ছবি : মেসেঞ্জার
মুখে কাঁচা-পাকার মিশ্রনের দাঁড়ি। মাথায় সাদা পাগড়ি। নাম মো. আলাউদ্দিন। সুন্দর মুখোচ্ছবির এ মানুষটি রাজশাহীর দুর্গাপুর উপজেলার বখতিয়ারপুর উচ্চ বিদ্যালয়ের প্রধান শিক্ষক। তার বিরুদ্ধে জমিদারী প্রথায় বিদ্যালয় পরিচালনা, আর্থিক দুর্নীতি, স্বেচ্ছাচারীতা ও শিক্ষকদের মানসিক নির্যাতনের অভিযোগ প্রমাণিত হলেও ব্যবস্থা নেওয়া হচ্ছে না।বিদ্যালয়ের ভুক্তভোগী সহকারী শিক্ষকেরা জানান, ‘নিজে জমিদার সেজে প্রধান শিক্ষক আমাদের সকলকে প্রজা বানিয়ে রেখেছেন।’
জানা যায়, ২০২১ সালে ভুক্তভোগীরা মাধ্যমিক ও উচ্চশিক্ষা অধিদপ্তর রাজশাহী আঞ্চলিক কার্যালয়ের উপ-পরিচালক বরাবর বিদ্যালয়ের ১১জন সহকারী শিক্ষক, প্রধান শিক্ষকের বিরুদ্ধে ১৬টি অভিযোগ দেন। প্রাপ্ত অভিযোগ তদন্তে জন্য দুর্গাপুরের মাধ্যমিক শিক্ষা অফিসার মো. জাহীদুল হক ও পুঠিয়ার মাধ্যমিক শিক্ষা অফিসার লায়লা আখতার জাহানের সমন্বয়ে দুই সদস্যের কমিটি গঠন করেন উপপরিচালক।
২০২২ সালের (১০ আগস্ট) তদন্ত কমিটি উপরিচালকের দপ্তরে প্রতিবেদন দেন। প্রতিবেদনে প্রধান শিক্ষকের বিরুদ্ধে উত্থাপিত সকল অভিযোগ প্রমাণিত হয়েছে বলে উল্লেখ করা হয়।
প্রতিবেদন সূত্রে জানা যায়, ২০২১ সালের (১৯ সেপ্টেম্বর) তদন্ত কমিটি অভিযুক্ত প্রধান শিক্ষক আলাউদ্দিন ও অভিযোগকারী সহকারী শিক্ষক যথাক্রমে আরিফা খাতুন, রফিকুল ইসলাম, কাজিম উদ্দিন, এনামুল হক, রেহেনা পারভীন, গোলেনুর খাতুন, এম এ মান্নান, মাসুরা খাতুন, মকসেদ আলী ও সোহানা বারীর বক্তব্য, প্রধান শিক্ষকের ব্যাখ্যা ও উপস্থিত নথিপত্র পর্যালোচনা করেছে।
এছাড়া অধিকতর পর্যালোচনার জন্য প্রধান শিক্ষক চাহিদামতো নথিপত্র সরবরাহ করেননি। সূত্র মতে, বিদ্যালয়ের পুকুরসহ মোট জমি ৪৩ বিঘা। ১৬৭ শতাংশ বা ৫ বিঘা জমিতে ভবন ও খেলার মাঠ। ৩৫ বিঘা পুকুর। ধানী ২২ শতাংশ, ভিটা ২৩ শতাংশ। অনাবাদী ৫৪ শতাংশ। পুকুর ও জমি লিজ খাতে বছরে প্রায় ১০ লাখ টাকা আয় হয়। যা ব্যাংকের পরিবের্তে প্রধান শিক্ষক নিজ জিম্মায় রেখে ইচ্ছামত খরচ করেন।
ম্যানেজিং কমিটির সিদ্ধান্তের রেজুলেশনে পুকুর-জমি লিজের সিদ্ধান্ত পাওয়া যায়নি। তবে ক্যাশ বইয়ে একই দিন আয়-ব্যয়ের সমতা দেখানো হয়। অভিযুক্ত প্রধান শিক্ষক দায়িত্বে আসার পর বিদ্যালয়ের কোনো সঠিক হিসাব নেই। জমা-খরচের হিসাবে ম্যানেজিং কমিটির অনুমোদন বিহীন ভাউচার পাওয়া যায়। নিরীক্ষণের জন্য কখনো অভ্যন্তরীণ নিরীক্ষা করা হয় না।
সূত্র জানায়, এনটিআরসিএ (বেসরকারি শিক্ষক নিবন্ধন প্রত্যায়ন কর্তৃপক্ষ) সুপারিশকৃত নিয়োগেও আর্থিক সুবিধা নিয়েছেন প্রধান শিক্ষক। এছাড়া এনটিআরসি কর্তৃপক্ষের নিকট শূন্যপদ না পাঠিয়ে খ-কালীন অথবা এনটিআরসিএ সনদ ও প্রশিক্ষণ ছাড়াই শিক্ষক নিয়োগ দেয়া হয়। ইংরেজির শিক্ষক নিয়োগ এর প্রমাণ।
বিদ্যালয় ডিজিটালের নামে ৫বছরধরে প্রত্যেক শিক্ষার্থীর থেকে ২৫০ টাকা আদায় ও আত্মসাত করেন। সহকারী শিক্ষক হাকিম সরকার প্রধান শিক্ষকের অপকর্মে সহযোগিতা না করায় তাকে ৯বছর আগেই ২০১৮ সালের (১ সেপ্টেম্বর) স্বেচ্ছায় অবসর নিতে বাধ্য করেন।
সূত্র মতে, ২০১৮ সালে মেয়াদ উত্তীর্ণ হলেও ২০২১ সাল পর্যন্ত ম্যানেজিং কমিটি ছাড়াই বিদ্যালয় পরিচালনা করেন। তিনজন শিক্ষকের উচ্চতর গ্রেড (টাইম স্কেল) প্রাপ্য হলেও মোটা অঙ্কের টাকা দেওয়ায় দেননি প্রধান শিক্ষক। বাংলার শিক্ষক সোহানা বারী এবং ইসলাম ধর্মের শিক্ষক মামুনুর রশীদকে বিএড কোর্সে ভর্তির অনুমতি দেয়া হয়নি। বিদ্যালয়ের ম্যানেজিং কমিটির শিক্ষক প্রতিনিধিও প্রধান শিক্ষক নিজের ইচ্ছায় মনোয়ন দেন। শিক্ষকদের থেকে ধার করা টাকায় বিদ্যালয়ের জিনিসপত্র কেনেন, আবার ভাউচার করেন। তবে কখনো টাকা ফেরত না দিয়ে আত্মসাৎ করেন।
সূত্র জানায়, প্রধান শিক্ষকের বিরুদ্ধে উত্থাপিত ১৬টি অভিযোগ তিনভাগে (আর্থিক, প্রশাসনিক ও আচরণগত) ভাগ করা যায়। সকল অভিযোগ সাক্ষ্য প্রমাণ ও নথি পর্যালোচনায় সত্য প্রমাণিত হয়। একজন সহকারী শিক্ষক বলেন, বিদ্যালয়ের শিক্ষার্থী চারশ।
টিউশন ফি ও খাতে বার্ষিক আয় ৩লাখ টাকা। যা ব্যাংকের পরিবর্তে সরাসরি ব্যয় করা হয়। ম্যানেজিং কমিটির সভাপতি স্থানীয় আওয়ামী লীগ নেতা নজরুল ইসলামের সাথে চেষ্টা করেও যোগাযোগ সম্ভব হয়নি। বর্তমান এডহক কমিটির সভাপতি রিয়াজুল ইসলামও ফোন ধরেননি।
অভিযোগের বিষয়ে প্রশ্ন করা হলে প্রধান শিক্ষক মো. আলাউদ্দিন সব বানোয়াট বলে দাবি করেন। তিনি বলেন, ‘এর আগে দুদক তদন্ত করেছিল, প্রমাণিত হয়নি।’ পুকুর লিজের অনিয়মের বিষয়ে তিনি বলেন, ‘যৌথ পুকুর থাকায় আলাদা করে লিজ দেয়ার সুযোগ নেই।’ বিদ্যালয়ের অর্থ ব্যাংকে না রাখার কোনো সদুত্তর দেননি প্রধান শিক্ষক।
মেসেঞ্জার/আনিসুজ্জামান/তারেক