ঢাকা,  সোমবার
৩০ ডিসেম্বর ২০২৪

The Daily Messenger

সঙ্গীত শিল্পী ও শিক্ষক থেকে ৫০০ কোটি টাকার মালিক হেনরী

সিরাজগঞ্জ প্রতিনিধি

প্রকাশিত: ২১:১৫, ৯ অক্টোবর ২০২৪

সঙ্গীত শিল্পী ও শিক্ষক থেকে ৫০০ কোটি টাকার মালিক হেনরী

ছবি : মেসেঞ্জার

১৯৮৮ সালে সিরাজগঞ্জ জেলা আওয়ামীলীগের সাবেক সভাপতি মোতাহার হোসেন তালুকদারের মেঝো ছেলে লাবুর সঙ্গে বিয়ে হয় জান্নাত আরা হেনরীর। সাদামাটা গৃহবধু শহরের সবুজ কানন স্কুল অ্যান্ড কলেজে সহকারী শিক্ষক হিসেবে চাকরী করেছেন তিনি। তবে হেনরী মূলত পরিচিত পান রবীন্দ্র সংগীত শিল্পী হিসেবে।

জানা যায়, ১৯২২ সালে সিরাজগঞ্জ সদর উপজেলার রতনকান্দি ইউনিয়নের গজারিয়ার প্রত্যন্ত গ্রামে জন্ম গ্রহন করেন মোতাহার হোসেন তালুকদার। মেধাবী ছাত্র হিসেবে বেড়ে ওঠা মোতাহার হোসেনের রাজনীতির হাতেখড়ি ছাত্র জীবন থেকেই। ভাষা আন্দোলন থেকে শুরু করে শিক্ষা আন্দোলন, ছয় দফা আন্দোলন, স্বাধীনতা আন্দোলনসহ জাতীয় পর্যায়ের বিভিন্ন আন্দোলন-সংগ্রামে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করেছেন তিনি।

আওয়ামী লীগের প্রতিষ্ঠালগ্ন থেকে তিনি এ সংগঠনের সঙ্গে যুক্ত ছিলেন। ১৯৬৮ সাল থেকে মৃত্যু (২০০১) পর্যন্ত সিরাজগঞ্জ জেলা আওয়ামী লীগের সভাপতি হিসেবে দায়িত্ব পালন করেছেন। মুক্তিযুদ্ধেও ছিল তার অসামান্য অবদান। একারনে মোতাহার হোসেন তালুকদার মূলত মোতাহার মাস্টার নামেই পরিচিত ছিলেন।

এমনকি বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবর রহমানও তাকে মাস্টার বলে ডাকতেন। রাজনৈতিক পরিবারের পুত্রবধূ হওয়ার সুবাদে আওয়ামী লীগের সহযোগী সংগঠন মহিলা আওয়ামী লীগের রাজনীতিতে সক্রিয় হন। এক পর্যায়ে কেন্দ্রীয় মহিলা আওয়ামী লীগের বন ও পরিবেশ বিষয়ক সম্পাদকের দায়িত্ব পান। পরে ২০০৮ সালে জাতীয় সংসদ নির্বাচনে প্রার্থী হয়ে পরাজয় হয়। কিছু দিনের মধ্যেই জান্নাত আরা হেনরী সোনালী ব্যাংকের পরিচালক পদ পেয়ে যান।

আর এই পদটি যেন আলাদীনের প্রদীপের মতো স্কুল শিক্ষিকার ভাগ্যের চাকা ঘুরিয়ে দেয় তার। এরপর আর পেছন ফিরে তাকাতে হয়নি। ধীরে ধীরে দলীয় পদ-পদবির পাশাপাশি বাড়তে থাকেও তার সম্পদের পরিধিও। দ্বাদশ জাতীয় সংসদ নির্বাচনে বিজয়ী হয়ে বনে যান সিরাজগঞ্জের একচ্ছত্র ক্ষমতাধর নেত্রী। নিজে সংসদ সদস্য হওয়ার তিন মাসের মধ্যে কোটি কোটি টাকা খরচ করে স্বামী শামীম তালুকদার লাবুকে জেলা পরিষদ চেয়ারম্যান বানিয়ে আনেন। অবশ্য এ নিয়ে আওয়ামী লীগের একটি বড় অংশ তার ওপর ক্ষুব্ধ হয়।

জান্নাত আরা হেনরী অনিয়ম, দুর্নীতি, ও ক্ষমতার অপব্যবহারের মাধ্যমে আওয়ামীলীগের ১৬ বছরে ৫০০ কোটিরও বেশি টাকার সম্পদের মালিক গেছেন। অথচ ২০০৮ সালে মাত্র সাড়ে ৬ লাখ টাকার সম্পদের মালিক ছিলেন তিনি। সরকারি হিসেবেই তার সম্পদ বেড়েছে ৮৮৪ গুণ, বেসরকারি হিসেবে যা ২১শ’ গুণেরও বেশি। এ নিয়ে দুর্নীতি দমন কমিশন (দুদক) তদন্ত শুরু করলেও অজানা কারণে দেওয়া হয় দায়মুক্তি।

অনুসন্ধ্যানে জানা যায়, ২০০৮ সালে নবম জাতীয় সংসদ নির্বাচনে সিরাজগঞ্জ-২ আসনে আওয়ামী লীগের মনোনয়ন যুদ্ধে তৃণমূল ভোটে অংশগ্রহণ করে দ্বিতীয় হন। প্রথম হয়েছিলেন দলের সাবেক প্রেসিডিয়াম সদস্য মোহাম্মদ নাসিম। দুর্নীতির মামলায় তিনি নির্বাচনে অংশ নিতে না পারায় ভাগ্যের চাকা খুলে যায় হেনরীর।

নৌকা প্রতীকে পান রাজনীতিতে সম্পূর্ণ আনাড়ি গৃহবধূ। ওই নির্বাচনে অল্প ভোটের ব্যবধানে হেরে যান তিনি। ২০০৯ সালে শেখ হাসিনার নেতৃত্বাধীন মহাজোট সরকার গঠন করার পর জান্নাত আরা হেনরীকে করা হয় সোনালী ব্যাংকের পরিচালনা পর্ষদের সদস্য।

এরপরই ফুলে ফেঁপে উঠতে থাকে জান্নাত আরা হেনরীর সম্পদ। রিকশা থেকে একলাফে উঠে যান ৮৭ লাখ টাকার ল্যান্ড ক্রুজারে। সিরাজগঞ্জ ও ঢাকাসহ বিভিন্ন স্থানে গড়ে তোলেন কয়েকটি বাড়ি ও একাধিক ব্যবসা প্রতিষ্ঠান। মাত্র সাড়ে তিন বছরেই তিনি শত কোটি টাকার মালিক বনে যান।

আলোচিত হলমার্ক কেলেঙ্কারির মামলায় জড়িয়ে পড়েন জান্নাত আরা হেনরী। এ ঘটনায় পরিচালনা পর্ষদের কয়েকজন সদস্যের বিরুদ্ধে ঘুষ নেওয়ার অভিযোগ ওঠে। অবশ্য ২০১৩ সালের সেপ্টেম্বর মাসে ওই অভিযোগ থেকে দায়মুক্তি পান হেনরীসহ পরিচালকরা।

নাম প্রকাশে অনিচ্ছুক একাধিক আওয়ামী লীগ ও বিএনপি নেতারা জানান, হলমার্ক কেলেঙ্কারি থেকে দায়মুক্তির পর ধীরে ধীরে ব্যবসা প্রতিষ্ঠান ও সম্পত্তি বাড়াতে থাকেন হেনরি। নিজের নামে ছাড়াও স্বামী শামীম তালুকদার লাবু, মেয়ে ও বোনের নামে একের পর এক সম্পদ গড়ে তোলেন।

দশম ও একাদশ জাতীয় সংসদ নির্বাচনে চেষ্টা করেও দলীয় মনোনয়ন পেতে ব্যর্থ হন তিনি। ২০২৩ সালে জেলা আওয়ামী লীগের যুগ্ম-সাধারণ সম্পাদক নির্বাচিত হওয়ার পর রাজনীতিতে তার প্রভাব ক্রমশই বাড়তে থাকে। অবশেষে দ্বাদশ জাতীয় সংসদ নির্বাচনে মনোনয়ন বাগিয়ে এনে প্রথমবারের মতো এমপি নির্বাচিত হন। নিজে এমপি নির্বাচিত হওয়ার তিন মাসের মাথায় স্বামী শামীম তালুকদার লাবুকে কোটি কোটি টাকা খরচ করে জেলা পরিষদ চেয়ারম্যান নির্বাচিত করে আনেন।

খোঁজ নিয়ে জানা যায়, সিরাজগঞ্জ ও গাজীপুরে হেনরীর নামে সাইনবোর্ড দেওয়া স্থাবর অনেক সম্পদ আছে। সিরাজগঞ্জ শহরের মুজিব সড়কে একটি দ্বিতল বাসভবন, পাশে আরেকটি ৬তলা বিলাসবহুল বাড়ি, ওই বাড়ির বিপরীত পাশে ৯তলা ভবনে রয়েছে অর্ধকোটি টাকা মূল্যের একটি ফ্ল্যাট, শহরের ফজল খান রোডে হেনরী স্কলাসটিকা স্কুল অ্যান্ড কলেজ, সদর উপজেলার নলিছাপাড়া নামক স্থানে হেনরী বিজ্ঞান ও প্রযুক্তি কলেজ, পাশেই হেনরী ইনস্টিটিউট অব বায়োসায়েন্স টেকনোলজি, রতনকান্দি ইউনিয়নের গজারিয়াতে ‘হেনরী ভুবন’ নামে আধুনিকমানের বিশাল বৃদ্ধাশ্রম, তার বিপরীত পাশে ‘কিছুক্ষণ’ নামে একটি রিসোর্ট, রিসোর্টের পশ্চিম পাশে অপটিক ফাইবার কারখানা, তার পাশে গরুর খামার, উত্তর পাশে শ্বশুর মোতাহার হোসেন তালুকদারের নামে হোমিওপ্যাথিক মেডিকেল কলেজ ও হাসপাতাল, সয়দাবাদ ইউনিয়নের সদানন্দপুরে পাঁচতলা আবাসিক ভবন, কড্ডায় নির্মাণাধীন রয়েছে পেট্রোল পাম্প, শহরের সদর পোস্ট অফিসের বিপরীতে নির্মিত হচ্ছে একটি বহুতল ভবন।

সম্প্রতি সংসদ সদস্য নির্বাচিত হওয়ার কিছুদিন পর শিয়ালকোল ইউনিয়নের শিলন্দা গ্রামে ১০ দশমিক ১২ বিঘা অকৃষি জমি প্রায় সাড়ে ১১ কোটি টাকায় কিনেছেন হেনরী। গাজীপুরের শ্রীপুরে বিলাসবহুল ‘রাস রিসোর্ট’ প্রতিষ্ঠা করেছেন হেনরী। ১৪টি আধুনিক কক্ষ, পাঁচটি প্রিমিয়াম বাংলো, আলাদা জায়গায় চারটি আর্কিটেকচারাল ডিলাক্স কটেজ ও আধুনিক সুইমিংপুল রয়েছে। শ্রীপুরে রয়েছে গরুর খামার।  

তথ্য অনুযায়ী সিরাজগঞ্জ, ঢাকা ও গাজীপুরে প্রায় সাড়ে ১৮শ শতাংশ কৃষি ও অকৃষি জমি রয়েছে হেনরীর। এছাড়াও রয়েছে ৯টি বিলাসবহুল গাড়ি। এর মধ্যে ৯৫ লাখ টাকা মূল্যের একটি প্রাডো জিপ, ১৮ ও ২৬ লাখ টাকা মূল্যের দুটি প্রাইভেট কার, ১২ লাখ টাকা মূল্যের একটি পিকআপ। আরও রয়েছে ৫টি মাইক্রোবাস। ৯টি গাড়ির মোট মূল্য দেখানো হয়েছে প্রায় ২ কোটি ৪৫ লাখ টাকা।

২০০৮ সালের নির্বাচনী হলফনামা অনুযায়ী জান্নাত আরা হেনরীর বাৎসরিক আয় দেখানো হয়, এক লাখ বাইশ হাজার টাকা। সে সময় সম্পদ দেখানো হয়েছিল প্রায় ৬ লাখ ৩৪ হাজার ৫০০ টাকার। ১৬ বছরের মধ্যে তিনি ৫০০ কোটি টাকার মালিক হয়েছেন বলে অভিযোগ রয়েছে।

উল্লেখ্য, (৫ আগস্ট) বৈষ্যম বিরোধী ছাত্র-জনতার আন্দোলনে চলাকালে সিরাজগঞ্জ শহরে যুবদল ও ছাত্রদলের তিন নেতাকর্মীকে গুলি ও কুপিয়ে হত্যার ঘটনায় তাদের বিরুদ্ধে মামলা দায়ের হয়। মামলার পর থেকে তারা পলাতক ছিলেন। পরে র‌্যাব-১২ ও র‌্যাব-৯ যৌথ অভিযানিক দল মৌলভীবাজারের সোনাপুর এলাকায় অভিযান চালিয়ে এজাহারনামীয় পলাতক আসামী ড. জান্নাত আরা তালুকদার হেনরী ও তার স্বামী লাবু তালুকদারকে গ্রেপ্তার করে।

পরে তারা ৭ দিনের রিমান্ড খাটেন। বর্তমানে তারা কারাগারে রয়েছেন। হেনরির সম্পদের বিষয়ে তার আত্মীয়স্বজনেরাও মুখ খোলেনি। হেনরী ও লাবু কারাগারে থাকায় তাদের বক্তব্য নেওয়া সম্ভব হয়নি।

মেসেঞ্জার/রাসেল/তারেক