ছবি: মেসেঞ্জার
ইউনিয়ন বিএনপির সভাপতি ও ইউনিয়ন পরিষদের চেয়ারম্যানের নেতৃত্বে গড়ে উঠেছে ভূমিদস্যু চক্র। বেহাত হয়ে যাচ্ছে একটি গ্রামের প্রায় এক হাজার কৃষকের আবাদি জমি। অভিযোগ উঠেছে টেপাখড়িবাড়ী ইউনিয়ন পরিষদের চেয়ারম্যান রবিউল ইসলাম সাহিন ও ইউনিয়ন বিএনপি সভাপতি ইয়াসিন আলী বসুনিয়ার বিরুদ্ধে উত্তর খড়িবাড়ী গ্রামের মৃত আব্দুর রহিম মন্ডলের ছেলে আবুল কাশেমসহ শতাধিক কৃষক উপজেলা প্রশাসনের কাছে এ অভিযোগ দায়ের করেন।
সরেজমিনে, নুর ইসলাম নামের এক কৃষকের জমিতে চাষাবাদের কাজ করতে দেখা যায় টেপাখড়িবাড়ী ইউনিয়ন ৭ নম্বর ওয়ার্ড বিএনপির সভাপতি ফরিদুল ইসলামকে। তিনি জানান, বোর্ডের কাছে তিন একর ও ইয়াসিন স্যারের ছোটভাই আইয়ুবের কাছে তিন একর জমি লিজ নিছি। প্রতি একর জমি ২০ হাজার টাকা করে নিয়েছি। চর খড়িবাড়ী গ্রামের রহিজ উদ্দিন নামের এক ব্যক্তিকে জিজ্ঞাসা করলে তিনি বলেন, ১০ একর জমি আমাকে ঠিকা(লিজ) দিয়ে ২ লাখ ৩০ হাজার টাকা নেন বিএনপি নেতা আব্দুস সালাম।
এখন জমির যে মূল মালিক তারা এসে জমিতে হাল ও চাষাবাদ বন্ধ করে দিয়েছে। আব্দুস সালাম, সলেমান, সাইদুল, মিজানুর, ইয়াসিন স্যারসহ বোর্ডে ১৩৫ জন জড়িত রয়েছে। পুরো চর ঘুরে দেখা যায়, এভাবেই প্রকৃত কৃষকের জমি বিএনপি নেতাকর্মীদের মাধ্যমেই হাজার-হাজার একর জমি বেহাত হয়ে যাচ্ছে। মাঠে গেলেই দেখানো হচ্ছে ভয়ভীতি, হত্যা আর মামলার হুমকী।
তিস্তার চর ঘুরে জানা যায়, উপজেলার টেপাখড়িবাড়ী ইউনিয়নের উত্তর খড়িবাড়ী গ্রামের খাস খতিয়ান ভূক্ত, ভারতগামী হিন্দু সম্প্রদায় ও ব্যক্তি মালিকানাধীন জমিগুলো চরখড়িবাড়ী, উত্তর খড়িবাড়ী ও দক্ষিণ খড়িবাড়ী গ্রামের এক হাজার কৃষক দীর্ঘদিন যাবত চাষাবাদ করে আসছে। হাসিনা সরকার দেশ ত্যাগের পরপরেই ইউনিয়ন পরিষদের চেয়ারম্যান আওয়ামীলীগ নেতা রবিউল ইসলাম সাহিন ও ইউনিয়ন বিএনপির সভাপতি ইয়াসিন আলীর জোগসাজোসে ১৩৫ সদস্য বিশিষ্ঠ কাগজ যাচাই-বাছাই বোর্ড ও সার্চ কমিটি গঠনের মাধ্যমে নদীর বুকে ভেসে উঠা চরের ৩০০ একর জমি রাতারাতি বেদখলে নেন বিএনপি নেতাকর্মীরা। সঠিক কাগজপত্র যাচাই-বাছাই বোর্ডের কাছে দেখানো হলেও মিলছে চাষাবাদের জমি। আবার সেই জমি প্রকৃত মালিককে ছাড়াই লিজ দেওয়া হচ্ছে তাদের পছন্দের মানুষকে, হাতিয়ে নিচ্ছে লাখ লাখ টাকা।
এতে একদিকে চাষাবাদের জমি থেকে বঞ্চিত অন্যদিকে হারাতে হচ্ছে জমি লিজের টাকা। এতে দিশেহারা হয়ে পড়েছে চর গ্রামরে হাজারো কৃষক। জমির সিমানা নির্ধারণের জন্য একর প্রতি নিচ্ছে ২ হাজার টাকা। এদিকে, জমি উদ্ধারের জন্য গ্রাম আদালত, থানা পুলিশ ও উপজেলা প্রশাসনকে বিচার দিয়েও মিলছেনা কোনো সমাধান। অনেক বিএনপির নেতাকর্মীদের নিজের জমিতে উঠতে গেলেই হতে হচ্ছে আওয়ামীলীগের দোসর।
এ ঘটনায় অভিযুক্তরা হলেন, টেপাখড়িবাড়ী ইউনিয়ন বিএনপির সভাপতি ইয়াসিন আলী বসুনিয়া, চর খড়িবাড়ী গ্রামের একব্বর আলী, সাইদুল ইসলাম, সলেমান আলী, জালাল হোসেন, আব্দুস সামাদ শেখ, আমজাদ হোসেন, আয়নাল হক, আখতার হোসেন, আলেক মন্ডল, মশিয়ার রহমান,সামছুদ্দিন, সফিকুল ইসলাম, মিজানুর রহমান, আবু বক্কর, জামিদুল ইসলাম, জহির আলী, সোহেল হোসেন, মৃত আব্দুর রশিদের ছেলে ফয়জার রহমান, মৃত মজিবর রহমানের ছেলে আফজাল, মৃত জিয়া প্রামানিকের ছেলে আবিল হক, মৃত সামুর উদ্দিনের ছেলে নুরনবী, মৃত উমেদ আলীর ছেলে ছলেমান ও আব্দুর রাজ্জাক ফকিরের ছেলে তোপাজ্জল হোসেন উত্তর খড়িবাড়ী গ্রামের রহিজ উদ্দিন, রশিদুল ইসলাম, আবু বক্কর, মমিনুর রহমান, দক্ষিণ খড়িবাড়ী গ্রামের একব্বর আলীর ছেলে আনারুল ইসলাম।
চরখড়িবাড়ী গ্রামের সানোয়ার হোসনে নামের এক কৃষক বলেন, দীর্ঘদিন ধরে আড়াই বিঘা জমি চাষাবাদ করে আসছি। সেই জমি দিয়ে পরিবারে ৮ জন চালাতে হয়। বিএনপির লোকজন আমার জমিটুকুও দখলে নিয়েছে। অনেকের কাছে দৌড় ঝাঁপ করেছি কোনো সমাধান পেলাম না। আমাদের কাছে থেকে নিয়ে অন্য মানুষকে ঠিকা(লিজ) দিচ্ছে, কিন্তু আমাদের দিচ্ছে না।
চর খড়িবাড়ী গ্রামের আবু তাহের জানান, উত্তর খড়িবাড়ী মৌজা এস এ খতিয়ানে আমার দাদার নামে ৭ একর ৪৪ শতাংশ জমি আছে। সেই জমির একজন শরিক আছে তার কাছে আমার দলিল নেওয়া আছে। আমি খতিয়ান ও দলিল বোর্ডের মাঝে পেশ করি। তারা আমার খতিয়ানের জমি ফেরত দিলেও; দলিলের জমি ফেরত দেই দিচ্ছি করে দিলো না।
এখন দেখি অন্যজনের কাছে লিজ দিছে। চেয়ারম্যান- মেম্বার(ইউপি সদস্য) কাছে বিচার দিলেও কোনো প্রতিকার পাচ্ছি না। আমার দাদার জমি একোয়ারে গেছে বর্তমানের সেখানে রাস্তা নাই, সেই জমির উত্তরের আমাদের দক্ষিনের আমাদের কিন্তু বিএনপির ইয়াসিন মাস্টারের লোকজন সেখানেও হাল চাষ করেছে। এভাবে তারা পুরো চরে ত্রাস সৃষ্টি করেছে। আমার মতো আরও শতাধিক মানুষের জমি বেদখল করে নিছে এবং তারা ভূট্টা চাষ করছে। আর এই চক্রে জড়িত রয়েছে মিজানুর, একব্বার, সালাম, আমজাদ ও ওমেদ আলীর ছেলে সোলেমান।
একই গ্রামের আরেক কৃষক জহুরুল ইসলাম জানান, আমার কোনো জমি জায়গা নেই, এর আগে কাশেম মেম্বার খাস খতিয়ানের ২৫ শতাংশ জমি দিয়েছে সেই জমি দীর্ঘদিন ধরে চাষাবাদ করে আসছি। এবারে আইয়ুব, মিজানুর, সোলায়মান, সাইদুল আর আব্দুস সালাম বেদখল দেয়। কয়েকবার বোর্ডের কাছে গেলেও কোনো সমাধান না পেয়ে ইউএনও অফিসে অভিযোগ করলেও কোনো সুরাহ পাইনি।
আ. কুদ্দুস আলী নামের আরেক কৃষক জানান, জমি মাপার জন্য একর প্রতি ২ হাজার টাকা নেয়। ২ হাজার টাকা দিয়ে আমিন নিলে আমরা সারাদিনে জমির সিমানা বের করতে পারি। চরে জমির সিমানা ঠিক করতে গেলেও তাদের আমিন ছাড়া অন্যকোনো আমিন দিয়ে সিমানা ঠিক করতে দিচ্ছে না। তাদের আমিন দিয়েই করতে হবে। জমির সিমানার ক্ষেত্রেও এক ধরনের জুলুম করছে করছে তারা। ঠিকার জন্য বিঘা প্রতি ৭-১০ হাজার টাকা নিয়েচ্ছে।
টেপাখড়িবাড়ী ইউয়িন পরিষদের ১ নম্বর ওয়ার্ডে সাধারণ সদস্য আব্দুল কুদ্দুস বলেন, নদী ভাঙনের পরে আমাদের এলাকায় কিছু লোকজন সেখানে বসবাস করছে। তারা চরের খাস জমি ২০ বছর ধরে তারা খাচ্ছে। এই এলাকার বিএনপির লোকজন এই গরিব মানুষগুলোকে সর্বহারা করে ফেলছে। সেই জমি গুলো আবার বন্ধক, ঠিকা(লিজ) দিচ্ছে।
পুরো চর এখন ইয়াসিন মাস্টার, সাহিন চেয়ারম্যান ও বিএনপির কিছু লোকজনের দখলে। গরিব মানুষ গুলোর অবস্থা একেবারে খারাপ হয়ে গেছে। আমি নিজেই সাহিন চেয়ারম্যানের কাছে একাধিকবার ফোন দিয়েছি তারা যেন গরিব মানুষের জমিগুলো ফিরত দেয়। কিন্তু চেয়ারম্যান তা করিনি।
উপজেলা প্রশাসন ও থানায় অভিযোগের পরে নিরুপায় আবুল কাশেম বলেন, যেদিন থেকে অভিযোগ দিয়েছি বিভিন্ন ধরনের হুমকি-ধামকী দিচ্ছে বোর্ডের লোকজন। অভিযোগ প্রত্যাহার করতে বলতেছে। ওরা বলে অভিযোগ তুলেন আপনার জমি বুঝে দেওয়া হবে। আমি অন্যদের বিষয়ে বললে তারা সেবিষয়ে কিছু জানায়নি।
কে বোর্ড গঠন করে দিলেন এবিষয়ে জড়িত মিজানুর রহমানের কাছে জানতে চাইলে তিনি বলেন, এই বোর্ড আমাদের হাই-কমান্ড করে দিয়েছে। হাই-কমান্ড কাকে বুঝাচ্ছেন? কেন্দ্র,জেলা নাকি উপজেলা এমন প্রশ্নের জবাবে তিনি বলেন, হাই কমান্ড কমিটি করে দিয়েছে।
টেপাখড়িবাড়ী ইউনিয়ন বিএনপির সভাপতি ইয়াসিন আলী বসুনিয়া জানান, যারা এতোদিন জমিগুলো ধরে রেখেছিল তারা আওয়ামীলীগের দোসর। আর যারা আমাদের বিরুদ্ধে অভিযোগ করেছে তারাও আওয়ামীলীগের দোসর। আমরা যাদের কাছে জমি দিয়েছি তাদের প্রকৃত কাগজ রয়েছে। খাস খতিয়ানের জমি কোন সূত্রে দিলেন এমন প্রশ্নের উত্তরে তিনি বলেন, সেগুলো গরিব মানুষের কাছে দিয়েছি। টাকা নেওয়ার বিষয়ে তিনি অস্বীকার করে বলেন, কোনো টাকা নেওয়া হয়নি। আপনি কোথায় আছেন, সরাসরি দেখা হলে কথা হবে।
টেপাখড়িবাড়ী ইউনিয়ন পরিষদের চেয়ারম্যান রবিউল ইসলাম সাহিন অভিযোগের বিষয়ে অস্বীকার করে বলেন, উত্তর খড়িবাড়ীতে জমি নিয়ে কোনো সমস্যা আছে কিনা আমার কাছে কোনো অভিযোগ নেই। মালিকানা জমি যদি থাকে মালিক যদি বুঝে না পায় তাহলে আমাকে জানাবে তাহলে ব্যবস্থা নেওয়া হবে। খাস বা হিন্দুদের পরিত্যক্ত সম্পত্তি/জমি লিজের বিষয়ে কিছুই জানি না।
যাচাই-বাচাই কমিটিতে রয়েছেন এবং এ বিষয়ে বসেছিলেন এমন প্রশ্নের উত্তরে তিনি বলেন, আমি যে বসেছিলাম কে বলেছে তারা নাম দাও? আমি কোনো কমিটি বা জমি সংক্রান্ত কোনো বিষয়ে জড়িত নই। যদি কেউ অভিযোগ করে থাকে থাকলে তাকে আমার কাছে অভিযোগ দিতে বলেন।
এবিষয়ে ডিমলা উপজেলা বিএনপির সভাপতি মনোয়ার হোসেন বলেন, আমাদের কোনো লোকজন জমি দখল করতে যাইনি। আওয়ামীলীগের সময়ে যারা ক্ষমতার দাপটে ভোগদখলে রেখেছে তারা কাছে থেকে উদ্ধার করে সঠিক মালিকের কাছে জমি বুঝে দিচ্ছে। আপনার দলের লোকজন খাসজমি লিজ দিচ্ছে এমন প্রশ্নের জবাবে তিনি বলেন, আমার কোনো দলের কোন সেখানে জড়িত নেই।
ইউনিয়ন বিএনপির সভাপতির বিষয়ে জানতে চাইলে তিনি এরিয়ে গিয়ে বলেন, যারা অভিযোগ দিচ্ছে তারা আওয়ামীলীগের লোকজন। আমরা সেই বিষয়টা দেখবো এখনো কিভাবে আওয়ামীলীগের লোকজন এভাবে অভিযোগ করে।
ডিমলা উপজেলা বিএনপির সাবেক সভাপতি অধ্যাপক রইছুল আলম চৌধুরী বলেন, আমরা শুনেছি, হাজার-হাজার জমি বেখদল হয়ে যাচ্ছে। যারা এ কাজ করছে তারা বিএনপির নামে বেশকিছু দিন ধরে অন্যায় ও অপকর্ম করে বেরাচ্ছে। যারা বিএনপি করে মূলত তাদের চরিত্র এমন হতে পারেনা। আমরাও তো বিএনপি করি কোনো অভিযোগ তো হলেনা
অভিযোগের বিষয়ে ডিমলা থানার ওসি (তদন্ত) আব্দুর রহিম বলেন, আমি অভিযোগের ভিত্তিতে ওই এলাকা গিয়ে সকলের কথা শুনেছি। এ বিষয়টা সাহিন চেয়ারম্যান মিমাংশা করে দিতে চেয়েছে।
এ বিষয়ে ডিমলা উপজেলা নিবার্হী কর্মকর্তা রাসেল মিয়া জানান, খাস জমি আমাদের বাহিরে কেউ লিজ দিতে পারে না। অনেক সময় পরিতক্ত খাস জমি অনেকেই চাষাবাদ করে। আর যদি কেউ লিজ দিয়ে থাকে তাহলে আমরা সেগুলো উদ্ধার করে লিজ দিতে পারবো।##
মেসেঞ্জার/রিপন/তারেক