ক্যাপশন : রাজশাহী তানোরে ৪০ ক্ষুদ্র নৃগোষ্ঠী পরিবার উচ্ছেদ আতঙ্কে ভুগছেন -টিডিএম।
রাজশাহীর তানোর উপজেলার পাঁচন্দর ইউনিয়নের গুড়ইল মৌজায় প্রায় ৪৭ বছর ধরে বসবাসরত ৪০টি ক্ষুদ্র নৃগোষ্ঠী পরিবার উচ্ছেদ আতঙ্কে দিন কাটাচ্ছেন। তারা ঐ গ্রামের একটি অর্পিত সম্পত্তিতে বাস করছেন। জমিটি দখলের চেষ্টা চালাচ্ছে এলাকার একটি প্রভাবশালী মহল।
ভুক্তভোগী পরিবারগুলোর অভিযোগ, ক্ষুদ্র নৃগোষ্ঠী পরিবারগুলোকে উচ্ছেদ করতে শুক্রবার (১৭ জানুয়ারি) দিবাগত মধ্যরাতে পাড়ার রিপন মুর্মু নামের এক ব্যক্তির নির্মাণাধীন বাড়িতে অগ্নিসংযোগ করা হয়েছে। এ নিয়ে রিপন মুর্মু তানোর থানায় একটি লিখিত অভিযোগ করেছেন। তবে পুলিশ তার অভিযোগ মামলা হিসেবে রেকর্ড করেনি।
জানা গেছে, অভিযোগে মোসারুল হক দুখু (৬০), বাবুল মৃধা বাবু (৪০), মিজান সরকার (৩৫), মো. জুলফর (৪৫), মো. নাজমুল (২৯), মো. বিপ্লব (২২), শরিফুল ইসলাম ভুলু (৬০) ও মো. ভাসা (৫৫) নামের আটজনের নাম উল্লেখ করা হয়েছে। তাদের মধ্যে শরিফুল ইসলাম ভুলুর বাড়ি চাঁপাইনবাবগঞ্জের শিবগঞ্জ। অন্যদের বাড়ি তানোরের গুড়ইল গ্রামে। তাদের মধ্যে বাবুল মৃধা বাবু ওয়ার্ড যুবলীগের সাবেক সাধারণ সম্পাদক বলে স্থানীয়রা জানিয়েছেন।
ভুক্তভোগীরা জানান, বাঁশের বাতা ও পলিথিন দিয়ে বাড়ির উঠোন ঘিরেছিলেন ক্ষুদ্র নৃগোষ্ঠী সম্প্রদায়ের রিপন মুর্মু। আগুনে পলিথিন পুড়ে গেছে। গ্রামবাসী জানান, গত শুক্রবার দিবাগত রাতে দেশীয় অস্ত্রশস্ত্র নিয়ে এসেছিলেন মোসারুল হকসহ অভিযুক্তরা। তারা পাড়ার শুরুতে রিপনের বাড়ির বেড়ায় আগুন দেন। এসময় পাড়ার সকলে একযোগে বেরিয়ে আসলে অভিযুক্তরা পালিয়ে যান। তখন তারা আগুন নেভান।
পাড়ার বাসিন্দা পাড়ার হেরা টুডু, শিবলাল মুর্মু, হরেন মুর্মু, বিশ্বনাথ সরেন, বাবুলাল সরেন, জগেন টুডু, মীরেন মার্ডি, মনোসুরি কিস্কু, রসিক মার্ডি, পাতরাজ টুডু, ফিলিপ কিস্কু, সৈনিক হাঁসদা বলেন, মৌজার ১০ একর ৩০ শতাংশ জমির মালিক ছিলেন শিবদাস ভট্টাচার্য। ষাটের দশকে রাজশাহীর দারুশা দাঙ্গার পর শিবদাস ভট্টাচার্য ভারতে চলে যান। তারপর তার জমি অর্পিত সম্পত্তি হয়ে যায়। প্রায় ৩৩ বিঘা জমির মধ্যে ১০ বিঘায় তারা ৪০টি পরিবার ৪৫ বছর ধরে বাস করছেন।
আরএস রেকর্ডে এখনও জমির মালিক হিসেবে শিবদাস ভট্টাচার্যের নাম লেখা আছে। ২০১২ সালের ৪ অক্টোবর প্রকাশিত বাংলাদেশ গেজেটও এই সম্পত্তির মালিক হিসেবে শিবদাস ভট্টাচার্যের নাম আসে। অথচ আওয়ামী লীগ ও যুবলীগের নেতাকর্মীদের নিয়ে শরিফুল ইসলাম ভুলু এই জমি দখলের পাঁয়তারা করছেন বলে অভিযোগ ক্ষুদ্র নৃগোষ্ঠী পরিবারগুলোর।
তারা আরও জানান, তাদের বসতভিটা দখলে নিতে শরিফুল ইসলাম ভুলু আদালতে মামলা করেছিলেন। ওই মামলায় রায় এসেছে ক্ষুদ্র নৃগোষ্ঠীদের পক্ষে। এরপর ভুলু আবার আপিল করেছেন। সেই মামলা এখনও চলমান। এরমধ্যেই ঘরবাড়ি পুড়িয়ে তাদের উচ্ছেদের চেষ্টা করা হয়েছে। এ ব্যাপারে থানায় অভিযোগ করা হলেও পুলিশ মামলা রেকর্ড করছে না।
গ্রামের গৃহবধূ সাবিনা টুডু বলেন, ‘১৮ বছর আগে বিয়ের পর এই গ্রামে এসেছি। কয়েকবছর ধরে রাতে ঘুমাতে পারি না। মাঝে মাঝেই লোকজন এসে অস্ত্রপাতি দেখায়। গ্রামে ঘুরে বেড়ায়। আমরা ব্যাপক অত্যাচারের মুখে আছি। কখন না জানি তুলে দিবে সেই চিন্তা করছি।’
রিপন মুর্মু বলেন, ‘এই চক্রটা শিবদাস ভট্টাচার্যের ফেলে যাওয়া প্রায় ২০ বিঘা ধানি জমি দখল করে আছে। অথচ ওই জমিও তাদের নয়। ঐটা খাস জমি, ভূমিহীনদের অধিকার। ওরা এখন আমাদের বসতভিটা থেকে উচ্ছেদ করে বাকি ১০ বিঘা জমিও দখলে নিতে চায়।’
তিনি বলেন, ‘গত পোরশু রাতে বাড়িতে আগুন দেওয়া হয়। তারপর সকালে থানায় অভিযোগ করি। কিন্তু সারাদিনেও পুলিশ আসেনি। সন্ধ্যায় একজন পুলিশ এসে দেখে গেছে। কিন্তু তারপর মামলা রেকর্ড করেনি। আমাদের কাছে পুলিশের ভূমিকা রহস্যজনক মনে হচ্ছে।’
তানোর থানার অফিসার ইনচার্জ (ওসি) মিজানুর রহমান বলেন, ‘জমি নিয়ে আদালতে মামলা চলমান। আমি জমিজমার বিষয়টা দেখি না। তারপরেও অভিযোগ যখন হয়েছে, তদন্ত করে ব্যবস্থা নেওয়া হবে।’
এ বিষয়ে অভিযুক্ত শরিফুল ইসলাম ভুলুর সঙ্গে যোগাযোগ করা যায়নি। আরেক অভিযুক্ত মোসারুল হক দুখু বলেন, ‘শরিফুল ইসলাম ভুলু ভালো লোক। আমরা তার মাঠের জমি চাষাবাদ করি। আদিবাসীদের ঘরবাড়িতে আগুন দেওয়ার কোনো ঘটনাই ঘটেনি। মিথ্যা অভিযোগ।’
তিনি দাবি করেন, সব জমির মালিক এখন শরিফুল ইসলাম ভুলু। ভারতে যাওয়া ব্যক্তির অর্পিত সম্পত্তি তার নামে কীভাবে হলো জানতে চাইলে মোসারুল বলেন, ‘শিবদাস ভারতে যাওয়ার আগে বিনিময় করেছিলেন। যার সঙ্গে তিনি বিনিময় করেন, তার কাছ থেকে শরিফুল জমি কিনেছেন। ভুল করে জমি অর্পিত সম্পত্তি হয়েছিল বলেও দাবি করেন তিনি।
মেসেঞ্জার/আনিসুজ্জামান/তুষার