ঢাকা,  বুধবার
১৬ অক্টোবর ২০২৪

The Daily Messenger

সহিংসতায় দেড় কোটি টাকার মালামাল পুড়েছে কিডনী রোগী রাসেল চাকমার, ক্ষতিপূরণের আশায় ছুটছেন প্রশাসনে

সুপ্রিয় চাকমা, রাঙামাটি প্রতিনিধি

প্রকাশিত: ১৭:২৫, ১০ অক্টোবর ২০২৪

আপডেট: ১৯:০৬, ১০ অক্টোবর ২০২৪

সহিংসতায় দেড় কোটি টাকার মালামাল পুড়েছে কিডনী রোগী রাসেল চাকমার, ক্ষতিপূরণের আশায় ছুটছেন প্রশাসনে

ছবি : মেসেঞ্জার

রাঙামাটিতে সাম্প্রদায়িক হামলার ঘটনায় দুর্বৃত্তদের অগ্নিসংযোগে পুড়ে গেছে রাসেল চাকমার দুইটি দোকান। তার দাবি, পূর্ব পরিকল্পিতভাবে তার দুই দোকানে অগ্নিসংযোগ করে দোকানের বুদ্ধমূর্তিসহ দোকানের জিনিসপত্র লুটপাট করা হয়েছে। অগ্নিকান্ডে তার দুই দোকানে রাসেল ষ্টোরে ৯২ লাখ টাকা এবং প্রিয় ষ্টোরে ৬২ লাখ টাকার মালামাল আগুনে পুড়ে যায়। 

দুই দোকান আগুনে পুড়ে গিয়ে নিঃস্ব হয়ে ক্ষতিপূরণ পাওয়ার আশায় হাতে দরখাস্ত নিয়ে ছুটছেন প্রশাসনের কাছে। তারপরও ঘুরে দাঁড়ানোর চেষ্টায় ব্যাংক থেকে ৫০ লাখ টাকা ঋণ নিয়ে মালামাল ক্রয় করে দোকান সাজানো শুরু করেছেন। আগুনে পুড়ে যাওয়া দুই দোকানে বিক্রি করতেন বৌদ্ধ ভিক্ষুদের পরিধেয় বস্ত্র (চীবর), সাভেক (ভিক্ষাপাত্র), চাদর, বুদ্ধমূর্তি, বুদ্ধ পতাকাসহ স্টেশনারি বিভিন্ন জিনিসপত্র।

রাসেল চাকমা একজন কিডনী রোগী। দীর্ঘ এক বছর যাবৎ তিনি কিডনী রোগে আক্রান্ত হয়ে ডায়ালাইসিস করে জীবনের সাথে যুদ্ধ করে যাচ্ছেন। প্রতিমাসে ৫০ হাজার টাকা গুণতে হয় ডায়ালাইসিসে। দুই দোকানের মালামাল বিক্রি করে ডায়ালাইসিসের টাকা জোগাড় করতেন। সেই সম্ভলও আগুনে পুড়িয়ে দেয় দুর্বৃত্তরা। 

অন্যদিকে আগুনে পুড়ে যাওয়া আরেক দোকানের বুদ্ধমূর্তি, ভিক্ষুদের পরিধেয় বস্ত্রসহ (চীবর) বিভিন্ন মালামাল পরিষ্কার করছেন রাসেল চাকমা মা ঊষা চাকমা। কান্নার করুনসুরে বলতে লাগলেন তার দোকানের ক্ষতিগ্রস্তের কথা। সাম্প্রদায়িক হামলার ঘটনার দিনে নাশকতা হওয়ার আগেই দোকান বন্ধ করে বাড়ি যান। পরে মুঠোফোনে শুনেন তার দোকানে আগুন দেওয়ার বিষয়। তিনি সরকারের কাছে ক্ষতিপূরণসহ অপরাধীদের গ্রেপ্তার করে সুষ্ঠু বিচারের দাবি জানান।

সরেজমিনে ঘুরে দেখা গেছে, দোকানটির নাম প্রিয় ষ্টোর। পাশের আরেক দোকান রাসেল ষ্টোর। দুই দোকানে আগুন দেয় দুর্বৃত্তরা। আগুনে পুড়ে যাওয়া প্রিয় ষ্টোরটি রং করে নতুন করে মালামাল সাজাচ্ছেন রাসেল চাকমা। আগের ন্যায় এবারেও বৌদ্ধ ভিক্ষুদের পরিধেয় বস্ত্র (চীবর), সাভেক (ভিক্ষাপাত্র), বুদ্ধমূর্তিসহ বিভিন্ন জিনিসপত্র সাজাচ্ছেন।

এক পর্যায়ে রাসেল এর জন্য দুপুরের খাবার নিয়ে আসেন তার সহধর্মিনী ও তার পুত্র সন্তান। কর্মব্যস্ততা বেড়ে গেছে তাদের। সামনে কঠিন চীবর দানোৎসব। তারপরেও তাদের মুখে হাসি নেই। আছে শুধু আতঙ্ক। কথপোকথনের এক পর্যায়ে রাসেল চাকমা আক্ষেপ করে বলেন,‘সামনের মাস কঠিন চীবর দানের মাস। তখন প্রত্যেক বিহারে কঠিন চীবর দান হয়। চীবরসহ অনেক কিছু বিক্রির ধুম পড়ে যেত। তবে এবারে কঠিন চীবর না করলেই ভালো হয়। কেননা, প্রশাসনের সামনেই তো এসব নাশকতা হলো। আমার দুই দোকান পূর্বপরিকল্পিতভাবে আগুনে পুড়িয়ে দেওয়া হলো। আমরা নিরাপত্তাহীনতায় ভূগতেছি।’

রাসেল চাকমা আরো বলেন, দুই দোকানের মালামাল কিনতে অগ্রণী ব্যাংক থেকে ৬৫ লাখ টাকা এবং ব্রাক ব্যাংক থেকে ১৫ লাখ টাকা ঋণ নিয়েছিলেন। সেগুলোর প্রতিমাসে ঋণ পরিশোধ করতে হয়। দুই কিডনী নষ্ট হয়েছে এক বছর আগে। ডায়ালাইসিস করে কোনো রকম জীবন চালিয়ে নিতে হয়।

পরিবারের সব খরচ থেকে শুরু করে তার প্রতিমাসে ডায়ালাইসিস এর খরচ জোগাড় হতো দোকানে বেচা-বিক্রির উপর নির্ভর করে। তাও হঠাৎ তরে পূর্বপরিকল্পিতভাবে দুই দোকানে অগ্নিসংযোগ করে বুদ্ধমূর্তিসহ দামি জিনিসগুলো লুটপাট করে নিয়ে যায়। এ ব্যাপারে রাঙামাটি কতোয়ালী থানায় অভিযোগ দাখিল করতে চাইলেও পুলিশ অভিযোগ নেয়নি। বরং তারা নিজেরাই সাধারণ ডায়েরী লিখে দিয়েছিল। 

অন্যদিকে (২০ সেপ্টেম্বর) রাঙামাটিতে সংঘটিত সাম্প্রদায়িক হামলার ঘটনায় শহরের বিভিন্ন এলকায় ১১টি বসতবাড়িতে ভাংচুর ও ৭টি বসতবাড়িতে অগ্নিসংযোগ এবং ২২টি ব্যবসা প্রতিষ্ঠানে অগ্নিসংযোগের ঘটনা ঘটেছে বলে নিশ্চিত করেছেন রাঙামাটির সদর উপজেলা নির্বাহী কর্মকর্তা (ইউএনও) রিফাত আসমা।

তিনি বলেন, ‘ঘটনাস্থল পরিদর্শন করে এ পর্যন্ত ১১টি বসবাড়িতে ভাংচুর, ৭টি বসতবাড়িতে অগ্নিসংযোগের তথ্য পেয়েছি। এছাড়াও শহরের ২২টি ব্যবসা প্রতিষ্ঠানে অগ্নিসংযোগসহ শহরের বিভিন্ন স্থানে ভাংচুরের ঘটনা ঘটেছে। তবে যেসকল বসতাড়িতে ভাংচুর ও অগ্নিসংযোগ করা হয়েছে সেগুলো পাহাড়ি জনগোষ্ঠীর ছিল। তবে অগ্নিসংযোগে ক্ষতিগ্রস্তদের মধ্যে ৩ ব্যবসা প্রতিষ্ঠান বাঙালির। 'বসতবাড়িতে' অগ্নিসংযোগের ঘটনায় মূলত বাঙালিরা ক্ষতিগ্রস্ত হয় নি।

অনিক কুমার চাকমা হত্যা মামলায় গেল বুধবার মো. জালাল (২৫) নামে এক আসামী ও নাশতকতা সৃষ্টি মামলায় সজিব চাকমা ও অনুপম চাকমা নামে দুইজনকে গ্রেপ্তার করা হয়েছে বলে জানিয়েছেন রাঙামাটি কতোয়ালী থানার ভারপ্রাপ্ত কর্মকর্তা (ওসি) শাহেদ উদ্দীন।

তিনি আরো বলেন, এর আগে অনিক কুমার চাকমা হত্যা মামলায় মো. রুবেল (২৩) ও এক কিশোরকে (১৭) গ্রেপ্তার করা হয়। এছাড়াও নাশকতা মামলায় রাকিব (২৭) সহ দুইজকে গ্রেপ্তার করা হয়। এ পর্যন্ত অনিক চাকমা হত্যা মামলায় ৩ জন ও নাশকতা মামলায় ৪ জনকে গ্রেপ্তার করা হয়েছে।

প্রসঙ্গত, গেল (১৯ সেপ্টেম্বর) খাগড়াছড়ির দীঘিনালায় সাম্প্রদায়িক সহিংসতার ঘটনায় পাহাড়িদের ঘরবাড়ি, দোকানপাটে অগ্নিকান্ড ও হামলার অভিযোগ তুলে (২০ সেপ্টেম্বর) রাঙামাটিতে সংঘাত ও বৈষম্যবিরোধী পাহাড়ি ছাত্র আন্দোলন এর ব্যানারে রাঙামাটিতে প্রতিবাদ ও বিক্ষোভ মিছিল অনুষ্ঠিত হয়।

ওইদিন মিছিলে সাম্প্রদায়িক সহিংসতার ঘটনা ঘটে। এসময় শহরের কালিন্দীপুর এলাকার গলিতে প্রকাশ্যে পিটিয়ে খুন করা হয় অনিক চাকমাকে। পরের দ্বিতীয় দিন রাঙামাটি কতোয়ালী থানায় মামলা দায়ের করেন অনিকের বাবা আদর সেন চাকমা। অনিক কুমার চাকমা কাপ্তাই কর্ণফুলী কলেজে একাদশ শ্রেণিতে অধ্যায়ণরত ছিলেন। মগবান ইউনিয়নের ৩নম্বর ওয়ার্ডের নোয়াদম পাড়ার আদর সেন চাকমার ছোট ছেলে।

মেসেঞ্জার/সুপ্রিয়/তারেক