বৈষম্য বিরোধী আন্দোলনে গুলিবিদ্ধ রংপুর মহানগর বিএনপির নেতা মামুন অর রশিদ মামুনের করা মামলা ও তার একটি ভিডিও নিয়ে ধুম্রজাল তৈরি হয়েছে রংপুরে। যদিও নিজের ভাইরাল হওয়া ভিডিওকে তিনি মহানগর বিএনপির আরেক নেতা কাওছার জামান বাবলার নিচু রাজনৈতিক উদ্দেশ্য চরিতার্ থ করার ষড়যন্ত্র হিসেবে উল্লেখ করেছেন। এ ঘটনার জেরে বাবলা ও মহানগর আহবায়ক সামুসুজ্জামান সামু পরস্পর দোষারোপ করেছেন। ঘটনাটি এখন টপ অব দ্যা রংপুর।
১৯ জুলাই বৈষম্য বিরোধী আন্দোলনের সময় রংপুর মহানগরীর সিটি বাজার এলাকায় গুলিবিদ্ধ হয়েছিলেন রংপুর মহানগর বিএনপির ২৯ নং ওয়ার্ড যুগ্ম সাধারণ সম্পাদক মামুনুর রশিদ। তিনি বাদি হয়ে গত ১৩ নভেম্বর এক সাংবাদিকসহ ১৮১ জনের নাম উল্লেখ করে কোতয়ালী থানায় একটি মামলা করেন । এতে অজ্ঞাত ২০০ থেকে ৩০০ জনকেও আসামী করা হয়। এই মামলার পর মহানগর বিএনপির সদস্য কাওছার জামান বাবলার বাড়িতে মামুনকে ডেকে নিয়ে জিজ্ঞাসাবাদের মতো করে ধারণকৃত একটি ভিডিও ফেসবুকে ছড়িয়ে পড়ে। তাতে মামলার আসামির সংখ্যার ব্যপারে মামুনকে মহানগর আহবায়ক সামসুজ্জামান সামু জড়িত বলে প্রশ্ন করতে দেখা যায়। যদিও মামুন সেই প্রশ্নের সরাসরি কোন উত্তর দেয় নি।
২ মিনিট ২৭ সেকেন্ডর ভাইরাল হওয়া ভিডিওতে মহানগর বিএনপির কাওছার জামান বাবলাকে বলতে শোনা যায়, ‘ তুমি ১৮১ জনের নামে মামলা দিছে। তাতে নীলফামারীর লোক আছে। বিভিন্ন থানার আসামি আছে। নিজের লোক আছে। রাজনৈতিক লোক আছে। অনেক নিরীহ মানুষ আছে। তুমি এগুলোকে কিভাবে করলা। তুমি কেন এটা করলো বলো।’
প্রতিত্তোরে মামুনকে বলতে শোনা যায়, ‘ আমি এসব নাম দিয়েছি। যারা ফ্যাসিবাদ এবং আওয়ামীলীগের সন্ত্রাসী। যুবলীগের সন্ত্রাসী। আমি মূলত তাদের নাম দিয়েছি। তখন বাবলা তাকে বলেন, ‘ তুমি কয়জনের নাম দিছিলা।’ তখন মামুনকে বলতে শোনা যায়, ‘ আমি ২৫ জনের নাম দিয়েছিলাম।’ তখন বাবলা আবার বলেন, ‘ সেখানে ১৮১ জন কেন হলো।’ উত্তরে বলেন, ‘ আমি নামগুলো এখানে যিনি বিএনপির অথোরাইজড। তাকে দিয়েছিলাম। বাবলা বলেন, ‘ নামটা বলো কোন অসুবিধা নাই।’ মামুন বলেন, ‘ আহবায়ক’। তখন বাবলা বলেন, ‘মহানগর আহবায়ক সামু’ । তখন মামুন চুপ থাকেন। বাবলা আবার বলেন, ‘ সে তোমাকে কি বলছে’ । মামুন বলেন, ‘ আড়াইমাস আগে আমি নাম দিয়েছিলাম। যখন এরমধ্যে মামলা হলো না। তখন আমি বুঝে নিয়েছিলাম যে এই মামলাটা আর হবে না। আমি ওনাকে কয়েকবার কল করেছি। মামলাটা কেন হচ্ছে না। বাবলা বলেন, সামুকে কল করেছো। মামুন বলেন, ‘জি’ । কল করেছি। আমাকে বলেছে ওয়েট করো ওয়েট করো। আমি ওয়েট করতেছি। তারপর দেখি ১০ তারিখ কি তারও আগে দেখি মামলাটা লেখা হয়েছে। তখন সই করতে বলে। আমি মামলাটা দেখে বলি এটাতে অসঙ্গতি আছে। এতগুলো নাম কেন। তখন তারা বলে এগুলা ঠিক হয়ে যাবে। এই।’
আবারও বাবলাকে বলতে শোনা যায়, মামলা তোমার ইচ্ছাতে করো নাই এতোগুলা নাম। তুমি ২৫ টা নাম দিয়েছিলা। নীলফামারী বা বাইরের কোন নাম নাই ‘ তখন মামুনকে বলতে শোনা যায়, আমি চেয়েছি যে আমার লোকাল রংপুর মহানগরের আওয়ামীলীগের যারা লিস্টেট পদধারী, আওয়ামীলীগ, স্বেচ্ছাসেবকলীগ, যুবলীগ যারা আমাদের ভাইদেরকে আহত করেছে। নির্যাতিত করেছি। তাদের নাম গুলাই ইনক্লুড করতে চেয়েছি।’ তখন বাবলাকে বলতে শোনা যায় ‘ মোট ২৫ জন সেখানে ১৮১ জনের নামে মামলা হয়েছে।’
অনুসন্ধানে নিশ্চিত হওয়া গেছে ভিডিওটি কাওছার জামান বাবলার মাহিগঞ্জের বাড়ির ড্রয়িং রুমে করা হয়েছে।
মামুনের এইভিডিও নিয়ে নেতাকর্মী ও নগরবাসির মধ্যে ধুম্রজাল তৈরি হয়। মঙ্গলবার বিকেলে ভিডিওতে দলের ক্ষতি হয়েছে দাবি করে ভিডিও ধারণের প্রেক্ষাপট তুলে ধরে সংবাদ সম্মেলন করেন মামুন। এসময় মামুন বলেন, জনাব কাওছার জামান বাবলা যেটি করেছে। সেটি আমার বিএনপির ভাবমূর্তি নস্ট করেছে। আমরা দীর্ঘ ১৭ বছর থেকে রাজপথে যে আন্দোলন করে আসছি। উনি নিমিষেই তা ধুলিস্যাত করে দিয়েছেন। এরকমন রাজনৈতিক মনমাসিকতা এজকন লিডারের কাছে কাম্য নয়। এটা কখনও আশা করিনি। ওনার অবস্থান কোথায় নগরীর প্রত্যেকটি নেতাকর্মীই জানে।
মামুন বলেন, ‘ওনি আমাকে দিয়ে একটা গেম খেলতে চেয়েছিলেন। সেই গেমের নায়ম আমাকে বানাইছে। কিন্তু আমি তো এটা চাই নি। আমি চেয়েছি যারা অপরাধি তাদের বিচার করার জন্য। আমি তো চাই নি। ওনি এই নোংরা খেলা খেলে আমার শহীদ জিয়ার আদর্শে গড়া দল বিএনপিকে কলংকিত করেছে। উনি আমার দলের বিরাট ক্ষতি করেছেন।’
মামুন বলেন, ‘বাবলা আমাকে তার বাড়িতে ডেকে নেন। এক পর্যায়ে তিনি এই মামলাটার কথা বলেন। যেটা আমি গত ১৩ নভেম্বর একটি মামলা করেছি। ১৯ জুলাই আমি গুলিবিদ্ধ হয়েছিলাম। সেকারণে মামলাটি করেছি। উনি(বাবলা) আমাকে এই মামলাটার ব্যপারে জিজ্ঞাসাবাদ করতেছিল। এক পর্যায়ে উনি কিছু আওয়ামীলীগের নেতাকর্মীদের নাম প্রত্যাহার করে নেয়ার কথা বলেছেন, বলার পরে উনি (বাবলা) আমাকে দিয়ে আমার মহানগরের আহবায়ক সামুসুজ্জামান সামু এই মামলাটা করেছে, সবকিছু সহযোগিতা করেছে উনি (সামু) করাইছে এরকম বলার জন্য আমাকে প্রেসার দিতেছিল। তো আমি ওনার কথায় ককোন কিছুই বলিনি। উনি (বাবলা) আমাকে এক পর্যায়ে ফোর্স করতেছিল। যে মামলার সাথে সামসুজ্জামান সামু জড়িত কিনা। তখন আমি বলছি না-উনি(সামু) আমাকে করায় নি।’
সংবাদিকের নামে মামলার ব্যপারে মামুন বলেন, ‘এ ধরণের মামলায় অনেক অসঙ্গতি থাকে। সাংবাদিকসহ নিরপরাধ কেউ এর সাথে জড়িত থাকলে তাদের নাম প্রত্যাহার করে নেয়া হবে। ‘
মামুন বলেন, ‘ গোপনে বাবলা সাহেব ওই ভিডিও ধারণ করেছে এবং খন্ডিত অংশ ফেসবুকে ছেড়ে দিয়ে আমার ব্যক্তিস্বাধীনতাকে খর্ব করেছে। আমার প্রাইভেসি নস্ট করেছে। এজন্য আমি তার বিরুদ্ধে আইনগত ব্যবস্থা নিবো।’ এদিকে ভিডিওটি ভাইরাল হওয়ায় বিষয়টি এখন টক অব দ্যা রংপুর। পরিস্থিতি ব্যাখ্যা করতে সংবাদ সম্মেলন করেন আলোচনায় আসা দুই নেতা।
মঙ্গলবার ( ২০ নভেম্বর) রংপুর সুমি কমিউনিটি সেন্টারে সংবাদ সম্মেলন মহানগর বিএনপির সদস্য কাওছার জামান বাবলা বলেন, ‘ বিএনপির ভাবমূর্তি নস্ট তো আমি করতেছি না। আমি সত্য ঘটনার প্রতিবাদ করেছি। সেটা হচ্ছে আমার অপরাধ। আমাদের দেশনায়ক তারেক রহমানের নির্দেশ আছে কেউ যেন মিথ্যা মামলার শিকার না হয়। আমি তারেক রহমানের কাছে আহবান জানাচ্ছি। আপনি ইনকয়ারি করেন। মাহিগঞ্জে মামুনের বাসা। নীলফামারীর লোক কি মামুন চেনে। তাদের নামে কেন মামলা। আরও বিভিন্ন জেলার লোক আছে। মামুন তো তাদের চেনার কথা না। মামুন যেটা তা ভিডিও ক্লিপে বলেছে সে ২৫ জনের নাম দিয়েছিল। সেখানে ১৮১ জনের নাম করা হয়েছে। এবং সে বলেছে রাজনৈতিক মামলাগুলো এভাবে হয়। সামু বলেছে যে এগুলা ঠিক করে নিবো। আমি সত্যের জন্য ফাইট করতেছি। আমার প্রশ্ন হলো ত্যাগ করলাম আমরা জেল খাটলাম আমরা, পয়সা খরচ করলাম আমরা। আমি ক্ষতির শিকার হলাম নাকি সামু শিকার হলো। সামুর কি পয়সার ক্ষতি হয়েছে সেটা বলুক সামু। আর আমার কথা। আমি কিভাবে ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছি। ব্যবসা বাণিজ্য সব ধংস করেছি। আমি যদি বিএনপির রাজনীতি করতে না যেতাম, নিরপেক্ষ লোক থাকতাম। তাহলে তাহলে হাজার হাজার কোটি টাকা আমার লিক্যুইড ক্যাশ থাকতো। কারণ আমি ব্যবসায়িক লোক।’
ব্যক্তিগত কথোপোকথন গোপনে ভিডিও করে তা ফেসবুকে ছড়িয়েদলের ভাবমূতি নস্ট করে নিম্মমানের রাজনৈতিক রুচির পরিচয় দিয়েছেন সংবাদ সম্মেলনে মামুনের এই দাবি প্রসঙ্গে বাবলা বলেছেন, ‘মামুনকে জোড় করে তুলে নিয়ে গিয়ে সামুর বাসায় সংবাদ সম্মেলন করানো হয়েছে। লিখে দেয়া বক্তব্য পাঠ করেছে। এ বিষয়ে আমি চারদিন আগে থানায় সাধারণ ডায়েরি করেছিলাম।’
বিষয়টি নিয়ে মামুনের সাথে যোগাযোগ করা হলে তিনি জানান, ‘ আমাকে কেউ ধরে নিয়ে যায় নি। আমি নিজেই আমার আহবায়কের বাড়িতে গেছি। যেহেতু আমি মিডিয়ার সব বিষয় জানি না। সেকারণে আমি তার বাড়িতে সংবাদ সম্মেলন করেছি। শুধু লিখিত বক্তব্যই নই। আমি প্রশ্নের উত্তরও দিয়েছি। আমি এখন আমার বাড়িতে।‘
এ ব্যপারে সংবাদ সম্মেলন করেন রংপুর মহানগর বিএনপির আহবায়ক সামসুজ্জামান সামু। তিনি বলেন, ‘ বিএনপির ভিতরে ঘামটি মেরে থাকা একটি চক্র জনসম্মুখে দলের ভাবমূর্তি নস্ট করে ফ্যাসিস্ট আওয়ামী লীগের এজেন্ডা বাস্তবায়নের জন্য তৎপর হয়ে উঠেছে। তারা পতিত স্বৈরাচার আওয়ামী দোসরদের পরিকল্পনা অনুযায়ী কাজ করছে। এর অংশ হিসেবে বিভিন্ন জনকে মিথ্যা মামলায় জড়িত করে বিএনপির দায়িত্বশীল নেতাকর্মীদের নামে তা চালিয়ে দেয়ার কুটকৌশল করছে। এই মহলটি দলীয় পদ-পদবীর নাম ভাঙ্গিয়ে বিভিন্ন ভাবে সুযোগ সুবিধা গ্রহণ করছে। কিন্তু তারা বিগত খুনি হাসিনা হঠাও আন্দোলনে কোন মিছিল-মিটিংয়ে অংশ নেয়নি। বরং তারা আন্দোলনকে ব্যাহত করতে নানা প্রকার প্রপাগান্ডা করেছে।
সামু বলেন, ছাত্র-জনতার গণঅভুত্থানে ফ্যাসিস্ট খুনি সরকারের পতন হলে ৫ আগস্টের পর থেকে এদের কেউ কেউ হিন্দু সম্প্রদায়ের বাড়িঘর-জমিজমা দখল করেছে। নানা অপকর্ম করছে। মানুষজনকে ভয়ভীতি দেখাচ্ছে। এর বিরুদ্ধে প্রতিরোধ গড়ে তোলায় তারা আমার ও মহানগর বিএনপির বিরুদ্ধে মিথ্যা অপবাদ দিয়ে কলংকিত করার চেস্টা করছে। এবং সেটি মিডিয়ায় কর্মরত কিছু আওয়ামী দোসরদের মাধ্যমে অপপ্রচার করছে। যা কোনভাবেই সঠিক নয়।
সামু বলেন, ‘ একটি মামলা থেকে আওয়ামীলীগ নেতাকর্মীদের বাঁচানোর জন্য নামধারী বিএনপি নেতা কাওছার জামান বাবলা বাদিকে দিয়ে আমার বিরুদ্ধে মিথ্যা তথ্যের ভিত্তিতে অপ্রপ্রচার ও গণমাধ্যমে সংবাদ পরিবেশেন করিয়েছেন। তিনিসহ দুই নেতার বিরুদ্ধে সাংগঠনিক ব্যবস্থা নিতে ভারপ্রাপ্ত চেয়ারম্যান তারেক রহমানের কাছে লিখিত আবেদন করা হবে। একই সাথে এসব অপ প্রচারের তীব্র প্রতিবাদ ও নিন্দা জানাচিছ।’
মামুনকে ধরে নিয়ে যাওয়ার ব্যাপারে সামু বলেন, ‘ কথিত এই বিএনপি নেতা মিথ্যার ওপর বসবাস করেন। মামুনকে কেউ ধরে নিয়ে আসেনি। বিবেকের তাড়নায় বিএনপির সুনাম ক্ষুন্ন হচ্ছে সেকারণে তিনি নিজেই এসে প্রেস ব্রিফিং করার পর চলে গেছেন।’
মেসেঞ্জার/মাজহারুল/এমএএন