ঢাকা,  মঙ্গলবার
২১ জানুয়ারি ২০২৫

The Daily Messenger

ঝুড়িপিঠা তৈরী করে জীবন চলে যমুনাপাড়ের নারীদের

অদিত্য রাসেল, সিরাজগঞ্জ

প্রকাশিত: ১৪:১৩, ২৪ ডিসেম্বর ২০২৪

ঝুড়িপিঠা তৈরী করে জীবন চলে যমুনাপাড়ের নারীদের

ছবি : মেসেঞ্জার

গ্রামীণ বাংলার ঐতিহ্যবাহী মুখরোচক খাবার ঝুড়িপিঠা। সুস্বাদু ঝুড়িপিঠা গ্রাম বাংলার নারী-পুরুষসহ সব বয়সের মানুষে কাছে খাবারটি অত্যন্ত জনপ্রিয়। এই ঝুড়িপিঠা তৈরী করে জীবিকা নির্বাহ করছেন সিরাজগঞ্জের শাহজাদপুরের যমুনাপাড়ের ভাঙন কবলিত কয়েকশ পরিবার। সর্বস্ব হারিয়ে অসহায় মানুষগুলো আয়ের কোনো পথ না পেয়ে তারা চালের কুঁড়োয় ঝুড়িপিঠা তৈরী করেই জীবিকা নির্বাহ করে আসছেন।

মঙ্গলবার (২৪ ডিসেম্বর) শাহজাদপুর উপজেলার কৈজুরী ইউনিয়নের হাটপাঁচিল ছোট গ্রামটিতে ঢোকার মুখে রাস্তার দুই পাশের ফাঁকা জায়গায় ঝুড়িপিঠাগুলো রোধে শুকার এমন দৃশ্য চোখে পড়ে।

স্থানীয়রা জানায়, এক সময় ঘর-বাড়ি ও জমিজমা ছিলো তাদের। বর্তমানে তাদের মাথাগোজার মতো আশ্রয় টুকু নেই। বাঁধের কিনারেই ঝুপড়ি ঘর তুলে সেখানেই বসবাস করছেন যমুনার ভাঙ্গনে সর্বস্ব হারানো অসহায় মানুষগুলো। এদের মধ্যে কেউবা অন্যের জমি ভাড়া নিয়ে সেখানেই ছোট্ট একটি ঘর তুলে পরিবার নিয়ে বসবাস করছে।

এই ছোট গ্রামটির তৈরি ঝুরিপিঠার চাহিদা দিন দিন বাড়ছে। বর্তমানে ৩ শতাধিক পরিবারের অন্তত ১ হাজার নারী-পুরুষ ঝুড়িপিঠা তৈরির সঙ্গে যুক্ত আছেন। স্থানীয় চাহিদা মিটিয়ে এই ঝুড়িপিঠা দেশের বিভিন্ন এলাকায় ছড়িয়ে পড়েছে। বছরের অধিকাংশ সময় এই ঝুড়িপিঠা তৈরি হলেও শীতকালে বিভিন্ন ওয়াজ মাহফিল ও মেলার বাজারে এর চাহিদা বেশি থাকে। এ কারণে শীতকালকে পিঠাটি তৈরির প্রধান মৌসুম হিসেবে ধরা হয়।

ঝুড়িপিঠা তৈরীর কয়েকটি পরিবারের সঙ্গে কথা বলে জানা যায়, প্রতিদিন ভোররাত থেকে শুরু হয় তাদের কর্মযজ্ঞ। প্রথমে চুলার ওপর বড় একটি পাতিলে পানি গরম করে এতে পরিমাণমতো আতপ চালের গুঁড়া ও লবণ দিতে হয়। এরপর সেগুলো সিদ্ধ করে খামির তৈরি করা হয়।

এ পর্যায়ে খামির থেকে ছোট ছোট বল আকৃতির দলা তৈরি করা হয়। সেই দলাগুলো ঝাঁজর বা মাটির ছাঁচের ওপর ঘষে ঘষে কাঁচা ঝুরি তৈরি করা হয়। পরে সেই ঝুড়ি ৩/৪ দিন রোদে শুকিয়ে বাড়িতে রান্না ঘরে চুলার আগুনে নারীরা বালু দিয়ে ভেজে খাবারের উপযোগী করে থাকেন। পরে সেগুলো মাটির পাত্রে বিক্রির জন্য প্রস্তুত করা হয়।

ঝুড়িপিঠা তৈরির সঙ্গে জড়িত কয়েকজন নারী-পুরুষ বলেন, বর্তমানে ঝুড়িপিঠার চাহিদা রয়েছে। এই পিঠা তৈরিতে নারী-পুরুষ সবাই মিলে কাজ করেন তারা। রাত-দিন পরিশ্রম করে পিঠা বানানো হয়। তাদের তৈরি ঝুড়িপিঠা দেশের বিভিন্ন এলাকায় চলে যায়। শীতকালে গ্রামীণ মেলা, ধর্মীয় সভা থাকায় ঝুড়িপিঠার চাহিদা আরও বেড়ে যায়।

বাড়ির পাশের উঠানে ঝুরি শুকাচ্ছিলেন তানিয়া খাতুন (৩২) নামের এক গৃহবধূ। তিনি বলেন, স্বামী, শ্বশুর, শাশুড়ি সবাই মিলে ঝুরি তৈরির কাজ করেন। এতে যা উপার্জন করেন তা দিয়ে পরিবারের খরচ চলে। সংসারের অন্য কাজের ফাঁকে এ কাজ করেন তিনি। সবাই মিলে দিনে ৮০ কেজি ঝুড়ি তৈরি করতে পারেন।

আমিনা খাতুন, শেফালী বেগম, জোবেদা খাতুনসহ কয়েক নারী বলেন, এক সময় আমাদের বাড়ি-ঘর, ফসলি জমি ও গোয়ালে গরু ছিলো সব মিলে আমাদের সংসার ভালোই চলতো। হঠাৎ করে বাপ-দাদা ও স্বামীর ভিটা রাক্ষসী যমুনার ভাঙ্গনে হারিয়ে গেছে। আমাদের কোন জমি-জমা না থাকায় বর্তমানে সবাই ওয়াপদার ঢালে, আবার কেউ অন্যের জমি ভাড়া নিয়ে ঝুপটি ঘর তুলে বসবাস করছি। আমাদের আয়ের অন্য কোনো উৎস না থাকায় সবাই মিলে ঝুড়িপিঠা তৈরি করে জীবিকা নির্বাহ করছি।

যমুনায় সব হারানো ব্যক্তি জহুল ইসলাম বলেন, নদীতে বাড়ি-ঘর ভেঙ্গে গেছে, বাঁধের ওপর বাড়ি করেছি। এখন বাঁধের ওপর থেকেও উচ্ছেদ করে দিয়েছে। আমরা অন্যের জমি ভাড়া করে ঝুড়ি তৈরী করে কোন রকম জীবিকা নির্বাহ করছি।

ঝড়ি তৈরীর কারিগর আব্দুল মালেক বলেন, এক বস্তা আটার ঝুড়ি তৈরি করতে ৪ হাজার টাকা খরচ হয়। বিক্রি হয় ৪ হাজার ২শ থেকে ৪ হাজার ৩শ টাকায়। যদি আকাশের অবস্থা খারাপ হয় তাহলে নষ্ট হয়ে যাওয়ার আশঙ্কাও থাকে।

যমুনার ভাঙনে সব হারিয়ে একসময় পথের ভিখারিতে পরিণত হয়েছিলেন গ্রামটির কয়েকটি পরিবার। পরে এ কাজটি করে নিজেদের কোন রকম বাচার মতো অবস্থা করেছিলেন, আয়মনা বেগম (৫০), আলেয়া বেগম (৪৮), সুফিয়া খাতুনসহ অন্য নারীরা। তাঁরা জানান, কেজি প্রতি ঝুরি বিক্রি হয় ১০০-১২০ টাকায়। কেজিতে তাঁদের ১৫ থেকে ২৫ টাকা লাভ হচ্ছে। তাঁদের তৈরি ঝুরির চাহিদা থাকায় বিক্রিতেও কোনো বেগ পোহাতেও হচ্ছে না। বাড়ি থেকেই পাইকারেরা এগুলো সংগ্রহ করেন।

প্রধান শিক্ষক লোকমান হোসেন সরকার বলেন, হাটপাচিল গ্রামের এটাকে কুটিরশিল্প বলব। চালের কুঁড়ো থেকে সুস্বাদু খাবার তৈরি হচ্ছে। সারা বাংলাদেশের মধ্যে সুস্বাদু খাবার। খোলামেলা জায়গায় তৈরি হয়। নদীভাঙন কবলিত খেটে খাওয়া মানুষগুলো ভোররাত থেকে শুরু করে দিনভর পরিশ্রম করে থাকেন।

পাইকারি ঝুড়ি ব্যবসায়ী লোকমান হোসেন বলেন, প্রায় ৮ বছর ধরে আমি এখান থেকে ঝুড়ি পাইকারি ধরে কিনে বিভিন্ন গ্রামের জলসায়-মেলাতে বিক্রি করছি। নানা উৎসবসহ গ্রামীণ মেলায় ঐতিহ্যবাহী মুখরোচক খাবার হিসেবে ঝুড়িপিঠার ব্যাপক চাহিদা আছে। ঝড়ি তৈরি করে বিক্রিতে কোনো কষ্ট করতে হচ্ছে না। লাভও একেবারে কম হচ্ছে না।

হাট পাঁচিল গ্রামের চালকল মালিক আব্দুল আলিম বলেন, ঝুড়ি তৈরিকে কেন্দ্র করে গ্রামটিতে এখনো চারটি চালকল আছে। ঝুড়ি তৈরির জন্য এসব চালকল থেকেই আতপ চালের গুঁড়া নিয়ে থাকেন প্রস্তুতকারকরা। অনেককে বাকিতেও দেওয়া হয়। পরে বিক্রি করে সময় মত টাকা দিয়ে থাকেন তারা।

কৈজুরী ইউনিয়ন পরিষদের (ইউপি) সংরক্ষিত নারী ইউপি সদস্য মিনা খাতুন বলেন, এই গ্রামের নারীরা কঠোর পরিশ্রম করে সম্পূর্ণ নিজ উদ্যোগে এই ঝুড়ি তৈরির কাজ করেন। তারা অনেক কষ্ট করে অনেক দূর এগিয়ে গেছেন। ঝুড়ি তৈরীর প্রয়োজনীয় পুঁজি সহায়তা পেলে এ পেশায় তাঁরা আরও ভালো করতে পারবেন।

শাহজাদপুর উপজেলা নির্বাহী কর্মকর্তা (ইউএনও) মোহাম্মদ কামরুজ্জামান বলেন, হাটপাচিলে ভাঙন কবলিত মানুষগুলো ঝুড়িপিঠা তৈরি করে জীবিকা নির্বাহের বিষয়টি শুনেছি। তবে তারা কেউ আমাদের কাছে আসেনি। যুব উন্নয়ন অধিদপ্তর ও কর্মসংস্থান ব্যাংকের মাধ্যমে স্বল্পকালীন প্রশিক্ষণের আওতায় এসব গ্রামীণ ক্ষুদ্র উদ্যোক্তাদের আর্থিক সহায়তা দেওয়ার মতো ব্যবস্থা চলমান।

মেসেঞ্জার/তারেক