ঢাকা,  বুধবার
১৬ অক্টোবর ২০২৪

The Daily Messenger

যে মেলায় মেলে জীবন সঙ্গীনী

দিনাজপুর প্রতিনিধি 

প্রকাশিত: ১৯:৫৪, ১৫ অক্টোবর ২০২৪

আপডেট: ২০:২৩, ১৫ অক্টোবর ২০২৪

যে মেলায় মেলে জীবন সঙ্গীনী

ছবি : মেসেঞ্জার

ক্ষুদ্র নৃগোষ্ঠীর তরুণীরা কপালে দিয়েছে টিপ। সেই সাথে ঠোটে লিপস্টিক, চুলের বেনিতে শোভা পাচ্ছে ফুলের মালা। তাদের সাথে পিছিয়ে নেই তরুণরাও। সেজে-গুজে পুরো মাঠ জুড়ে তরুণ-তরুণীরা খুজছেন নিজের জীবন সঙ্গীনীকে। আর এরই মধ্যে যদি জীবন সঙ্গীনী পছন্দ হয়ে যায় তাহলে পরিবারিক ভাবে ধুমধামে দেয়া হয় বিয়ে।

এমনকি বিয়ের জন্য যাবতীয় জিনিসপত্রের পসরাও সাজিয়ে রেখে বিক্রেতারা। এমনই ব্যতিক্রমধর্মী মেলার দেখা মিলল দিনাজপুরের বীরগঞ্জ উপজেলায়। প্রায় দুই শত বছর ধরে উপজেলার গোলাপগঞ্জ উচ্চ বিদ্যালয় মাঠে আদিবাসীদের এই মিলন মেলাটি অনুষ্ঠিত হয়ে আসছে। যা এক সময় বৌ মেলা নামে পরিচিত ছিল। 

মঙ্গলবার (১৫ অক্টোবর) সকাল থেকে বিদ্যালয়ে দিনাজপুর, ঠাকুরগাঁও, পঞ্চগড়, নীলফামারীসহ আশপাশের জেলার ক্ষুদ্র নৃগোষ্ঠীরা আসতে শুরু করেন। সময় যত বেড়ে যায় ততই বেড়ে যায় লোকজনের সমাগম। দিনব্যাপী এই ব্যতিক্রমধর্মী মেলায় কয়েক হাজার ক্ষুদ্র নৃগোষ্ঠী।

প্রতি বছর দশমীর পরদিন কোনো ধরনের প্রচার-প্রচারণা ছাড়াই হাজার হাজার মানুষ মেলায় উপস্থিত হন। মেলায় আশপাশের জেলার বিভিন্ন গ্রামের বউ, শাশুড়ি, ননদ, জা ও ঝিরা একত্রিত হন। মেলা থেকে ক্ষুদ্র নৃগোষ্ঠী তরুণ-তরুণীরা জীবন সঙ্গী বেছে নেন। পরে পরিবারিকভাবে দুই পরিবারের মধ্যে আলোচনার ভিত্তিতে বিয়ে হয়। 

প্রায় দুই শত বছর ধরে বীরগঞ্জের গোলাপগঞ্জে উপজেলা আদিবাসী সমাজ উন্নয়ন সমিতির আয়োজনে ক্ষুদ্রনৃগোষ্ঠীদের এই মিলন মেলাটি অনুষ্ঠিত হয়ে আসছে। যা এক সময় বৌ মেলা নামে পরিচিত ছিল। পৌরানিক কাহিনী রয়েছে, এই মেলায় এসে ক্ষুদ্র নৃগোষ্ঠী তরুণ-তরুলীরা তাদের পছন্দের মানুষকে খুজে পরিবারের কাছে তা জানাতেন।

পরে পরিবার থেকে দুই পরিবারের মধ্যে আলোচনার মাধ্যমে বিয়ে সম্পন্ন করা হতো। যারা এই মেলায় নিজেরা জীবনসঙ্গী পছন্দ করতো পরবর্তী বছর মেলায় তাদের নাম পরিচয় তুলে ধরা হতো। এখনও এই মেলায় অনেকে পরিবারের সম্মতিতে পছন্দেও পাত্র পাত্রিকে নিয়ে এসে বিয়ে দিয়ে থাকেন। মেলাটি শারদীয় দুর্গোৎসবের বিজয়া দশমীর পরের দিন অনুষ্ঠিত হয়। 

প্রায় দুইশত বছরের ঐতিহ্যবাহী ব্যতিক্রমী এই মেলায় এসে জীবন সঙ্গীনী খুজতে পেরে খুশি তরুণ-তরুণী ও তাদের পরিবার। পাশাপাশি এ ধরনের মেলার ভবিষ্যতে চালুর করার অনুরোধ তাদের। 

কাহারোল উপজেলার কামোর গ্রাম থেকে নিজের মেয়ের জন্য পাত্র খুজতে এসেছেন রমেশ চন্দ্র রায়। তিনি বলেন, “এই মেলার বিষয়ে অনেকদিন ধরে শুনছি। কিন্তু কোন দিন আসা হয়নি। এবার পরিবারসহ আসছি। মেয়েকেও নিয়ে আসছি। যদি এখানে ছেলে পছন্দ হয় তাহলে কথা বলব। যেহেতু মেয়েকে বিয়েতো দিতে হবে। মেলাটা দেখে খুব ভালো লাগলো।” 

ঠাকুরগাঁও সদর উপজেলা থেকে মেলায় ঘুরতে এসেছেন ১৯ বছর বয়সী তরুণী মনিকা হাসদা। তিনি বলেন, “আমরা পুরো পরিবার মেলায় আসছি। মেলার বিষয়ে অনেকের মুখে অনেক কথা শুনেছি। কিন্তু আজকে বাস্তবে দেখা হলো। খুব ভালো লাগলো।” 

দিনাজপুর সদর উপজেলার শেখপুরা ইউনিয়নের পারগাঁও গ্রাম থেকে ঘুরতে এসেছেন তরুণী ভাদুরি টুডু। তিনি বলেন, “এখানে অনেক রকমের মানুষ আসে। অনেক বছর ধরে এখানে আসা হয়। এখানে আসলে অনেক আত্মীয়-স্বজনেরও দেখা পাওয়া যায়। তাই এখানে প্রতি বছর আসি।” 

বীরগঞ্জ আদিবাসী সমাজ উন্নয়ন সমিতির কোষাধ্যক্ষ জুলি মুর্মু বলেন, “আমাদের সংগঠনের পক্ষ থেকে মেলা উদ্যাপন করা হয়। সংগঠনের নেতা পরিবর্তন হলেও এই মেলা নিয়মিত উদ্যাপন করা হয়ে আসছে। এই মেলাটি দুর্গাপূজা বিসর্জনের পর অনুষ্ঠিত হয়। অনেকে এই মেলাটিকে বাসি মেলা হিসেবে চেনে। এটি উত্তরবঙ্গের আদিবাসীদের সবচেয়ে বড় মিলন মেলা।” 

বীরগঞ্জ আদিবাসী সমাজ উন্নয়ন সমিতির সাধারণ সম্পাদক কমলা কান্ত হাসদা বলেন, “এই মেলা প্রায় ২০০ বছর ধরে অনুষ্ঠিত হয়ে আসছে। আমরা দাদা-দাদি, নানা-নানির কাছ থেকে এই মেলার বিষয়ে শুনে আসছি। এটি আগে মিলন মেলা নামে পরিচিত ছিল না।

আগে দুর্গাপূজার বিজয়া দশমীর পরের দিন অনুষ্ঠিত হয়ে আসছে। আমাদের আদিবাসী ও সাওতাল সম্প্রদায়ের মানুষরা এই মেলার অপেক্ষায় থাকে। ২০ বছর আগে এই মেলার নাম বউ মেলা থেকে মিলন মেলা করা হয়। বিভিন্ন জেলার পাশাপাশি পাশ্ববর্তী ভারত থেকেও অনেকে মেলায় আসে। এক প্রকার মিলন মেলায় পরিণত হয়। তাই মেলাটির নাম মিলন মেলা হিসেবে রাখা হয়েছে। মেলায় তরুণ-তরুণীরা তাদের জীবন সঙ্গীনী পছন্দ করে। পরে তারা পারিবারিকভাবে বিয়ে করে।”

মেসেঞ্জার/কুরবান/তারেক