ঢাকা,  শুক্রবার
২৭ ডিসেম্বর ২০২৪

The Daily Messenger

ফায়ার ফাইটার নয়ন, একমাত্র ছেলেকে হারিয়ে বারবার মূর্ছা যাচ্ছেন মা

মাজহারুল মান্নান, রংপুর ব্যুরো

প্রকাশিত: ১৯:৪৯, ২৬ ডিসেম্বর ২০২৪

ফায়ার ফাইটার নয়ন, একমাত্র ছেলেকে হারিয়ে বারবার মূর্ছা যাচ্ছেন মা

ছবি : মেসেঞ্জার

বৃহস্পতিবার। দুপুর সাড়ে বারোটা। রংপুরের মিঠাপুকুরের আটপুনিয়া গ্রাম। যমুনেশ্বরী নদী রক্ষা বাঁধের পাশে ফায়ার ফাইটার শোয়ানুর জামান নয়নের বাড়িতে গিয়ে দেখা গেল কখনো শুনশান নীরবতা, কখনো আর্তনাদ। বাড়ির ভিতরে মা নার্গিস বেগমের গগনবিদারী আহাজারির পর আহাজারি, বুকফাটা আর্তনাদ। আশেপাশের সব পরিবেশকে যেন থামিয়ে দিচ্ছিল বারবার। বুক চাপড়িয়ে আর্তনাদ করে মা নারগিস বেগম বলছিলেন, বুধবার রাত নয়টার দিকেও কথা হয়েছিল তার সাথে নয়নের। হয়েছিল বাড়ির ভালো-মন্দ ভবিষ্যৎ পরিকল্পনার কথা। কেন দেরিতে রান্না হচ্ছে মায়ের কাছে সেই কৈফিয়তও চেয়েছিল নয়ন। কারণ ফ্রি হলে ঘুমাতেও দেরি হবে। শাসন করছিলেন মাকে।" তার পাশেই গগন বিদারী আহাজারি করছিলেন বোন সীমা আক্তার। দুহাত চাপড়িয়ে বলছিলেন, এইটা কোন দুর্ঘটনা ছিলনা। এটা একটা হত্যাকান্ড। কারণ গুরুত্বপূর্ণ ওই জায়গায় আগুন নেভাতে গেল আমার ভাই। অথচ রাস্তা বন্ধ করা হলো না।

ওই সময়ে বাড়ির বাইরে থাকা চেয়ারে বসে আকাশের দিকে তাকিয়ে ছিলেন বাবা আখতারুজ্জামান। তিনিও জানালেন, বুধবার রাতে আমি স্থানীয় ছারান বাজারে ছিলাম। মায়ের সাথে কথা বলার পর আামার সাথেও কথা হয়েছিল নয়নের। এলাকার লোকজন বারবার ছেলের বিয়ের কথা বলছিলেন। সে কারণে আমি মোবাইলে কথা বলার সময় ছেলেকে বিয়ের কথা বলেছিলাম। তখন ছেলে আমাকে বলেছিল লক্ষ্যে পৌঁছানো পর্যন্ত অপেক্ষা করার কথা। তারপর বাড়ি ফিরে আসি। পাঁচ ঘন্টার ব্যবধানে শুনলাম সোনা আমার লাশ হয়ে গেছে।

সরেজমিনে দেখা যায়, সীমাহীন শূন্যতা এখন ওই পরিবারে। পরিবারের সকলের প্রশ্ন দেশের সবথেকে গুরুত্বপূর্ণ ভবনে আগুন নেভানোর সময় রাস্তা বন্ধ করা হয়নি কেন?

নয়নের পিতা আখতারুজ্জামান বলেন, আমার একমাত্র ছেলে সন্তান ছিল নয়ন। জীবন বাজি রেখে দেশের জন্য কাজ করতে গিয়েছিল সে। আগুনে যদি তার মৃত্যু হতো সেটাও হয়তো মানতে পারতাম। কিন্তু সর্বোচ্চ ত্যাগ নিয়ে বাইরে থেকে পানি এনে আগুন নেভানোর চেষ্টা করছিল সে। কিন্তু তাকে মরতে হলো ট্রাক চাপায়। এটা কেমন দেশ। আমি বুঝিনা। কত স্বপ্ন দেখিয়েছেন এই ছেলে আমাকে। একনিষ্ঠ ছিলেন কাজে। নিজেই বদলি নিয়েছেন বিশেষ টিমে। যাতে সব সময় দেশের কাজ করতে পারেন। অথচ তাকে মরতে হলো ট্রাক চাপায়। আমি এর বিচার চাই। এই ছেলের চাকরি এবং নানাবিধ কারণে ব্যাংক ঋণ সহ প্রায় ১০ লাখেরও বেশি টাকা আমার ঋণ হয়েছে। ছেলে চেয়েছিল আস্তে আস্তে কিস্তি শোধ করে আমাকে ঋণ থেকে মুক্তি দিবে। অথচ সে আজ নিজেই মুক্তি নিয়ে নিল। আমি আমার এই সন্তান হত্যার বিচার চাই।

নয়নের মা নার্গিস আক্তার বলেন, "আমাদের গ্রামের সামান্য একটু আগুন লাগলেও ফায়ার সার্ভিস সব রাস্তা বন্ধ করে দিয়ে আগুন নেভায়। কিন্তু সচিবালয়ে আগুন নেভানোর কাজ চলার সময় কেন রাস্তা বন্ধ করা হলো না। কেন আমার বুকের ধনকে টাক চাপায় মরতে হলো। আমার বংশের আর কোন বাতি দেয়ার লোক রইল না। আমাকে আমার ছেলেকে আমার বুকে এনে দিন। এবং যারা এই অবহেলার সাথে জড়িত তারাসহ হত্যাকারী ট্রাকের চালক কে ফাঁসি দিন।"

নয়নের একমাত্র বোন সীমা আক্তার। তিনি জানালেন, "আমার একমাত্র ভাইকে হত্যা করা হয়েছে। আমাদের বংশ নির্বংশ করা হয়েছে। আমি এর সাথে জড়িতদের বিচার চাই। কেন রাস্তা বন্ধ করা হলো না। এর সাথে কারা জড়িত। অথবা কারা ঐ সময় দায়িত্বে ছিল আইনশৃঙ্খলা বাহিনীর। তাদের বিরুদ্ধে ব্যবস্থা নিতে হবে। তা না হলে এ ধরনের মৃত্যু চলতেই থাকবে। আমি আমার ভাই হত্যাকারীদের বিচার চাই এবং আমার পরিবারের পাশে সরকার এসে দাঁড়াক সেটা চাই।

সীমা আক্তার বলেন, "এখন পর্যন্ত ফায়ার সার্ভিস এর কোন কর্মকর্তা বা কোন কর্তৃপক্ষ আমাদের এখানে এসে খোঁজখবর বা পরিস্থিতি জানায়নি এতে আমি খুব দুঃখ পেয়েছি।"

সচিবালয়ে আগুন নিভাতে গিয়ে ট্রাকের ধাক্কায় নিহত ফায়ার ফাইটার শোয়ানুর জামান নয়নের শুধু বাড়িতে নয় পুরো আটোনিয়া গ্রাম জুড়ে এখন শুধুই আহাজারি। বাড়িতে আসলেই সবার সাথে খোঁজখবর নিতেন তিনি। এই মৃত্যুকে কোনভাবেই মানতে পারছেন না স্বজন ও এলাকাবাসী।

পরিবার এবং এলাকাবাসীর দাবি রাস্তা বন্ধ করে দিলে ঘটতো না এই দুর্ঘটনা। বিচারের পাশাপাশি ক্ষতিপূরণের ব্যবস্থা করার দাবি স্বজন ও এলাকাবাসীর।

সাহিদা সুলতানা নামে এক স্কুল শিক্ষার্থী জানালেন, নয়ন বাড়ি আসলেই এলাকার সবার বাড়ি বাড়ি গিয়ে খোঁজ খবর নিতেন। শিক্ষার্থীদের পড়াশোনার খোঁজখবর নিতেন। তাদেরকে ভালোভাবে পড়াশোনা করার পরামর্শ দিতেন। সদা হাস্যজ্জল ছিলেন নয়ন। এভাবে মৃত্যু কোনভাবেই মেনে নিতে পারছেন না সাহিদা সুলতানা।

সত্তোরোদ্ধ আলিমা বেগম জানালেন, নয়ন বাড়িতে আসলেই আমাকে আমার খোঁজ নিতেন। আমার ছেলে খাদেমুল কি করছে জানতে চাইতেন। ভালো মানুষ দুনিয়াতে বেশিদিন থাকে না। সে কারণে হয়তো নাতি নয়ন এভাবে মারা গেল। তিনিও এ ঘটনার দোষীদের বিচার দাবি করেছেন।

কৃষক বাবার একমাত্র ছেলে সন্তান ছিলেন নয়ন। বোন সীমা আক্তার শ্বশুরবাড়িতে চলে গেছেন। উপার্জন শুরু করতেই সব কিছু শেষ হয়ে গেছে। পরিবারের উপর আছে ঋণের বোঝা। পাশে দাঁড়ানোর দাবি এলাকাবাসীর।

নয়নের জ্যাঠা আমিনুল ইসলাম দুলা জানান,  নয়ন ছিল আমাদের বংশের প্রদীপ। জ্বলে ওঠার আগেই নিভে গেল। ফায়ার সার্ভিস যেন আর এ ধরনের ভুল কখনোই না করে। অবশ্যই যেন রাস্তা বন্ধ করে দেয়। আমিরুল কে চাকরি দিতে গিয়ে দশ লাখেরও বেশি টাকা ঋণ আছে আমার ভাইয়ের। কথা ছিল রিংগুলো আস্তে আস্তে শোধ করবে। কিন্তু আমার ভাতিটাই নেই। কে ঋণ শোধ করবে। আর আমার ভাই ভাবি কি নিয়ে থাকবে কি নিয়ে বাঁচবে।

অয়নের একমাত্র ভগ্নিপতি জজদেহ কুচদহ উচ্চ বিদ্যালয়ের ইংরেজি শিক্ষক সাইফুল ইসলাম জানালেন, চাকরিতে ঢোকার পর কেবল সংসারের হাল ধরেছিল নয়ন। তার রোজগারই চলছিল সংসার। এই কঠিন মৃত্যু আমাদের বোবা বানিয়ে দিয়েছে। আমরা এ ঘটনায় জড়িতদের বিচার চাই। পাশাপাশি সরকারের কাছে দাবি, পরিবারের পাশে দাঁড়ানো। তা না হলে ছিন্নভিন্ন হয়ে যাবে পরিবারটি।

ঢাকায় নামাজে জানাজা শেষে বেলা আড়াইটায় বড় দেহ নিয়ে আর সার্ভিসের গাড়ি রওনা দিয়েছে রংপুরের উদ্দেশ্যে। রাত ৯ টার পরে রংপুরে আসবে তার লাশ। দাফন করা হবে পারিবারিক কবরস্থানে যেটাই মার কবরের পাশে।

স্থানীয় ছড়ান ডিগ্রী কলেজ থেকে বিএ পরীক্ষা দিয়েছিল নয়ন। ২০২২ সালে ৬১তম ব্যাচে ফায়ার সদস্য হিসেবে চাকরিতে যোগ দিয়েছিল। মাস দুইয়েক আগে তেজগাঁও জনে বিশেষ টিমে বদলি হয়ে এসেছিল নয়ন। বুধবার রাতে সচিবাল হয়ে আগুন নিভানোর সময় বিকল্প পথে পানি আনতে গিয়ে কাভার্ড ভ্যানের ভ্যানের ধাক্কায় নিহত হয় নয়ন।

বৃহস্পতিবার (২৬ ডিসেম্বর) শাহবাগ থানায় এ ঘটনায়  মামলা দায়ের করেন বংশাল ফায়ার স্টেশনের মো. রুহুল আমিন মোল্লা। গ্রেফতার করা হয়েছে ঘাতক ট্রাক চালক ও হেলপারকে।

মেসেঞ্জার/তুষার