ঢাকা,  শনিবার
২১ ডিসেম্বর ২০২৪

The Daily Messenger

গণশিক্ষার আড়ালে ওলামালীগ নেতার কোটি টাকার বাণিজ্য

বাঁশখালী (চট্টগ্রাম) প্রতিনিধি 

প্রকাশিত: ১৩:৫৩, ১৩ অক্টোবর ২০২৪

গণশিক্ষার আড়ালে ওলামালীগ নেতার কোটি টাকার বাণিজ্য

ছবি: মেসেঞ্জার

বাঁশখালীতে ইসলামিক ফাউন্ডেশনের গণশিক্ষা কেন্দ্রের আড়ালে বাঁশখালী উপজেলা ওলামা লীগের সভাপতি মৌলভী আকতার হোসাইনের কোটি টাকার বাণিজ্যের অভিযোগ পাওয়া গেছে। নামে-বেনামে ভূয়া কেন্দ্র দেখিয়ে ওলামা লীগ নেতা মডেল কেয়ার টেকার মৌলভী আকতার হোসাইন কোটি টাকা বাণিজ্যের পাশাপাশি ভূয়া কেন্দ্র দেখিয়ে এমনকি এক পরিবারে একাধিক কেন্দ্র দেখিয়ে কমিশন আদায় করতেন মৌলভী আকতার। তাছাড়া কোন মসজিদ কিংবা কেন্দ্র না পড়িয়েও আওয়ামী লীগ, যুবলীগ, ছাত্রলীগ এবং ওলামালীগের নেতাকর্মীদের দেয়া হয়েছে এই কেন্দ্রে।

আগে যারা বিএনপি-জামায়াত কিংবা হেফাজত সমর্থক ছিল তাদের বিগত ১৬ বছরে বাদ দেয়া হয়েছে সুকৌশলে। বিগত ১৬ বছরে ওলামালীগের এই নেতা এখন কোটিপতি। গড়ে তুলেছেন নামে-বেনামে সম্পদ। দখল করেছেন সরকারি পাহাড়। যা নিয়ে ইসলামিক ফাউন্ডেশনসহ সরকারের বিভিন্ন দফতরে অভিযোগ দিলেও তার বিরুদ্ধে কোন ধরনের ব্যবস্থা নেওয়া হয়নি।

স্থানীয়রা জানান, সাবেক সংসদ সদস্য মোস্তাফিজের প্রভাব দেখিয়ে মৌলভী আকতার হোসাইন গণশিক্ষা প্রকল্পের উপজেলা মডেল কেয়ার পদ ভাগিয়ে নেন। মডেল কেয়ার টেকার ও ওলামালীগের সভাপতি পরিচয় দেয়া মৌলভী আকতার এর আগে কওমী মাদরাসায় ৫ হাজার টাকা বেতনে চাকরি করলেও আওয়ামী লীগের প্রভাবপত্তি ব্যবহার করে তাকে আর পেছনে ফিরে তাকাতে হয়নি। মসজিদের ইমামদের জিম্মি করে গণশিক্ষার শিক্ষকদের ব্যবহার করে রাতারাতি বনে যান নেতা।

আওয়ামী লীগ ও ওলামালীগের মিছিল সমাবেশে ব্যবহার করত আলেম ওলামাদের। কেউ আওয়ামী লীগের মিছিল সমাবেশে যোগদানে অনিহা দেখালে কেটে দেওয়া হতো গণশিক্ষা কেন্দ্র। আবার অনেককে জামায়াত-শিবির হেফাজত ট্যাগ লাগিয়ে জড়িয়ে দিতেন মামলায়। কেন্দ্র দেয়ার নামে এবং কেন্দ্র কেটে দেয়ার ভয় দেখিয়ে নিরীহ আলেম-ওলামাদের কাছ থেকে আদায় করতেন টাকা। গণশিক্ষা ওলামালীগ ব্যবসার পাশাপাশি তার ছিল টিসিবি পণ্যের ডিলারশীপ। মোস্তাফিজের প্রভাব দেখিয়ে খেটে খাওয়া মানুষের সেই পণ্য বিক্রি করে দিতেন কালো বাজারে।

অভিযোগ আছে, মৌলভী আকতার সবচেয়ে বড় কাণ্ডটি ঘটান বাঁশখালী পৌরসভা নির্বাচনে তার ভাই আজগরকে কাউন্সিলর প্রার্থী করে। নির্বাচনে বিএনপি সমর্থিত সাবেক কাউন্সিলর শামসুল ইসলাম হেলাল এক হাজারের বেশি ভোট পেলেও মাত্র একশো ভোট পাওয়া তার ভাই আজগরকে বিজয়ী ঘোষণা করে চমক দেখান এই মৌলভী। ক্ষমতার প্রভাব দেখিয়ে ধরাকে সরাজ্ঞান করে লোকজনকে মামলা মোকদ্দমায় জড়ানোর পাশাপাশি হয়রানি করেন প্রতিনিয়ত। এলাকার ওয়াজ মাহফিল ও ইসলামি সম্মেলন বন্ধ করে দিতে কৌশলে। তাকে অতিথি না করলেই বন্ধ হয়ে যেত মাহফিল। এসব করে জিরো থেকে হিরো বনে যান সাবেক কওমি মাদরাসা শিক্ষক মৌলভী আকতার।

তাছাড়া তার সহযোগী সহকারী কেয়ার টেকার ওলামালীগ নেতা মনির রাব্বানী ও মৌলভী মাহমুদ উল্লাহসহ একাধিক ব্যক্তির নামে রয়েছে একাধিক কেন্দ্র। জীবনে একদিনও কেন্দ্র না পড়িয়ে শুধুই আকতার ও এমপির সোহবতে এদের নামে কেন্দ্র দেয়া হয়। মনির রব্বানীর স্ত্রী ও বোনের নামেও আছে গণশিক্ষা কেন্দ্র। একইভাবে মৌলভী আকতারের স্ত্রী বোনের নামেও গণশিক্ষা কেন্দ্র দেয়া হয়। তার ভাগিনার নামে আছে টিসিবির ডিলারশিপ।

স্থানীয় নুরুল আলম, জমির উদ্দীন ও কলিম উল্লাহ জানান, আওয়ামী লীগ সরকার ক্ষমতায় আসার পর থেকেই বেপরোয়া হয়ে উঠে মৌলভী আকতার। নিজেকে মুক্তিযোদ্ধার ছেলে পরিচয় দিয়ে সাবেক এমপি মোস্তাফিজের নজর কাড়েন। মৌলভী দিদার, মৌলভী মনির রব্বানী, মৌলভী মোহাম্মদ উল্লাহ ও ছাবের আহমদসহ কয়েকজনকে নিয়ে নিজে নিজে ওলামালীগের সভাপতি পরিচয় দেন। বিভিন্ন সমাবেশে যোগ দেন। এরপর থেকেই ভাগ্য বদলে যায় আকতারের। দখল করেন বনবিভাগের পাহাড়। লোকজন দিয়ে রাতে নিধন করেন বৃক্ষ। এমনকি পাহাড় কেটে ডেম্পার দিয়ে মাটি কাটা ও মাটি বিক্রির কারণে লোকজন তাকে ‘ডেম্পার মৌলভী’ নামেও ডাকেন।

মৌলভী হামিদ উল্লাহ জানান, মৌলভী আকতার নিজেকে আলেম পরিচয় দিলেও সব সময় আলেম ওলামাদের স্বার্থ বিরোধী কাজে অগ্রগামী থাকতেন। করোনাকালীন সময়ে লাশ দাফন কাজে সরকারী বরাদ্দ থাকলেও ওই টাকা একাই আত্মসাৎ করেন মৌলভী আকতার। তাছাড়া বাঁশখালীতে সরকারী যাকাতের টাকাও কাউকে না দিয়ে ভোগ করেন এই ওলামালীগ নেতা।

ইসলামিক ফাউন্ডেশন বাঁশখালী উপজেলা সূত্র জানায়, বাঁশখালীতে আগে ২শতাধিক গণশিক্ষা কেন্দ্র থাকলেও বর্তমানে কেন্দ্র সংখ্যা ১৫৩ টি। বিগত জানুয়ারিতে এমপি মোস্তাফিজের পতনের পর ভূয়া কেন্দ্র ও তার ঘুষ বাণিজ্য নিয়ে ধরপাকড় শুরু হলে অর্ধ শতকেরও বেশি গণশিক্ষা কেন্দ্র বন্ধ হয়ে যায়। তাছাড়া মসজিদ নির্মাণেও এই ওলামালীগ নেতার বাণিজ্যের অভিযোগ রয়েছে। ঠিকাদারের সাথে যোগসাজশে নিম্নমানের কাজ চলছে বাঁশখালীর মডেল মসজিদ নির্মাণ কাজে।

গণশিক্ষা কেন্দ্রের শিক্ষকরা জানান, এখনো ২০ থেকে ২৫টি ভূয়া কেন্দ্র আছে বাঁশখালীতে। সঠিক তদন্ত করলে ইসলামিক ফাউন্ডেশনের আরও বহু অনিয়ম দুর্নীতি বেরিয়ে আসবে বলে জানান সংশ্লিষ্টরা। এদিকে সরকার পরিবর্তনের পর বি়ভিন্ন অভিযোগ ও অর্ধ ডজনের বেশি মামলার আসামি হয়ে মৌলভী আকতার আত্মগোপনে চলে গেছে। তার আর জনসমক্ষে দেখা যায়নি। মোবাইলও ব্যবহার করছেন না। তবে এখনো ইসলামিক ফাউন্ডেশন থেকে বেতন তুলছেন বলে জানা গেছে।

এই বিষয়ে উপজেলা নির্বাহী অফিসার জেসমিন আক্তার জানান, ওলামালীগ নেতা মৌলভী আকতারের নানা দুর্নীতি অনিয়ম শুনেছি। তার বিরুদ্ধে ইতিমধ্যে একাধিক মামলাও হয়েছে। তার বিষয়ে ইসলামিক ফাউন্ডেশনকে সিদ্ধান্ত নিতে জানানো হবে।

মেসেঞ্জার/বেলাল/দিশা