ঢাকা,  শুক্রবার
২৭ ডিসেম্বর ২০২৪

The Daily Messenger

সবজি চাষ ও ছাগল পালনে সোনালী দিনের দ্বারে সাতক্ষীরা উপকূলের নারী

সাতক্ষীরা প্রতিনিধি

প্রকাশিত: ১৮:১৮, ২৬ ডিসেম্বর ২০২৪

সবজি চাষ ও ছাগল পালনে সোনালী দিনের দ্বারে সাতক্ষীরা উপকূলের নারী

ছবি : মেসেঞ্জার

নদীর ভেড়িবাঁধ ভাঙন, জলোচ্ছাস এবং ঘূর্ণিঝড়ের মত প্রাকৃতিক দুর্যোগকে জয় করেই বছরের পর বছর ধরে টিকে আছে সাতক্ষীরার উপকূলীয় এলাকার মানুষ। প্রতিবছর এসব প্রাকৃতিক দুর্যোগে অসংখ্য পরিবার তাদের শেষ সম্বলটুকু হারিয়ে হয় সর্বশান্ত। তবে বেসরকারি উন্নয়ন সংস্থা ফ্রেন্ডশিপের এএসডি প্রকল্পের সহযোগিতায় উপকূলীয় এলাকায় ছাগল-ভেড়া পালন ও বসতবাড়ির আঙিনায় শাক-সবজি চাষে স্বচ্ছলতা ফিরেছে নারীদের। স্বামীর পাশাপাশি পরিবারে ইতিবাচক ভূমিকা রাখছেন এসব অঞ্চলের নারীরা। এতে পুরুষ নির্ভর হতদরিদ্র পরিবারের নারীরা স্বামীর সাথে সাথে পরিবারের অর্থনৈতিক সমৃদ্ধি অর্জন ও জীবনমান উন্নয়নেও হয়ে উঠছে গুরুত্বপূর্ণ অংশীদার। ফলে আশার আলো দেখছেন এসব হতদরিদ্র পরিবারগুলো।

উপকূল জেলা সাতক্ষীরার শ্যামনগর ও আশাশুনি উপজেলার পানি ও মাটি লবনাক্ত হওয়ায়, হতদরিদ্র পরিবারে পুরুষরা মূলত দেশের বিভিন্ন প্রান্তের ইটভাটায় শ্রমিক, সুন্দরবন নির্ভর, গভীর সমুদ্রে মাছ ধরা এবং রাজধানী ঢাকাসহ দেশের বিভিন্ন শহরগুলোতে রিক্সা চালকের কাজ করে জীবিকা নির্বাহ করে। ফলে এসব পরিবারের নারীদের প্রয়োজনীয় কিছু পেতে দিনের পর দিন পুরুষদের উপর নির্ভর করে অপেক্ষার প্রহর গুণতে হতো। বর্তমানে দিন বদলের অগ্রযাত্রায় এসব অঞ্চলের নারীরা পরিবারে নিজেদের অবস্থান শক্ত করার পাশাপাশি সামাজিক অঙ্গনেও গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা রেখে যাচ্ছেন। জাতীয় পর্যায়ের একটি অলাভজনক ও অরাজনৈতিক বেসরকারি উন্নয়ন সংস্থা ফ্রেন্ডশিপের সহযোগিতা নিয়ে দুই উপজেলার নারীরা এখন স্বাবলম্বী এবং অর্থনৈতিকভাবেও সমৃদ্ধ।

জানা গেছে, আশাশুনি উপজেলার প্রতাপনগর ইউনিয়নের রুরাইরবিল, হিজলিয়া  এবং শ্যামনগর উপজেলার পদ্মপুকুর ইউনিয়নের পশ্চিম পাতাখালী, উত্তর ঝাপা  ও মুন্সিগঞ্জ ইউনিয়নের কুলতলি ও সরদার পাড়া গ্রামের মোট ৬টি গ্রামের ১৮১ পরিবারের জীবনমান উন্নয়নে সক্রিয় গৃহিণীদের ছাগল, ভেড়া ও মৌসুম ভিত্তিতে গ্রীষ্মকালীন এবং শীতকালীন ২৪ প্রকারের শাক-সবজি বীজ প্রদান  এবং লবনাক্ত জমিতে সবজি চাষ বিষয়ে প্রশিক্ষণ প্রদান করা হয়। এছাড়া সবজি চাষে রাসায়নিক সারের পরিবর্তে জৈব সার ও ফেরোমন ফাঁদ ব্যবহার সহযোগিতা করে সংস্থাটি। দূর্যোগাকালীন সময়েও যাতে সবজি উৎপাদন অব্যাহত থাকে সেজন্য মাচা ও বেড পদ্ধতিতে সবজি চাষে উদ্বুদ্ধ করেছে ফ্রেন্ডশিপের এএসডি প্রকল্প। বর্তমানে উপকূলীয় এলাকায় বস্তায় আদা চাষে উৎসাহিত করায় গ্রামের প্রত্যেক বাড়িতে বস্তায় আদা চাষ হচ্ছে। তাছাড়া কমিউনিটি ভিত্তিক মাছ ও সবজি চাষেও তাদের উদ্ভুদ্ধ করা হচ্ছে।

মুন্সিগঞ্জ ইউনিয়নের কুলতলী গ্রামের মধুজিৎ রপ্তানের স্ত্রী দীপিকা রপ্তান জানান, স্বামীর উপার্জনের উপরই নির্ভর  করে সংসার চলতো। ফ্রেন্ডশিপের সহযোগিতা নিয়ে প্রথমে বাড়ির আঙিনায় সবজী চাষ করেছিলাম। সবজির ফলন ভালো হওয়ায় নিজেরা খাওয়ার পর বাজারে বিক্রয় করে গত বর্ষা মৌসুমে প্রায় ১০-১২ হাজার টাকা হাতে এসেছে। চলতি শীত মৌসুমে বড় পরিসরে বাড়ির আঙিনাসহ পাশের জমিতে সবজি চাষ শুরু করেছি। এখন সংসারে স্বামীর পাশাপাশি নিজেও অর্থনৈতিক সহযোগিতা করতে পারি। সন্তানের লেখাপড়ার কিছু খরচও দিতে পারি।

পদ্মপুকুর ইউনিয়ানের দক্ষিণ ঝাঁপা গ্রামের তপন কুমার মন্ডলের স্ত্রী সবিতা রানী বলেন অভাবের সংসারের একমাত্র উপার্জনক্ষম ব্যক্তির স্বামীর উপর নির্ভরশীল ছিলাম। তাই জীবনের ঝুঁকি নিয়ে নদীতে চিংড়ি পোনা ধরতাম। বর্তমানে ভেড়া পালন ও সবজি চাষে আমি স্বাবলম্বী। আর স্বামীর কাছে কিছু চাইতে হয় না। নিজের টাকা দিয়ে নিজের প্রয়োজন মেটাতে পারি।

বুড়িগোয়ালিনি ইউনিয়ন পরিষদের মেম্বর কাজল কান্তি সরকার বলেন নারীরা এতদিন জীবনের ঝুঁকি নিয়ে সুন্দরবনের নদীতে চিংড়ি পোনা সংগ্রহ করতো। এতে নানা রোগে আক্রান্ত হত তারা। এখন তারা বাড়ির পতিত জায়গায় সবজির চাষ করে। তাদের পরিবার এখন স্বচ্ছল।

শ্যামনগর উপজেলা কৃষি অফিসার নাজমুল হুদা বলেন, লবণাক্ত এলাকায় উন্নত জাতের বিভিন্ন প্রকারের শাক-সবজি বীজ বিতরণ করছে ফ্রেন্ডশিপ সংস্থাটি। আমরাও ইতিমধ্যে আধুনিক প্রযুক্তিতে চাষাবাদের জন্য নারীদের প্রশিক্ষণ দিয়েছি।

শ্যামনগর উপজেলা প্রাণিসম্পদ অফিসের উপ-সহকারী মাহবুবুর রহমান বলেন, ফ্রেন্ডশিপ বিনামূল্যে ছাগল-ভেড়া ও হাসঁ বিতরণ করছেন। এসব এলাকায় আধুনিক পদ্ধতিতে প্রাণিসম্পদ পালনের প্রশিক্ষণ ও টিকা সরকারি ভাবে  ব্যবস্থা করা হয়েছে।

ফ্রেন্ডশিপ ট্রানজিশনাল ফান্ড (এএসডি) প্রকল্পের প্রজেক্ট ম্যানেজার জুয়েল হাসান জানান, ফ্রেন্ডশিপ লুক্সেমবার্গ এর সহায়তায় সদস্যদের আয় রোজগার নিয়মিতকরণের মাধ্যমে অর্থনৈতিক উন্নয়ন, সুশাসন এবং স্থানীয় অবকাঠামো উন্নয়নে কাজ করে যাচ্ছে। এই প্রকল্পের মূল লক্ষ হলো হতদরিদ্র পরিবারের আয় বৃদ্ধিমূলক কাজের সুযোগ সৃষ্টি ও দুর্যোগ সহনশীল সক্রিয় সমাজ ব্যবস্থার মাধ্যমে দারিদ্রতা দূরিকরণ ও জীবন-জীবিকার মান উন্নয়ন করা।

মেসেঞ্জার/আসাদুজ্জামান/তুষার