ছবি : মেসেঞ্জার
বিগত সময়ে রাজনৈতিক প্রভাব এবং সরকারের হস্তক্ষেপে মূলধারার গণমাধ্যমগুলো সঠিকপথে চলতে পারেনি বলে মন্তব্য করেছেন গণমাধ্যম সংস্কার কমিশন প্রধান কামাল আহমেদ। সে কারণে গেল ১৫ বছরে আমরা মূল ধরার গণমাধ্যম ব্যর্থ হয়েছি বলেই মানুষ সোশ্যাল মিডিয়ার উপর নির্ভরশীল হয়েছে।
রোববার (১৯ জানুয়ারি) দুপুরে রংপুর জেলা প্রশাসনের সম্মেলন কক্ষে বিভাগের সাংবাদিকদের সাথে কমিশনের মতবিনিময় সভায় এই মন্তব্য করেন তিনি। এ সময় কমিশন সদস্য অধ্যাপক গীতিআরা নাসরীন, শামসুল হক জাহিদ, মোস্তফা সবুজ, রংপুর সম্মিলিত সাংবাদিক সমাজের সদস্য সচিব লিয়াকত আলী বাদল, দৈনিক দাবানলের সম্পাদক খন্দকার মোস্তফা সরওয়ার, রংপুর সাংবাদিক ইউনিয়ন-আরপিইউজেসভাপতি সালেকুজ্জামান সালেক, সাধারণ সম্পাদক সরকার মাজহারুল মান্নানসহ বিভাগ ও জেলার গণমাধ্যমকর্মীরা ঢাকার বাইরে সাংবাদিকদের অধিকার সুরক্ষা ও নিরাপত্তা নিয়ে সংস্থার প্রস্তাব উপস্থাপন করেন।
সবার বক্তব্য শোনার পর কথা বলেন কমিশন প্রধান কামাল আহমেদ। তিনি বলেন, ১৫ বছরে আমরা মূল ধারার গণমাধ্যম ব্যর্থ হয়েছি বলেই মানুষ সোশ্যাল মিডিয়ার উপর নির্ভরশীল হয়েছে। অনলাইন মিডিয়ার উপরে নির্ভরশীল হয়ে পড়েছে। হঠাৎ হঠাৎ যে অনলাইন মিডিয়া গড়ে উঠেছে সেই সমস্ত অনলাইন মিডিয়াকে বেশি বিশ্বাস করেছে।
মূলধারার গণমাধ্যম কেন ব্যর্থ হল তা উল্লেখ করে কামাল আহমেদ বলেন, সমস্যা হচ্ছে আমরা মূলধারার গণমাধ্যম ব্যর্থ হয়েছি কেন? মূল ধারার গণমাধ্যম ব্যর্থ হয়েছি রাজনীতির কারণে। রাজনৈতিক প্রভাব। সরকারের বিভিন্ন স্বৈরাচারী পদক্ষেপ। মামলা মোকাদ্দমা আইন দিয়ে বিভিন্ন নিয়ন্ত্রণ ও নিপীড়নের চেষ্টা। ভয়ভীতি প্রদর্শন। আবার একইভাবে কর্পোরেট ডিড। বড় বড় মালিকদের যে কর্পোরেট স্বার্থ। সেই কর্পোরেট স্বার্থে অতি মুনাফার লোভে সেগুলো থেকে তারা সংবাদমাধ্যমকে ব্যবহার করেছেন। তাদের স্বার্থে আত্মরক্ষার জন্যে। তাদের স্বার্থে তাদের পক্ষে ব্যবহারের জন্য। তখন দেখা গেছে যে সংবাদ মাধ্যম মানুষের যে স্বার্থ, মানুষের যে ভোগান্তি, সেই ভোগান্তির কথা না লিখে বরং তাদের কথায় লিখছেন। মালিকদের কথাই লিখছেন। যে মালিকের ব্যাবসায়িক স্বার্থ উপকৃত হবে লাভবান হবে। ফলে এইটা একটা দুষ্টু চক্রে পরিণত হয়েছে। এই দুষ্টুচক্র না ভাঙলে গণমাধ্যমের সমস্যার সমাধান খুব সহজেই আসবে না।
গণমাধ্যমে দুষ্ট চক্র ভাঙতে অন্তর্বর্তী কালীন সরকারের পাশাপাশি রাজনৈতিক সরকারের দায়িত্ব অনেক উল্লেখ করে কামাল আহমেদ বলেন, ভাঙাটা খুব সহজ হবে না। ভাঙতে যেমন এই অন্তর্বর্তী সরকারকে পদক্ষেপ নিতে হবে, ঠিক তেমনি পরবর্তীতে যে রাজনৈতিক সরকার আসবে তাদেরকেও সেই ধারাবাহিকতা বজায় রেখে আবার নতুন কিছু পদক্ষেপ নিতে হবে। আর সে সমস্ত সুপারিশমালা আপনাদের আলোচনা ও মতামতের ভিত্তিতেই তৈরি করা হবে। সেই সুপারিশমালাগুলো বাস্তবায়নে অন্তর্বর্তী সরকার যতটুকু সময় পাবে তার চেয়ে অনেক বেশি সময় পাবে রাজনৈতিক সরকার। রাজনৈতিক সরকারকে এটার প্রতি অঙ্গীকার দিতে হবে। অঙ্গীকার করতে হবে, নজর দিতে হবে, বাস্তবায়ন করতে হবে।
কামাল আহমেদ বলেন, পুরো গণমাধ্যম শিল্পে যে পরিস্থিতি বিরাজ করছে সেই পরিস্থিতির একটার কারণে আরেকটার উপরে যে প্রভাব পড়ছে। তারও নেতিবাচক প্রভাব পড়ছে। অর্থাৎ গণমাধ্যম প্রতিষ্ঠান নিজে যেহেতু ভালোভাবে চলছে না, সঠিকভাবে চলছে না তখন তার কর্মীদেরকেও বঞ্চিত করছে। সেখানে অনেকগুলা কারণ রয়েছে। তার ১ টা হলো অনেক বেশি সংখ্যক গণমাধ্যম প্রতিষ্ঠা। অনেক বেশি সংখ্যক পত্রিকা। অনেক বেশি সংখ্যক টেলিভিশন। এগুলোর মধ্যে সুস্থ প্রতিদ্বন্দ্বিতা নেই, প্রতিযোগিতামূলক পরিবেশ নেই। পরিবেশটা এমনই যেখানে যার যত রাজনৈতিক ক্ষমতা আছে, যার যত কালো টাকার দাপট আছে, সে তত বেশি লাভবান হচ্ছে, তত বেশি শক্তিশালী হচ্ছে। এবং যেহেতু রাজনৈতিক ক্ষমতা রয়েছে, তার টাকার প্রভাব রয়েছে, সে কারণে তার গণমাধ্যমের উপরে প্রভাবটা জোরালো ও শক্তিশালী। তার বিরুদ্ধে সাংবাদিকেরা কিছু করতে পারছি না।
সাংবাদিকদের মধ্যে বিভাজনের কারণে সুযোগ নিচ্ছে সরকার এবং কর্পোরেট প্রতিষ্ঠানগুলো উল্লেখ করে কামাল আহমেদ বলেন, সাংবাদিকদের মধ্যে চরম বিভাজন। এই যে সাংবাদিকদের মধ্যে অনৈক্য। একদম চরম পর্যায়ে গেছে। বিভিন্ন ধরনের সমিতি, অ্যাসোসিয়েশন পাল্টাপাল্টি সংগঠন। এটা একটা ক্ষমতা বা প্রভাব। প্রতিদ্বন্দ্বিতার মধ্যেও পরিণত হয়েছে। ফলে সাংবাদিকদের সবার স্বার্থ সামগ্রিকভাবে পেশার যারা যথাযথভাবে কাজ করছেন। তাদের মাথার উপরে কোন ছাদ নেই। ফলে সাংবাদিকদের এক্সপ্লোট করা খুব সহজ হয়। যারা এক্সপ্লেট করতে চান, যারা সাংবাদিকদেরকে ঠকাতে চান, যারা সাংবাদিকদের নানান ধরনের কাজে ব্যবহার করতে চান তারা ঠিকই ব্যবহার করছেন। তারা সেই সুযোগটা নিচ্ছেন।কারণ সাংবাদিকরা ঐক্যবদ্ধ নন। কারণ আপনার বেতন ভাতার জন্য কোথাও সংগ্রাম করতে হচ্ছে না। সবদিক থেকে একটা নৈরাজ্য দিক তৈরি হয়েছে বাংলাদেশের বাজারে যতটুকু যেইমাত্রায় পাঠক, দর্শক, শ্রোতা আছে তাদের যে চাহিদা সেই চাহিদার তুলনায় টেলিভিশনের সংখ্যা বেশি, রেডিওর সংখ্যা বেশি, আবার খবরের কাগজের সংখ্যা বেশি। তারপরে এখন শুরু হয়েছে অনলাইন। শত শত অনলাইন নিউজ পোর্টাল। এর পাশাপাশি আছে সোশ্যাল মিডিয়া। এই বাস্তবতায় আমরা কাজ করছি।
কামাল আহমেদ আরও বলেন, তৃণমূল থেকে গণমাধ্যম কর্মীদের কাছ থেকে আমরা আর্থিক নিরাপত্তা, কাজের সময়ের সিকিউরিটিসহ সকল ক্ষেত্রে উঠে আসা বিষয়গুলো নিয়ে সংস্কার প্রস্তাব সরকারের কাছে উপস্থাপন করব।
মতবিনিময় সভায় বিভাগের প্রিন্ট, অনলাইন ও ইলেকট্রনিক্স মিডিয়ার দেড় শতাধিক গণমাধ্যমকর্মী উপস্থিত ছিলেন।
মেসেঞ্জার/তুষার