ঢাকা,  শনিবার
০৪ জানুয়ারি ২০২৫

The Daily Messenger

আলীকদমে তামাক চাষে জীববৈচিত্র্য হুমকির মুখে

আলীকদম (বান্দরবান) প্রতিনিধি

প্রকাশিত: ১৯:১৩, ৩১ ডিসেম্বর ২০২৪

আলীকদমে তামাক চাষে জীববৈচিত্র্য হুমকির মুখে

ছবি : মেসেঞ্জার

বান্দরবানের আলীকদম উপজেলায় তামাক চাষ ক্রমেই পরিবেশ বিপর্যয়ের কারণ হয়ে দাঁড়াচ্ছে। স্থানীয় প্রশাসনের নজরদারির অভাব এবং তামাক কোম্পানিগুলোর প্রলোভনে কৃষকরা দ্রুত নগদ টাকা আয়ের আশায় তামাক চাষে ঝুঁকছেন। তবে দীর্ঘমেয়াদে এ চাষ পদ্ধতি এলাকার মাটি, পানি, জীববৈচিত্র্য এবং মানুষের জীবনমানের ওপর মারাত্মক নেতিবাচক প্রভাব ফেলছে।

পাহাড়ি সমতল ভূমি আলীকদম উপজেলা তার অনন্য জীববৈচিত্র্য এবং প্রাকৃতিক সম্পদের জন্য পরিচিত হলেও সাম্প্রতিক বছরগুলোতে এই অঞ্চলে তামাক চাষের ব্যাপকতা আশঙ্কাজনকহারে বৃদ্ধি পেয়েছে।

স্থানীয় কৃষি বিভাগের তথ্য অনুযায়ী, চলতি বছরে আলীকদমে প্রায় ৩০০ হেক্টর জমিতে তামাক চাষ করা হয়েছে। নদীর চর, পানি প্রবাহের ঝিরি পাশে, ফসলি জমি, পাহাড়ি ঢাল ও সরকারি খাস জমি তামাক চাষের আওতায় এসেছে, যা সরাসরি সরকারিভাবে নিষিদ্ধ। পানি চলাচলের স্থান থেকে দূরত্বে তামাক চাষ করার নিদের্শনা থাকলেও সেটা কোন তামাক কোম্পানির চাষীরা নিদের্শনা পালন করেন নাই।

স্থানীয় প্রশাসনের নজরদারির অভাবে এইসব নিয়ম কার্যত উপেক্ষিত। তামাক কোম্পানিগুলোর প্রলোভন ও নগদ অর্থ আয়ের সুযোগ পেয়ে কৃষকরা লাভের আশায় তাৎক্ষণিক কিছুটা নগদ আর্থিক সুবিধা পেলেও তারা আসলেই কতটা সুবিধাভোগী হচ্ছে, তা প্রশ্ন রয়ে যায় জনমনে।

গবেষণা বিষয়ক প্রতিষ্ঠান ‘উন্নয়ন বিকল্পের নীতি নির্ধারণী গবেষণা’ (উবিনীগ) তাদের এক গবেষণায় দেখিয়েছে, কৃষক তামাককে প্রধান ফসল বিবেচনা করায় নগদ অর্থের প্রলোভনে অন্য ফসল চাষের পরিকল্পনা করতে পারে না। ফলে গবাদি পশু ও হাঁস-মুরগি পালনসহ অন্যান্য কৃষিকর্মও প্রায় বন্ধ হয়ে যায়। এর ফলে স্থানীয় বাজারে শাকসবজির সংকট দেখা দিচ্ছে।

আলীকদমে ৪টি তামাক কোম্পানির প্রায় ২৫০/৩০০ চাষির তামাক চাষাবাদের জন্য নগদ অর্থ, সার, বীজ সরবরাহ করে। তার মধ্যে সিংহভাগ দখলে ব্রিটিশ আমেরিকান টোব্যাকো। অন্যদিকে আকিজ টোব্যাকো, ঢাকা টোব্যাকো, জাপান টোব্যাকো, আবুল খায়ের ট্যোবাকো এসব চাষির কাছ থেকে তামাক ক্রয় করে।

এ উপজেলার ৪টি ইউনিয়নের ৩টি ইউনিয়নে প্রায় ৮০ ভাগ জমিতে শীত মৌসুমে তামাকের চাষ হচ্ছে।

উল্লেখযোগ্যভাবে বেশি তামাক চাষ হয় এমন এলাকার মধ্যে আছে চৈক্ষ্যং ইউনিয়নের শিবাতলী, পূর্ণবাসন সুরেশ কারবারি পাড়া, ভরিমুখ, চৈক্ষ্যং এলাকা। সদর ইউনিয়নের মধ্যে আমতলী, ছাবের মিয়াপাড়া, সবুর ঘোনা এলাকা। নয়াপাড়া ইউনিয়নের মধ্যে আছে মংচপাড়া, নয়াপাড়া, রোয়াম্ভু এলাকা।

তামাক চাষি মো. কামাল উদ্দিন- মো. জসিম বলেন, "তামাক চাষে লাভ বেশি, কোম্পানিগুলো আমাদেরকে বীজ ও সার সরবরাহ করে। কিন্তু দীর্ঘমেয়াদে মাটির উর্বরতা কমে যায়।"

তামাকের জমিতে অতিরিক্ত সার ও কীটনাশকের ব্যবহার করার কারণে তামাকের জমি থেকে নদী, ঝিরি-ছড়ার মধ্যে পড়ার কারণে জলাশয়ের মাছ ও অন্যান্য জলজ প্রাণীর ক্ষতি হয়। এতে জীববৈচিত্র্য ক্ষতিগ্রস্ত হয় এবং মানুষের পুষ্টির যোগান বন্ধ হয়ে যায়। ফলে শিশুসহ সবাই পুষ্টিহীনতায় ভোগে। অন্যদিকে তামাকের ক্ষেতে অধিক মাত্রায় কীটনাশক ও রাসায়নিক সারের প্রয়োগ এবং তামাক চাষ ও বিক্রির জন্য প্রস্তুত করে তোলার প্রক্রিয়ায় কৃষক, শ্রমিক, নারী ও শিশু নানা স্বাস্থ্যঝুঁকির মধ্যে পড়ে। একইসঙ্গে তামাক পোড়ানোর সময় অবিরতভাবে কাজ করতে হওয়ার কারণে শিশুদেরকেও কাজে লাগানো হয়। এসময় তারা স্কুলে যেতে পারে না, ফলে তারা শিক্ষার ক্ষেত্রে পিছিয়ে পড়ছে। পাশাপাশি অল্প বয়সেই শরীরে বাসা বাঁধে নানা ধরনের রোগ।

তামাক চাষে ব্যবহৃত রাসায়নিক সার ও কীটনাশক জমির উর্বরতা হ্রাসের পাশাপাশি মাতামুহুরী নদীসহ স্থানীয় পানির উৎসগুলো দূষিত করছে। বিশেষ করে মাতামুহুরী নদীর পানির মান ক্রমাগত খারাপ হচ্ছে। নদী ও ঝিরিসমূহের জলজ উদ্ভিদ ও প্রাণীগুলো মরে যাচ্ছে।

তামাক চাষের জন্য জমি পরিষ্কার করতে গিয়ে বন উজাড় করা হচ্ছে, যা স্থানীয় জীববৈচিত্র্যের জন্য মারাত্মক হুমকি। বহু প্রজাতির উদ্ভিদ ও প্রাণী ইতোমধ্যে তাদের প্রাকৃতিক বাসস্থান হারিয়েছে। এছাড়া, তামাক শুকানোর জন্য আগুনে পুড়িয়ে কাঠ ব্যবহারের ফলে বনভূমি ধ্বংস হচ্ছে। তামাক চাষ পাহাড়ের মাটি ক্ষয় করে, যা জমির উর্বরতা হ্রাসের ঝুঁকি বাড়ায়।

তামাক চাষের সাথে যুক্ত কৃষক ও শ্রমিকরা দীর্ঘ সময় রাসায়নিক পদার্থের সংস্পর্শে থাকেন, যা ত্বক ও শ্বাসতন্ত্রের রোগ বাড়িয়ে তুলছে।

স্থানীয় স্বাস্থ্যকর্মীরা জানান, এসব রাসায়নিকের ব্যবহারে ত্বকজনিত সমস্যা এবং শ্বাসতন্ত্রের জটিলতা দেখা দিচ্ছে।

এ বিষয়ে স্থানীয় একাধিক তামাক চাষির সাথে কথা হলে, তাদের সবারই স্বাস্থ্যঝুঁকির বিষয়টি উপেক্ষিত। অন্যদিকে তামাক চাষ যে পরিবেশে বিপর্যয় ডেকে আনছে তার ধারণা নেই এসব চাষিদের।

তামাক চাষে ব্যবহৃত পানির যোগান দিতে খাল, পুকুর এবং মাতামুহুরী নদী থেকে পানি তোলা হচ্ছে। শত শত সেলোমেশিনের মাধ্যমে অতিরিক্ত পানি উত্তোলনের কারণে মাতামুহুরী নদীতে নাব্যতার সংকট তীব্র হচ্ছে। তামাক চাষের ভয়াবহ প্রভাব কমাতে কঠোর পদক্ষেপ গ্রহণ করা জরুরি।

বিশেষজ্ঞরা মনে করেন, কৃষকদের বিকল্প ফসলের দিকে প্রণোদনা প্রদান করলে তামাক চাষ হ্রাস পাবে।

উপজেলা কৃষি কর্মকর্তা মোহাম্মদ সোহেল রানা বলেন, "তামাক চাষের ক্ষতিকর দিক সম্পর্কে সচেতনতা বাড়াতে আমরা কার্যক্রম হাতে নিয়েছি। কৃষকদের জন্য বাদাম, ভুট্টা, সবজির বীজ এবং ডালের মতো ফসলের প্রণোদনা দেওয়া হচ্ছে।"

ব্রিটিশ আমেরিকান টোব্যাকোর লামা ও আলীকদমে দায়িত্বপ্রাপ্ত ম্যানেজারের কাছে সরকারি বিধিনিষেধ মানা হচ্ছে না কেন জানতে চাওয়া হলে তিনি বলেন, "সরকারি বিধিনিষেধ বিষয়ে কৃষকদের সাথে তামাক চাষের চুক্তির নবম ধারায় বলা আছে কোনটি করা আর কোনটি করা যাবে না। কোনো কৃষক তা ভঙ্গ করলে ব্রিটিশ আমেরিকান টোব্যাকো সরকারের যেকোনো সিদ্ধান্তের সাথে একমত পোষণ করবে।"

স্থানীয় প্রশাসন, পরিবেশ সংস্থা এবং বাসিন্দাদের সমন্বিত উদ্যোগ ছাড়া তামাক চাষের সংকট মোকাবিলা করা সম্ভব নয়। পরিবেশ ও জীববৈচিত্র্য রক্ষায় কার্যকর ব্যবস্থা গ্রহণ না করলে ভবিষ্যৎ প্রজন্মের জন্য বাসযোগ্য আলীকদম অক্ষুণ্ন রাখা আরও কঠিন হয়ে পড়বে। এই সমস্যা সমাধানে স্থানীয় জনগণকেও সচেতন হয়ে এগিয়ে আসতে হবে। তামাক চাষ নিয়ন্ত্রণের জন্য তৃণমূল পর্যায়ে সচেতনতা বৃদ্ধির পাশাপাশি বিকল্প আয়ের সুযোগ সৃষ্টি করা এখন সময়ের দাবি।

আলীকদম উপজেলা নির্বাহী অফিসার মোহাম্মদ আব্দুল্লাহ আল মুমিন বলেন, কেউ যদি সরকারি নির্দেশনা অমান্য করে নদীর ধারে অথবা ঝিরির আশেপাশে তামাক চাষ করে, তাহলে তাদের বিরুদ্ধে শীঘ্রই অভিযান পরিচালনা করা হবে।

মেসেঞ্জার/সুশান্ত/তুষার