ঢাকা,  বুধবার
০৮ জানুয়ারি ২০২৫

The Daily Messenger

জামালপুরের বিশ্বখ্যাত ঐতিহ্যবাহী কাঁসা শিল্প বিলুপ্তির পথে

স্টাফ রিপোর্টার, জামালপুর

প্রকাশিত: ১৮:০৭, ৭ জানুয়ারি ২০২৫

জামালপুরের বিশ্বখ্যাত ঐতিহ্যবাহী কাঁসা শিল্প বিলুপ্তির পথে

ছবি : মেসেঞ্জার

জামালপুর জেলার ইসলামপুর উপজেলায় ভারতবর্ষে দরিয়াবাদ গ্রামে নিপুন হাতে তৈরী কারুকার্য্যপূর্ণ, নান্দনিক সৌন্দর্যমন্ডিত কাঁশা শিল্প গড়ে উঠেছিল। এক সময় আবহমান বাংলার ইতিহাসে হাজারো বৎসরের ঐতিহ্য বহন করে কাঁশা শিল্প পরিচিতি লাভ করেছিল। এ শিল্পটি তৎকালিন বৃটিশ সরকার ১৯৪২ সালে লন্ডনের বার্মিংহামে শহরে সারা বিশ্বের হস্তশিল্প প্রদর্শনীর আয়োজন করেছিল। সেই প্রদর্শনীতে তৎকালিন জামালুরের ইসলামপুর উপজেলার বাসিন্দা প্রয়াত কাঁশা শিল্পী স্বর্গীয় জগৎচন্দ্র কর্মকারের কারুকার্যপূর্ণ কাঁশার শিল্পটি প্রদর্শন করেছিলেন। ওই প্রদর্শনীতে ইসলামপুরের কাঁশা শিল্প বিশ্বজুড়ে খ্যাতি অর্জন করে সর্বশ্রেষ্ঠ শিল্প হিসাবে স্বর্ণপদক লাভ করে। তারপর থেকে সারা বিশ্বে কাঁশা শিল্পের পরিচিতি লাভ করে।

এরপর থেকে দিন দিন মানুষের মাঝে কাঁশার শিল্পের চাহিদা  আরো বেড়ে যায়। বাংলায় এ মিশ্র ধাতব শিল্পটি কখন কোথায় শুরু হয়েছিল সে সম্পর্কে সুনির্দিষ্ট কোন উল্লেখ না থাকলেও অনুসন্ধান করতে গিয়ে শিল্প গবেষণা নৃবিজ্ঞানীদের মতে ইহা একটি প্রাচীন আমলের সভ্যতা। সে আমলেও ব্রোঞ্জ শিল্প ছিল। আবার কেউ কেউ একে পাহাড়পুর মহাস্থানগড় সভ্যতার সঙ্গে সম্পৃক্ত করতে চান। আবার অনেক অভিজ্ঞ লোকশিল্পীরা এই শিল্পটিকে রামায়ণ মহাভারতের যুগে বলে মনে করেন। বংশগত পেশায় কাঁশার শিল্পী স্বর্ণপ্রাপ্ত প্রয়াত যোগেশ চন্দ্র কর্মকারের পুত্র নারায়ণ চন্দ্র কর্মকার এবং কাঁশার শিল্প সমিতির সাধারণ সম্পাদক শ্রী অঙ্কন চন্দ্র কর্মকার মনে করেন রামায়ণ মহাভারতের জীবন চর্চায় পুজা পারবনে কাঁশার তৈরী ঘটি, বাটি বিভিন্ন দ্রব্য সামগ্রী ব্যবহার হতো। তাই তারা এ ধারনা পোষণ করে থাকেন। ঐতিহ্যগতভাবে শিল্প ও বোদ্ধা কারিগরের দাবী হিসাবে একে কোনভাবে ফেলা যায় না।

কাঁশা শিল্পীরা তাদের পেশাগত শিল্পজীবন পারিবারিকভাবে গড়ে তোলার কারণে একই পাড়া/মহল্লায় বসবাস করতেন। তাই তাদের বসবাসকারী এলাকাকে কাঁসারীপাড়া নামে পরিচিতি লাভ করেছিল। ইতিহাসবিদদের মতে, ভারতবর্ষে দেশে সর্বপ্রথম ঢাকার ধামরাই এলাকায় কাঁশার শিল্পী এসে বসতি স্থাপন করে কারখানা গড়ে তোলেন। কালক্রমে বিভিন্ন কারণে তারা দেশের বিভিন্ন স্থানে ছড়িয়ে ছিটিয়ে পড়েন। ভারতবর্ষে কাঁশা দিয়ে সংসারের নিত্য প্রয়োজনীয় শিল্প সামগ্রী তৈরী করে ব্যবহার করে আসছিল বলে সে সময় জটিল কোন রোগ বালাই ছিল না। বর্তমানে টিন, এলোমিনিয়ম, মেলামাইন, সিরামিক, প্লাষ্টিকের তৈরি তৈজষপত্র ইত্যাদি ব্যবহারে নতুন নতুন রোগের আবির্ভাব ঘটেছে বলে এলাকার সুধী প্রবীণরা দাবী করছেন।

কাঁশা একটি মিশ্র ধাতব পদার্থ থেকে তৈরী হয়ে থাকে। তামা বা কভার ৮০০ গ্রাম এর সাথে টিনএ্যংগট ২০০ গ্রাম অগ্নিতে দাহ করলে ১ কেজি কাঁশা তৈরী হয়ে থাকে। এছাড়া কে কতটুকু তামা, দস্তা, রুপা ও টিনএ্যংগট সাথে ধাতব পদার্থ মিশ্রণ করবে, তার উপর নির্ভর করবে শিল্পের স্থায়িত্ব, মসৃণ ও উজ্জ্বলতা। তবে মিশ্রণজাত প্রক্রিয়ার বিষয়টি একান্ত কারিগর সম্প্রদায়ের উপর অতি গোপনীয়তার ব্যাপার।

কাঁশার তৈরি বাসন কুশনের মধ্যে উল্লেখযোগ্য- থালা কাস্তেশ্বরী, রাজভোগী, রাঁধাকান্তি, বংগী, বেতমুড়ি, চায়নিচ, মালাথাল, দরাজ, রাজেশ্বরী, রত্ন বিলাস, ইত্যাদি। গ্লাস- গুটা, কলতুলা, সাদাকাঁচের নমুনা যুক্ত গ্লাস, স্বন্দেশ গ্লাস (চার পার্ট) ১ম স্তরে পানি, ২য় স্তরে মিষ্টি, ৩য় স্তরে পানসুপারী এবং ৪র্থ স্তরে পান মসলা। জগ- কৃষ্ণচুড়া, ময়ুরকন্ঠি, বকঠুট, ময়ুর আঁধার, মল্লিকা ইত্যাদি। বাটি- সাদাবাটি, কাংরিবাটি, বোলবাটি, রাজভোগী, রাঁধেশ্বরী, জল তরঙ্গ, রামভোগী, গোলবাটি, কাজল বাটি, ঝিনাই বাটি, ফুলতুলি বাটি, মালা বাটি, ইত্যাদি রয়েছে। চামচ- বোয়াল মুখী, হাতা, চন্দ্রমুখী, চাপিলা মুখি, পদ্মামুখি, কবুতর বুটি, ঝিনাইমুখী ইত্যাদি দ্রব্যাদির বাহিরে রয়েছে অনেক। এছাড়া পূজা অর্চনায় মঙ্গল প্রদীপ, কোসাকুর্ষি, মঙ্গলঘট, কাঁসার বাদ্যযন্ত্র ইত্যাদি রয়েছে।

এ বিষয়ে ২০২৩ সালে বাংলাদেশ ক্ষুদ্র ও কুটির শিল্প কর্তৃক জাতীয়ভাবে পুরষ্কারপ্রাপ্ত কারখানার মালিক উত্তম কুমার কর্মকার বলেন, শিল্পটি বাঁচিয়ে রাখতে মসলিম শিল্পের মত সরকারী সাহায্য সহযোগিতার একান্ত প্রয়োজন। বিশেষ করে টিন এ্যাংগট (রাং) সরকারীভাবে  মালয়েশিয়া থেকে কাঁচামাল আমদানী করে নির্ধারিত ন্যায্যমূল্যে বিক্রি করার পাশাপাশি স্বল্প সুদে ব্যাংক ঋনের ব্যবস্থা করে উৎপাদিত কাঁশা পণ্য বহি:বিশ্বে বাজারজাতকরণের ব্যবস্থা করতে হবে। এ সংক্রান্ত বিষয়ে শিল্পীবোদ্ধা লাল মিয়া, শরিফ উদ্দিন, সাহেব আলী, অবিজল এনামুল হক বলেন, উৎপাদিত পণ্য কম বিক্রির কারণে কারখানার মালিকগণ স্বল্প সংখ্যক পণ্য তৈরি করে থাকেন। আমাদের দৈনিক ৫শ টাকার বেতনে দিন চলে না।

এ ব্যাপারে ইসলামপুরের কাঁসা শিল্প সমিতির সভাপতি নারায়নচন্দ্র কর্মকার, সাধারণ সম্পাদক অঙ্কনচন্দ্র কর্মকার জানান, তাদের বংশগত ঐতিহ্য এবং পেশাগত দিক থেকে এই শিল্পটি ধরে রেখেছেন। পূর্বে কভার বা তামা এবং টিনএ্যংগটের মূল্য কম থাকায় তৈরী খরচ ছিল তোলনামূলক কম। তাই তাদের বাজারজাত করে স্বল্পমূল্যে বিক্রি করে ক্রেতাদের উদ্বুদ্ধ করতে সক্ষম হয়েছেন। কিন্তু বর্তমানে তামার দাম অত্যাধিক বৃদ্ধির সাথে টিনএ্যংগটের দামের কারণে তৈরি খরচ বেশী হয়ে থাকে। যেহেতু টিনএ্যংগট বিশ্বের একমাত্র মালেশিয়া ব্যতিত অন্যকোন দেশে পাওয়া যায় না। তাই সরকারীভাবে আমদানী না থাকায় ২শ টাকার কেজি টিনএ্যংগট বর্তমান ৪ হাজার টাকা কেজি ক্রয় করতে হয়। এ কারণে ৮ গ্রাম তামা (কভার) ১ হাজার টাকা ২শ গ্রাম টিনএ্যংগট প্রায় ১হাজার টাকা এবং কারিগর খরচ ৫শত টাকা। একত্রে ১কেজি কাঁসা তৈরী করতে খরচ পড়ে তাদের প্রায় ২হাজার ৫শ টাকা। বিক্রয় করতে হয় সর্বনিন্ম ৩ হাজার টাকা। এ কারণে ক্রেতারা উচ্চমূল্যে খরিদ করতে অনিচ্ছুক কারণ কাঁশার পরিবর্তে ক্রেতারা প্লাষ্টিক, সিরামিক, কাঁচ কিংবা চিনামাটির তৈজষপত্র কমদামে কিনে থাকেন। একারণে বর্তমানে কাঁশার শিল্পটির দুর্দিন চলছে। শিল্পীরা অনেকেই বাঁচার তাগিদে এ পেশা ছেড়ে দিয়ে অন্য পেশায় চলে যাচ্ছেন। এভাবে চলতে থাকলে ভবিষ্যতে এ শিল্পটিও মসলিন শিল্পের মতো বিলীন হয়ে যেতে পারে। শিল্প সংশ্লিষ্টদের আবেদন, মসলিম শিল্পের রক্ষার মত এই ঐতিহ্যবাহী কাঁসা শিল্পটি ধরে রাখার স্বার্থে সরকারী উদ্যোগে মালেশিয়া থেকে পর্যাপ্ত পরিমাণ টিনএ্যংগট আমদানী করে শিল্পের সাথে সম্পৃক্তদের সহজ শর্তে ব্যাংক ঋন প্রদান করে আধুনিক মেশিনপত্র ক্রয় করার ব্যবস্থা করে শিল্পটি ধ্বংশের হাত থেকে রক্ষা করা। এছাড়া শিল্প সংশ্লিষ্টদের উদ্বুদ্ধ করে দেশ-বিদেশে শিল্প মেলার আয়োজন করে চাহিদা বৃদ্ধি করা হলে শিল্পটি ধরে রাখা সম্ভব হবে। নচেৎ কালের বিবর্তনে এক সময় শিল্পটি বিলুপ্তি হয়ে যাওয়ার সম্ভবনা রয়েছে।

এ বিষয়ে ইসলামপুর উপজেলা নির্বাহী কর্মকর্তা মো. তৌহিদুর রহমান বলেন, শিল্পটি রক্ষা করতে প্রশাসনের পক্ষ থেকে পণ্য সামগ্রী বিক্রয়ের জন্য অনলাইনে বিক্রি বাজার চালু করাসহ সাহায্য সহযোগিতার জন্য ইতোমধ্যে উর্দ্ধতন কর্তৃপক্ষকে জানানো হয়েছে।

এ ব্যাপারে জামালপুরের জেলা প্রশাসক হাছিনা বেগম এর কাছে বারংবার মুঠোফোনে ০১৭১৩০৬১১০০ যোগাযোগ করা হলেও তিনি ফোন রিসিভ করেননি।

মেসেঞ্জার/হালিম/তুষার