ছবি: মেসেঞ্জার
‘যে চেনে সে কেনে। সাদেকের সৃষ্টি জামতলার মিষ্টি’। এই সত্য প্রবাদ বাক্যটি নিয়েই সাদেক মিষ্টান্ন ভান্ডারের ‘জামতলার সাদেক গোল্লার পথ চলা’। বিপত্তি বেকায়দায়ও যে কারও জীবনে আশীর্বাদ হয়ে দেখা দেয়, তার জলন্ত উদাহরণ তিনি। যশোরের শার্শা উপজেলার জামতলা বাজারে অবস্থিত সাদেক মিষ্টান্ন ভান্ডার। তার হাতের জাদুতে মিষ্টিপ্রেমীরা এতটাই মোহিত হয়েছেন যে, স্পঞ্জের রসগোল্লা থেকে রস ছড়িয়ে বিশে পরিচিত করেছেন সাদেক গোল্লা।
স্বাদে অতুলনীয় এ ঐতিহ্যবাহী মিষ্টির সুনাম ও কদর ছয় দশকের বেশি সময়েও কমেনি, বরং বর্তমানে এ মিষ্টির সুখ্যাতি যশোর তথা দেশের গন্ডি পেরিয়ে ছড়িয়েছে বিদেশেও। স্থানীয় মানুষজনের কাছে সাদেকের মিষ্টি যেন লোভনীয় এক নাম। সকাল, দুপুর, সন্ধ্যায়ও মিষ্টিপ্রেমীদের জটলা লেগেই থাকে। জেলা বা দেশের বাইরে থেকে যশোর বেড়াতে এলে জামতলার মিষ্টির স্বাদ নিতে ভোলে না মিষ্টিপ্রেমীরা।
প্রায় ৭০ বছর আগে মিষ্টির দোকানটির সূচনা করেন শেখ সাদেক আলী। সাদেকের মৃত্যুর পর ব্যবসার হাল ধরেছেন তার ছয় ছেলে। এক ছেলে মারা গেছেন। এখন পাঁচ ছেলে এবং এক নাতি সাদেক গোল্লা তৈরি করেন। দীর্ঘদিন ধরে তারা ঐতিহ্যবাহী এই মিষ্টির দোকানটি পরিচালনায় অক্ষুন্ন রেখেছেন বাবার হাতে সৃষ্টি এই মিষ্টির সুনাম। প্রতিদিন সাত থেকে দশ হাজার মিষ্টি তৈরি করা হয় এই সাদেক মিষ্টির কারখানায়। জামতলা ছাড়াও যশোরের বিভিন্ন স্থানে তাদের পাঁচটি আউটলেট রয়েছে। উপজেলার জামতলা বাজারে ‘যে চেনে সে কেনে, সাদেকের সৃষ্টি জামতলার মিষ্টি এই শ্লোগানে যাত্রা শুরু করে সাদেক মিষ্টান্ন ভান্ডার। আগে এখানে মানুষ চা বিস্কুট খেতে এলেও এখন প্রতিদিন হাজারো মানুষ ছুটে আসেন এই মিষ্টি কেনার জন্য। দামে সাশ্রয়ী এবং মানে শ্রেষ্ঠ হওয়ায় খুশি ক্রেতারাও। সরকারের সাহায্য-সহযোগিতা ও পৃষ্ঠপোষকতা পেলে জামতলায় মিষ্টির ইন্ডাস্ট্রি গড়ে তুলতে চান সাদেকের উত্তরসূরিরা।
সাদেক আলীর বড় ছেলে আনোয়ার হোসেন জানান, ১৯৫৫ সালে যশোর-সাতক্ষীরা সড়কের পাশে অবস্থিত জামতলা বাজারে চায়ের দোকানদার ছিলেন আমার পিতা শেখ সাদেক আলী। প্রতিদিন তার দোকানে গোয়ালরা গরুর দুধ দিয়ে যেত। একদিন প্রয়োজনের তুলনায় দুধের পরিমাণ বেশি হলে সাদেক দুধ কিনতে অপারগতা প্রকাশ করেন। এ সময় কুমিল্লার এক ব্যক্তি সাদেক আলীকে সেই দুধ রেখে দেয়ার অনুরোধ করেন। রাতে ওই দুধ দিয়ে মিষ্টি বানিয়ে দেবেন বলে জানান তাকে। কুমিল্লার সেই ব্যক্তির শিখিয়ে দেয়া পদ্ধতিতে সাদেক আলী মিষ্টি তৈরি শুরু করেন। সাদেক আলীর সেই মিষ্টির স্বাদ ও গুণাগুণের জন্য এর খ্যাতি ছড়াতে শুরু করে ‘সাদেক গোল্লা’ নামে। পরবর্তী সময়ে এই মিষ্টি তার উৎপত্তিস্থলের নামে ‘জামতলার মিষ্টি’ হিসেবে সারা দেশে পরিচিতি লাভ করে। এর সুবাস ও স্বাদের গল্প দেশের সীমানা ছাড়িয়ে যায়। প্রবাসীরা ফিরে যাওয়ার সময় এখান থেকে মিষ্টি নিয়ে যান। সেই ১৯৫৫-৯৯ সালে মৃত্যুর আগ পর্যন্ত সাদেক নিজ হাতে মিষ্টি তৈরি করে এর সুনাম অক্ষুন্ন রাখেন। তবে তার মৃত্যুর পর মিষ্টির সুনাম ধরে রাখতে ঘাম ঝড়াতে হয়েছে ছেলেদের। সাদেকের মৃত্যুর পর তার ছয় ছেলে আনোয়ার হোসেন, আলমগীর, শাহিনুর, শাহজাহান, জাহাঙ্গীর ও নূরুজ্জামান ব্যবসার হাল ধরেন। এক ছেলে মারা গেছেন। এখন পাঁচ ছেলে এবং এক নাতি ব্যবসা দেখাশুনা করেন।
জামতলা বাজারে একটি বটগাছের নিচে সাদেক গোল্লার আদি দোকান। সাদেক মিষ্টান্ন ভান্ডার। পরিধি বেড়ে দোকান হয়েছে পাঁচটি। তিনটি জামতলা বাজারে, একটি যশোরের নাভারণ বাজারের সাতক্ষীরা বাসস্ট্যান্ডে এবং অপরটি যশোর শহরের দড়াটানায়। দোকান গুলোতে রসগোল্লা ছাড়াও প্রায় সব ধরনের মিষ্টি পাওয়া যায়। ঢাকাসহ দেশের বিভিন্ন স্থানে এখান থেকেই জামতলার মিষ্টি সরবরাহ করা হয়। বিয়ে, জন্মদিনসহ বিশেষ বিশেষ অনুষ্ঠানে পরিবেশিত হয়ে থাকে জামতলার সাদেক গোল্লা বা জামতলার মিষ্টি। দেশের বিভিন্ন ক্যান্টিন, ফাস্ট ফুডের দোকান, হোটেল-রেস্তোরাঁয় নিয়মিত রসগোল্লা সরবরাহ করেন এমন কাজের সাথে যুক্ত অন্তত ৫০ জন।
জামতলার মিষ্টির কারিগর বজলুর রহমান বলেন, আমি মরহুম সাদেক সাহেবের কাছ থেকেই মিষ্টি বানানো শিখেছি। সাদেকের মিষ্টির সুনাম ধরে রাখতে এখনো নিরলস পরিশ্রম করছি। প্রথমেই দুধ জ্বাল দিয়ে ছানা তৈরি করি। তারপর ছানা চেপে পানি ঝরিয়ে টেবিলের ওপর কিছুক্ষণ শুকাই। হালকা সুজি মিশিয়ে সেটাকে গোল গোল করে গুছি তৈরি করি। তারপর চিনি দিয়ে শিরা তৈরি করে মিষ্টিগুলো দিয়ে দিই। এরপর অল্প আঁচে এই ছানার বলগুলোকে চিনির সিরাতে সেদ্ধ করা হয়। পর্যায়ক্রমে সেগুলো বাদামি বর্ণের হয়ে এলেই তৈরি হয়ে যায় সাদেক গোল্লা।
তিনি আরো বলেন, এক কেজি ছানায় মিডিয়াম মিষ্টি ৭০ পিস, বড় সাইজের ৩০-৩৫ পিস এবং ছোট সাইজের ১৩০-১৪০ পিস মিষ্টি বানাতে পারি। সময়ের বদলে ‘সাদেক গোল্লা’ এখন তিন সাইজে চার প্রকার প্যাকেটে সরবরাহ করা হয়। পলিথিনের প্যাকেটে ছয় টাকা দামের ২০ পিস, ১২ টাকা দামের ১০ টি, ২৪ টাকা দামের পাঁচটি এবং সাদা রঙের ১২ টাকা দামের ১০ টি করে বিক্রি হয়। এ ছাড়া বড় আকারের সাদেক গোল্লা ৩০ টাকা, মাঝারি ২০ টাকা এবং ছোট আকারের সাদেক গোল্লা ১০ টাকা করে বিক্রি হয়। একেকটি সাদেক গোল্লার ওজন সাধারণত ৫০ থেকে ১০০ গ্রাম হয়ে থাকে।
জামতলার সাদেক মিষ্টান্ন ভান্ডারের স্বত্বাধিকারী শাজাহান কবীর (মরহুম শেখ সাদেক আলীর ছেলে) বলেন, এই মিষ্টি একদম খাঁটি। দেশের বিভিন্ন জায়গায় এ মিষ্টি তৈরি করা হলেও স্বাদের কারণে যশোরের সাদেক গোল্লাই বা সাদেক মিষ্টিই সেরা। স্থানীয়ভাবে সংগৃহীত দেশি গরুর দুধ, চিনি আর জ্বালানি হিসেবে কাঠ এ মিষ্টি তৈরির মূলে রয়েছে। এ মিষ্টি প্রতি পিচ হিসেবে বিক্রি করা হয়ে থাকে। প্রতি পিচ দশ টাকা থেকে শুরু করে ত্রিশ টাকা পর্যন্ত আকারভেদে এ মিষ্টি বিক্রি করা হয়। এ জন্য ধীরে ধীরে মানুষের আস্থার প্রতীক হয়ে উঠেছে সাদেক গোল্লা। বাবার মৃত্যুর পর আমরা ছয় ভাই ধাপে ধাপে ছয়টি আউটলেট নিয়ে যাত্রা শুরু করি। সঠিক মান নিয়ন্ত্রণ করে আমরা বাজারের চাহিদা পূরণের চেষ্টা করছি। সরকারের পৃষ্ঠপোষকতা পেলে এটিকে মিষ্টির ইন্ডাস্ট্রি করতে চাই আমরা।
বিক্রয়কর্মী রাহুল জানান, সাদেকের মিষ্টির স্বাদ নিতে দূর-দূরান্ত থেকে ছুটে আসেন মিষ্টিপ্রেমীরা। কেউ আবার নিয়ম করে প্রতিদিন এই মিষ্টির স্বাদ নিতে আসেন এই দোকানে।
ইসহাক হোসেন নামে এক ক্রেতা বলেন, বর্তমানে অনেকেই ডায়াবেটিক্সে আক্রান্ত। সাদেক গোল্লার বিশেষত্ব হলো, এতে সুগার বা চিনির পরিমাণ কম। তাই যারা ডায়াবেটিসে আক্রান্ত তারা এই মিষ্টি খেতে পারেন, কোনো সমস্যা হয় না।
মিষ্টি কিনতে আসা আব্দুর রহিম বলেন, সাদেক গোল্লায় চিনির পরিমাণ কম থাকে স্বাদের বাইরে এটি অনণ্য বিশেষত্ব।
স্কুল শিক্ষক সাথী আক্তার বলেন, সাদেক গোল্লা জনপ্রিয় হওয়ার কারণ, বাজারের অন্য মিষ্টির চেয়ে স্বাদ ভিন্ন। খাঁটি দুধ ও মিষ্টি প্রক্রিয়াকরণ ভালো। সহজে মুখ মরে যায় না। ইচ্ছেমতো খাওয়া যায়। এজন্য ক্রেতাদের পছন্দের শীর্ষে সাদেক গোল্লা।
মেসেঞ্জার/জামাল/জেআরটি