ছবি: মেসেঞ্জার
কুড়িগ্রামের চিলমারীতে বেসরকারী দারিদ্র মুক্ত বহুমুখী সমবায় সমিতি লিমিটেডের সদস্যদের জমা রাখা প্রায় সাড়ে ৩ কোটি টাকা নিয়ে গা ঢাকা দিয়েছে সমিতি সংশ্লিষ্টরা। বছরের পর বছর ধরে সমিতির দায়িত্বরতদের দাঁড়ে দাঁড়ে ঘুরে নিজের টাকা ফেরত পাচ্ছেন না জমাকারী প্রায় ২ হাজার সদস্য। আওয়ামী সরকারের আমলে স্থানীয় নেতাদের যোগসাজসে এসব টাকা আত্মসাত করেছেন সমিতির কার্যনির্বাহী সদস্যরা। সদস্যদের দাবী জমা টাকা ফেরত চাইলে সংশ্লিষ্টরা হুমকিসহ বিভিন্ন ভয়ভীতি দেখিয়ে আসছেন। তবে আ.লীগ সরকার পতনের পর পরই এসব টাকা নিয়ে গা ঢাকা দিয়েছে সমিতির কার্যনির্বাহী কমিটির সকলেই।
এসব অভিযোগ উঠেছে উপজেলা রমনা মডেল ইউনিয়নের জোড়গাছ এলাকায় দারিদ্র মুক্ত বহুমুখী সমবায় সমিতি লিমিটেডের বিরুদ্ধে। সমিতিটি স্থানীয় কিছু অসাধু ব্যক্তি উপজেলা আ.লীগের নেতাদের সহযোগিতায় ২০০৭ সালে প্রতিষ্ঠিত হয়ে ওই বছরেই উপজেলা সমবায় অফিস হতে রেজিষ্ট্রেশন প্রাপ্ত হয়। চক্রটি প্রায় ২ হাজার সদস্য নিয়ে লোকদেখানো ক্ষুদ্র ঋণ কার্যক্রম শুরু করে।
সমিতিতে ১লক্ষ টাকায় প্রতিমাসে ১হাজার টাকা লভ্যাংশ প্রদানের শর্তে বিভিন্ন মেয়াদে অন্তত ২ শতাধিক সদস্য প্রায় আড়াই কোটি টাকা জমা রাখেন। এছাড়ার এসব সদস্য প্রতি মাসে সঞ্চয়ের টাকাও জমা দিতেন। সব মিলিয়ে প্রায় সাড়ে ৩ কোটি টাকা হাতিয়ে নেয় এ চক্রটি।
খোঁজ নিয়ে জানা গেছে, সমিতির পক্ষ হতে ব্যাংকের তুলনায় লভ্যাংশ বেশি দেয়ার আশ্বাস ও যেকোনো সময় জমাকৃতা টাকা উত্তোলণের সুযোগ রাখায় খুব সহজেই ফাঁদে পড়েন সাধারণ মানুষ। নিজের জমি বিক্রি, অবসর ভাতার প্রাপ্ত টাকসহ কষ্টে উপার্জিত সমস্ত টাকা জমা রাখেন ভুক্তভোগী সদস্যরা। পাশাপাশি সদস্যরা সঞ্চয়ও জমা দিতেন প্রতিমাসে। প্রথম দিকে সমিতির কার্যক্রম ঠিকঠাক থাকলেও বিগত বছরে সমিতি সংশ্লিষ্টদের টাকা আত্মসাতের গুনঞ্জন শোনা যায়।
পরবর্তীতে জমাকারী সদস্যরা টাকা তুলতে গেলে চলতি বছরের প্রথম থেকেই সমিতির পক্ষ হতে টালবাহানা শুরু হয়। জানা যায়, এমন ঘটনার পর কিছু কিছু সদস্যরা তাদের টাকা ফেরত নিতে বেশি চাপ প্রয়োগ বা আইনী সহায়তা নিতে গেলে সদস্যদের যতসামান্য টাকা দিয়ে পরিবেশ ঠিক রাখার চেষ্টা করতেন।
তবে টাকা আত্মসাতের অভিযোগ তুলে খোদ সমিতির সাধারণ সম্পাদক নুর আলমই বলেছেন, সমিতির সবধরণের লেনদেনসহ যাবতীয় কাজ করতেন পরিচালক আনিছুর রহমান আনিছ। এই আনিছ সহ সেসময় আওয়ামী লীগের থানাহাট ইউনিয়নের সাধারণ সম্পাদক ও ইউপি চেয়ারম্যান আব্দুর রাজ্জাক মিলন, স্থানীয় আ.লীগ নেতা ও সাবেক উপজেলা ভাইস চেয়ারম্যান জাহিদ আনোয়ার পলাশসহ আরও বেশ কয়েকজন জড়িত হয়ে সমিতির টাকা আত্মসাত করেছে।
আমি নিজেই বাদী হয়ে আনিছের নামে টাকা আত্মসাতের মামলা দিয়েছিলাম। পরে সেই মামলার তদন্তও টাকা দিয়ে গোপন রাখেন। আমি বিএনপি করি জন্য বিগত সময় এসব নিয়ে কথা বললে আওয়ামীলীগের ক্ষমতা দেখিয়ে হুমকি দিত। কয়েক মাস হতে তিনি সমিতির সাধারণ সম্পাদক পদে নেই বলে নিশ্চিত করেছেন।
তবে টাকা আত্মসাতের সঙে সংশ্লিষ্টতার অভিযোগ অস্বীকার করে থানাহাট ইউনিয়ন আ.লীগ সাধারণ সম্পাদক ও ইউপি চেয়ারম্যান আব্দুর রাজ্জাক মিলন বলেন, আমি কোনোদিন তাদের ওখানে যাই নি, জানিও না। এ বিষয়ে আমার কোনো সংশ্লিষ্টতা নেই।
ভুক্তভোগীদের সঙে কথা বলতে তাদের বাড়িতে গেলে দেখা যায়, সকলেই প্রায় দরিদ্র শ্রেনীর লোক। তাদের প্রায় সকল সদস্যদের পারিবারিক অবস্থা শোচনীয়। নুন আনতে পাতা ফুরানোর মত অবস্থা। এসময় টাকা জমা রাখার বিষয়ে কথা বলতে গিয়ে আবেগআপ্লুত হয়ে ঝড়িয়েছেন চোখ জল। অর্থাৎ জমি বিক্রির টাকা আবার কেউ চাকরী জীবনের পেনশনের টাকা জমা রেখেছিলেন সেই সমিতিতে। এখন সেই পরিবার গুলো অসহায় অবস্থায় রয়েছেন।
সমিতির পক্ষ হতে এমন ভাবে বুঝানো হয়েছে যে অনেকে আবার নিজের ছেলেমেয়ের ভবিষ্যৎ চিন্তা করে সন্তানের নামে রেখেছেন টাকা। এখন এসব টাকা ফেরত না পেয়ে হা-হুতাশে কাটছে জীবন। সরেজমিনে সমিতির অফিসে গিয়ে দেখা যায়, অফিসটিতে সাইনবোর্ড থাকলেও গতমাস থেকে ভিতরে একটি নূরানী মাদ্রাসার কার্যক্রম চলছে।
জামাল উদ্দিন নামে অবসর প্রাপ্ত এক বিজিবি সদস্য বলেন, আমি বিজিবিতে ৩৭ বছর চাকরি করেছি। বর্তমানে আমি শারিরিকভাবে অসুস্থ। আমার পেনশনের ৪ লাখ টাকা দারিদ্র সমিতিতে রাখি। তারা প্রতি লাখে ১ হাজার টাকা লাভ দিবে বলে প্রতিশ্রুতি দেয়। তারা এমনও বলে যখন ইচ্ছা তখন লভ্যাংশসহ টাকা উত্তোলন করতে পারবেন। তবে এক বছর থেকে লভ্যাংশ তো নাই জমা টাকা পাওয়াও অনিশ্চিত হয়ে পড়েছে।
বিলকিস বেগম নামে আরেক মহিলা বলেন, আমার একটা জমি বিক্রি করার পর সমিতির লোকজন বাসায় আসে এবং আমাকে বলে ওখানে টাকা রাখলে বিভিন্ন ধরনের সুযোগ-সুবিধা পাওয়া যাবে তাই আমি আমার দুই মেয়ের নামে সাড়ে তিন লাখ টাকা জমা রাখি। এছাড়াও তিনি দুই মেয়ের নামে প্রতি মাসে ২০০০ টাকা করে সঞ্চয় রাখছিলেন। কিন্তু বছর খানেক ধরে টাকা চাইতে গেলে দায়িত্বে থাকা কর্মকর্তারা নানাবিধ কারণ দেখিয়ে তালবাহনা করছেন।
শাহিনুর আক্তার বলেন, আমি ন্যাশনাল সার্ভিসে চাকরি করছিলাম চাকরি শেষে ১৯ সাল থেকে দারিদ্র সমিতিতে টাকা রাখা শুরু করি আমি ৪ লাখ ১৫ হাজার টাকা রাখছিলাম এছাড়াও ৪৩ হাজার টাকা সঞ্চয় রাখি। তবে এখন এই টাকার জন্য সমিতির কর্তৃপক্ষের দ্বারে দ্বারে ঘুরতে হচ্ছে। সভাপতির কাছে টাকা চাইতে গেলে তিনি সাধারণ সম্পাদকের সাথে দেখা করার কথা বলে সাধারণ সম্পাদকের কাছে গেলে তিনি ক্যাশিয়ার কাছে চাইতে বলেন কিন্তু কোন সুরহা হয় না।
আমি আমার জমা টাকা ফেরত চাই। শিরিনা বেগম নামে এক মহিলা বলেন, আমার ১৫ শতাংশ জমি ছিল আমি সেই জমি বিক্রি করে টাকা ঘরে রাখা যাবে না এজন্যই মানুষের কাছে শুনেছিলাম দারিদ্র মুক্ত সমবায় সমিতিতে বিভিন্ন ধরনের সুযোগ-সুবিধা দেয়া হয়। তাই আমি আমার টাকাগুলো সেখানে রেখেছিলাম। ৩ লাখ ১০ হাজার টাকা জন্য এক বছর ধরে ঘুরছি কিন্তু তারা আমার টাকা দিচ্ছে না টাকা চাইতে গেলে নানান তালবাহানা দেখাচ্ছে।
বিলকিছ, শিরিনা, মুক্তা ছাড়াও শতাধিক নারী সদস্য তাদের জমাটাকা ফেরত পাওয়ার আশায় ঘুরছেন। তবে সমিতির দায়িত্বশীলদের আঙুল এখন সেই পরিচালক আনিছের দিকেই। ৫ আগষ্টের পর থেকে তিনি গা ঢাকা দিয়েছেন। অভিযোগের বিষয়ে কথা বলতে তার মুঠোফোনে যোগাযোগের চেষ্টা করে পাওয়া যায়নি।
সমিতির সভাপতি মোস্তাফিজুর রহমানের সাথেও যোগাযোগ করা যায়নি। তবে এর আগে এ ঘটনায় তিনি জেলহাজতেও গিয়েছিলেন বলে জানা গেছে। উপজেলা সমবায় অফিসার কে.এম মাসুদুর রহমান জানান, সমবায় বিধি মোতাবেক হিসাব নিকাশ জমা না দেয়ায় গত বছর ওই সমিতির রেজিষ্টেশন বাতিল করা হয়েছে।
চিলমারী উপজেলা নির্বাহী কর্মকর্তা সবুজ কুমার বসাক বলেন, ভুক্তভোগীরা অভিযোগ করলে ব্যবস্থা নেয়া হবে।
মেসেঞ্জার/রাফি/জেআরটি