরাজের ইচ্ছে অনুযায়ী তাকে নিয়োগ দেয়া হয়। মিরাজের সাথে সাবেক মন্ত্রী তাজুল ইসলাম ও ভান্ডারিয়া নিবাসী সাবেক প্রধানমন্ত্রীর মূখ্যসচিব তোফাজ্জেল হোসেনের দহরম-মহরম সম্পর্ক। মূলত এদেরকে ব্যবহার করে বরিশাল বিভাগের সমস্ত প্রকল্পের প্রকল্প পরিচালকদের নিয়োগে মুখ্য ভূমিকা পালন করেন।

এলজিইডি সূত্র জানায়, দেশের পরিবর্তীত সর্বত্র সংস্কার হলেও এখানকার বিতর্কিত কর্মকর্তারা এলজিইডি মন্ত্রণালয়সহ সর্বত্র দাবড়িয়ে বেড়াচ্ছেন। তাদের এই দৌরাত্বের সীমা শুরু বরিশাল বিভাগের মধ্যেই সীমাবদ্ধ ছিল না। এলজিইডির আওতাধীন বাংলাদেশের সমস্ত প্রকল্পের পরিচালক নিয়োগে মন্ত্রীর সাথে কাজ করেছেন। এ অবস্থায় অনতিবিলম্বে বরিশাল বিভাগের সমস্ত প্রকল্প পরিচালদেরকে দায়িত্ব থেকে অপসারন করে দায়িত্বশীল কর্মকর্তাদের নিয়োগদানের পরামর্শ সংশিষ্টদের।

এ ব্যাপারে মিরাজুল ইসলামের বক্তব্য জানতে তার সাথে যোগাযোগের চেষ্টা করা হলে বর্তমান ছাত্র-জনতার আন্দোলনের পরিবর্তীত প্রেক্ষাপটে তিনি আত্মগোপনে থাকায় তার মতামত জানা সম্ভব হয়নি। পিরোজপুর জেলা বিএনপির সাবেক যুগ্ম-সম্পাদক বিএনপির ভারপ্রাপ্ত চেয়ারম্যান তারেক রহমানের সাথে এক সাথে জেলে থাকা নির্যাতিত নেতা মো. রিজাউল ইসলাম রিয়াজ অভিযোগ করে বলেন, মিরাজ এবং তার বড় ভাই মহারাজ বড় ধরনের লুটেরা। বিগত সরকারের সময় তারা কয়েক হাজার কোটি টাকা লুট করেছে। শেখ হাসিনা সরকারের পতনের পরেই তারা আত্মগোপনে চলে যায়।

মেসেঞ্জার/দিশা