ছবি : লিবিয়ায় জিম্মি থাকা খেজুরতলার যুবকদের স্বজনরা -টিডিএম।
চুয়াডাঙ্গার আলমডাঙ্গা উপজেলার ৩৭ জনকে মোটা অংকের বেতনের প্রলোভন দেখিয়ে ইতালি পাঠানোর কথা বলে লিবিয়ায় নিয়ে জিম্মি করেছে মানবপাচারকারি চক্র। জনপ্রতি আরও ২২ লাখ টাকা চাাঁদা দাবি করে এক বছর তাদের নির্যাতন করছে চক্রটি। জমিজমা বিক্রি করে টাকা দিয়েও রেহায় পাচ্ছে না অসহায় পরিবারগুলো। থানায় মামলা করেও মিলছে না প্রতিকার। লিবিয়ার বন্দিদশা থেকে সন্তানদের উদ্ধারে সরকারের সহযোগিতা চায় পরিবারগুলো।
আলমডাঙ্গা উপজেলার খেজুরতলা, বন্ডবিল ও ফরিদপুর গ্রামের এই ৩৭ জনের মধ্যে খেজুরতলা গ্রামের রয়েছেন ২৬ জন।
সরেজমিনে নির্যাতিতদের স্বজনদের খোঁজে ও তাদের প্রকৃত অবস্থা জানতে চুয়াডাঙ্গার আলমডাঙ্গা উপজেলার খেজুরতলা, বন্ডবিল এবং ফরিদপুর গ্রাম ঘুরে দেখা যায়, অজানা আতঙ্কে ভয় ও শোকে কাতর একটি জনপদ। লিবিয়ায় নিয়ে তাদের আপজনদের জিম্মি করে ভয়াবহ নির্যাতনের বর্ণনা তুলে ধরেন এ সময় সেখানে আটক হতভাগা যুবকদের বাড়ির লোকজন।
এ সময় উপস্থিত গণমাধ্যম কর্মীদের দেখে তাদের আর্তনাদে ভারি হয়ে ওঠে ওই এলাকার পরিবেশ। অবিলম্বে তাদের আপনজনদের দেশে ফিরিয়ে এনে মানবপাচারের সাথে জড়িতদের দৃষ্টান্তমূলক শাস্তির দাবি জানানো হয়।
এছাড়া সুষ্ঠু তদন্তের মাধ্যমে অভিযুক্তদের বিচার দাবীও করেন তারা। ভুক্তভোগীদের পক্ষে আলমডাঙ্গা থানায় ৭ জনকে আসামি করে একটি মামলা দায়ের করা হয়েছে।
আলমডাঙ্গা উপজেলার ফরিদপুর গ্রামের হারুন জানান, আমার মামাতো ভাই আলমডাঙ্গা উপজেলার নওদা বন্ডবিল গ্রামের শহীদুল ইসলামের ছেলে সজিব আহম্মেদকে গত বছরের জানুয়াির মাসে ১৫ লাখ টাকার বিনিময়ে ইতালিতে ভালো বেতনের চাকিরর প্রতিশ্রুতি দেন একই উপজেলার বেলগাছী গ্রামের জান্টু মেম্বারের ছেলে লিবিয়া প্রবাসী সাগর। সে মোতাবেক আমাদের পরিবারের সদস্যরা আলোচনা করে সাগরের বাবা জান্টু মেম্বার, সাগরের চাচাতো ভাই বেলগাছী গ্রামের জান্টুর ছেলে জীমের নিকট প্রথমে ১০ লাখ টাকা নগদ দেয়।
ওই সময় তাদের সাথে কথা হয়, কাগজপত্র প্রস্তুত হলে বাকী টাকা পরিশোধ করা হবে। ফেব্রুয়াির মাসে জান্টু মেম্বার ও জীম আমার মামাতো ভাই সজিব আহাম্মেদের লিবিয়া যাওয়ার কাগজপত্র আমাদের কাছে দেন।
ওই সময় তাদের কাছে জানতে চাওয়া হয় ইতালির কাগজপত্র না দিয়ে লিবিয়ায় যাওয়ার কাগজপত্র কেন? জীম ও জান্টু মেম্বার জানান, প্রথমে তাকে লিবিয়া নিতে হবে। এরপর লিবিয়া থেকে ইতালি নেয়া হবে।
আমরা তাদের কথায় সরল বিশ্বাসে সেই সময় আরও ৩ লাখ টাকা দিই। বাকী ২ লাখ টাকা ইতালি পৌঁছানোর পর দেয়া হবে বলে জানানো হয়। ফেব্রুয়ারী মাসে লিবিয়ায় পৌঁছানোর মাঝপথে জীম আরও ২ লাখ দাবী করেন।
জীম জানান, এখনই ২ লাখ টাকা না দিলে সজিবকে ইতালি পাঠানো সম্ভব না। আমরা উপায়ান্ত না পেয়ে বিভিন্ন স্থান থেকে ধার-কর্জ করে আরও ২ লাখ টাকা জীমের হাতে তুলে দিই।
কয়েকদিন পর ভিডিও কলের মাধ্যমে লিবিয়ার প্রবাসী জান্টু মেম্বারের ছেলে সাগর জানান, আরও ১০ লাখ টাকা দিতে হবে তা, না হলে সজিবের হাত পায়ের নখ উপড়ে ফেলা হবে। ভিডিও কলে সজীবের কাছে নির্যাতনের ভয়াবহতা সম্পের্ক আমরা অবগত হই।
এমতাবস্থায় আমরা উপায় না পেয়ে জীমের হাতে বিভিন্ন সময়ে আরও নগদ ৭ লাখ টাকা তুলে দিই। এখনও লিবিয়া থেকে সাগর বিভিন্ন সময় ফোনের মাধ্যমে আরও ২২ লাখ টাকার দাবী করে জানিয়েছেন, তোদের ছেলেকে বাঁচাতে চাইলে এই টাকা দিতে হবে।
হারুন আরও বলেন, পরবর্তীতে আমি সাগরের নিকট ফোন করে জানতে পারি আমার গ্রামের ১৯ ব্যক্তিসহ আশপাশের ৩৭ জনকে জিম্মি করেছে তারা। সাংবাদিকদের মাধ্যমে প্রশাসনের কাছে এর সুষ্ঠু বিচার চাই। সাগর দালাল, লিবিয়া থাকলেও আমি সম্পূর্ণ টাকা জীম, তার চাচাতো ভাই জীবন ও বেলগাছী গ্রামের ঠান্ডুর স্ত্রী স্কুল শিক্ষিকা বেদেনা খাতুন ও এই সিন্ডিকেটের মূলহোতা লিবিয়া প্রবাসী সাগরের বাবা জান্টু মেম্বারের কাছে দিয়েছি। আমি তাদেরকে আইনের আওতায় এনে সঠিক বিচারের দাবী জানাচ্ছি।
অপরদিকে, খেজুরতলা গ্রামের কল্পনা খাতুন জানান তার স্বামীকে পরিবারের সুখ ও স্বাচ্ছন্দের আশায় সাগর দালাল এর মাধ্যমে কথাবার্তা পাকাপাকি করে তার পিতা জান্টু মেম্বার ও মা আমেনা খাতুন এবং জীবনের হাতে চুক্তি অনুযায়ী প্রথমে ১৫ লাখ টাকা দেন।
এরপর ইতালি নেওয়ার কথা বলে লিবিয়ায় নিয়ে সাগর তাকে জিম্মি করে রাখে এবং বিভিন্ন সময় তাকে নির্যাতন করে ভয়াবহ নির্যাতনের ভিডিওচিত্র দেখিয়ে আমাকে কষ্ট আতঙ্কের মধ্যে ফেলে আরো কয়েক দফায় বিভিন্ন এনজিও এবং মানুষের কাছ থেকে লোন করে ৫৬ লাখ টাকা নিয়েছে এ পর্যন্ত এরপরও তাকে ইতালিতে না পাঠিয়ে আবারো আমার কাছে ২২ লাখ টাকা দাবি করছে ভিডিও কল করে আমাকে জানায় আগামী এক ঘন্টার মধ্যে ২২ লাখ টাকা দিবি নইলে তোর স্বামীকে আরও ভয়াবহ নির্যাতন করে মেরে ফেলবো।
এই অবস্থায় আমি একদিকে পাওনাদারের ভয়ে পালিয়ে বেড়াচ্ছি এবং ভয়ে ও ভীষণ আতঙ্কের মধ্যে রয়েছি।
বর্তমানে জিম্মি করা ৩৭ পরিবারের অবস্থা খুবই ভয়াবহ। টাকার অভাবে তারা খাবার পর্যন্ত কিনে খেতে পারছে না।
অভিযুক্তদের নামে মামলা করলেও আলমডাঙ্গা থানা পুলিশ কেবলমাত্র জীবনকে গ্রেপ্তার করেছে। এ মামলায় আসামীদের সবাই আদালত থেকে জামিন হয়ে গেছে। আসামিরা লিবিয়ায় সাগরের হাতে জিম্মি ৩৭ যুবককে এবং তাদের স্বজনদের মেরে ফেলার হুমকি দিয়ে যাচ্ছে। এ কারণে তারা ভীষণ শংকিত ও আতঙ্কগ্রস্থ হয়ে পড়েছেন বলেও জানান।
উল্লেখ্য, গত ১১ ডিসেম্বর মানব পাচার প্রতিরোধ ও দমন আইনে আলমডাঙ্গা উপজেলার বিভিন্ন গ্রামের ভুক্তভোগী পরিবারের ২২ ব্যক্তির পক্ষে আলমডাঙ্গা খেঁজুরতলা গ্রামের মরহুম মঙ্গল মন্ডলের ছেলে রেজাউল হক বাদী হয়ে আলমডাঙ্গা থানায় একটি মামলা দায়ের করেন। মামলায় আসামী করা হয়েছে একই উপজেলার বেলগাছী গ্রামের ঠান্ডুর ছেলে জীম, জান্টুর ছেলে জীবন ও সাগর, জান্টু মেম্বারের স্ত্রী আমেনা খাতুন, মরহুম ইয়াছিন মালিথার দু’ছেলে ছেলে ঠান্ডু ও জান্টু মেম্বার এবং ঠান্ডুর স্ত্রী বেলগাছী মাধ্যমিক বিদ্যালয়ের স্কুল শিক্ষিকা বেদেনা খাতুনকে।
নাগদাহ ইউনিয়নের খেজুরতলা গ্রামের আল মামুন বলেন, তার ছেলেকে ইতালী নিয়ে যাওয়ার কথা বলে লিবিয়ায় নিয়ে এক বছর ধরে আটক রেখে নির্যাতন করছে তার হাত পায়ের নখ তুলে ফেলেছে তাকে খেতে দেয় না। এখন ২২ লাখ টাকা দাবি করছে আমরা গরিব মানুষ অত টাকা কোথায় পাব? আমরা আমাদের ছেলেকে ফেরত চাই।
একই গ্রামের আব্বাস আলী বলেন, আমার ছেলেকে পাঠানোর জন্য বেলগাছি গ্রামের সাগর দালালের সাথে আমাদের ১৩ লক্ষ টাকার কথা হয়, প্রথমে ১০ লাখ টাকা দিতে হবে পরে ওখানে যে তিন লাখ টাকা দিতে হবে এবং আরো কথা হয় তাকে ইতালি নিয়ে যাবে কিন্তু তাকে ইতালি না নিয়ে লিবিয়ায় আটকিয়ে রেখে সেখানে নির্যাতন করছে এর মধ্যে নিয়ে যাওয়ার আগেই আমার কাছ থেকে আরও তিন লাখ টাকা নিয়েছে এখন আরও ২২ লাখ টাকা দাবি করছে।
জালাল উদ্দিন বলেন, খেজুরতলা গ্রামের জন জন ছেলেরই একই অবস্থা। তাদেরকে যেয়ে আটকিয়ে রেখে মারধর করছে তাদেরকে আবার ২০/২২ লাখ টাকা করে চাচ্ছে তাদের টাকা সব শোধ করে নিয়েছে, গ্রামবাসী হিসেবে আমরা এই ঘটনার নিন্দা জানাই এবং তাদেরকে তাদের বাড়িতে ফিরিয়ে দেয়ার জন্য দাবি জানাচ্ছি।
বয়োবৃদ্ধ মোহাম্মদ আলী বলেন, আমাদের গ্রামের ছেলেগুলোকে নিয়ে যেয়ে নির্যাতন করছে। ১৫ লাখ টাকা নিয়েছে আরও টাকা চাচ্ছে। তাদেরকে মারধর করছে খেতে দিচ্ছে না। আবার এখন ২০ লাখ টাকা দাবি করছে।
রশিদুল হক বলেন, তাদেরকে নিয়ে যেয়ে হাতের চারা তুলে ফেলেছে। তাদেরকে মারধর করছে খেতে দিচ্ছে না। আরো টাকা দাবি করছে আমরা আমাদের গ্রামের ছেলেদেরকে ফেরত পেতে চাই।
আলমগীর হোসেন বলেন, তার নাতি ছেলে হুসাইনকে ইতালি পাঠানোর জন্য পার্শ্ববর্তী বেলগাছি গ্রামের জান্টু মেম্বারের ছেলে সাগর দালালের সাথে তার ১২ লাখ টাকায় চুক্তি হয়। সেই মোতাবেক তাকে প্রথমে ১০ লাখ টাকা দিতে হবে এবং ওখানে যাওয়ার পর দুই লাখ টাকা দেওয়া লাগবে। কিন্তু সে এখান থেকেই ১২ লাখ টাকা নিয়ে তার নাতিছেলেকে ইতালি না নিয়ে লিবিয়ায় নিয়ে জিম্মি করে রেখে তাকে নির্যাতন করছে এবং আরো ২২ লাখ টাকা দাবি করছে।আমরা সাগর দালালের মাধ্যমে আমাদের ছেলেদেরকে পাঠাই।
নুর বানু খাতুন বলেন, প্রথমে ১০ লাখ টাকা চাই, ১০ লাখ টাকা দিলে তাদের ইতালি পার করে দেবে। পার করার আগেই দাবি করে আরও দুই লাখ টাকা দিতে হবে। তাকে আমরা আরও ২ লাখ টাকা দিই। এরপরে তাকে লিবিয়ায় নিয়ে নির্যাতন করছে মারধর করছে এখন বলছে ২২ লাখ টাকা দিতে হবে। আমরা কোথায় পাবো আমরা সরকারের কাছে আবেদন জানাই আমাদের ছেলেদেরকে ফিরিয়ে এনে দেয়া হোক।
রাজিয়া বেগম বলেন, এক বছর হলেও নিয়ে গিয়েছে এখন পনের ১৩ লাখ টাকা কন্টাক্ট ছিল আমরা ১৩ লাখ টাকা দিয়েছি এখন আবার আরো বাইশ লাখ টাকা দাবি করছে আমরা খুব গরিব মানুষ, এত টাকা কোথায় পাব আমরা। তাদেরকে টাকার দাবিতে নির্যাতন করছে হাত পায়ের নখ তুলে ফেলছে আমরা সরকারের কাছে দাবি জানাই তাদেরকে বাড়িতে ঘুরিয়ে এনে দিক।
আব্দুল মজিদ বলেন, টাকার দাবিতে তাদেরকে মারধর করছে একবার বলেছে ১০ লাখ এখন আবার বলছে ২০ লাখ টাকা কিন্তু আমরা তো অত টাকা দিতে পারব না।
খেজুরতলা গ্রামের মাঝপাড়া জামে মসজিদের ইমাম মো. জালাল উদ্দিন বলেন, আমাদের গ্রামের গরীব মানুষ তারা দেনা দায় করে, লোন তুলে ১৩ লাখ টাকা বন্দোবস্ত করে এক বছর আগে তাদের ছেলেদেরকে পাঠাই ইতালি। কিন্তু সেখানে না নিয়ে তাদেরকে লিবিয়া নিয়ে আটক রেখে মারধর করছে খেতে তো দিচ্ছে না, আবার শুনছি এখন নতুন করে ২২ লাখ টাকা চাচ্ছে।
চুয়াডাঙ্গার পুলিশ সুপার খন্দকার গোলাম মওলা বলেন, মানবপাচার প্রতিরোধ আইনে আলমডাঙ্গা থানায় একটি মামলা দায়ের করা হয়েছে। মামলা হওয়ার পরপরই পুলিশ একাধিকবার অভিযান পরিচালনা করা হয়েছে। আসামীদেরকে খুঁজে বের করার চেষ্টা চলছে। এবং এ ব্যাপারে পুলিশি তৎপরতা অব্যাহত আছে। আমরা অবিলম্বে তাদেরকে আটক করতে সমর্থ হবো। জানতে পেরেছি তাদেরকে ইতালি নেওয়ার পথে প্রথমে দুবাই নেওয়া হবে এবং সেখান থেকে সরাসরি তালি নেওয়া হবে কিন্তু তারা সেটা না করে আলমডাঙ্গার ঐ ছেলেগুলোকে লিবিয়ায় নিয়ে আটক রেখে তাদেরকে মারধর করছে টাকা দাবি করছে। আমাদের পুলিশ তৎপর আছে প্রয়োজন হলে পরে সিআইডির কাছে এই মামলাটি দিয়ে তাদের সহযোগিতা চাওয়া হবে।
চুয়াডাঙ্গা জেলা প্রশাসক মো. জহিরুল ইসলাম বলেন, বিষয়টা আমি শুনেছি যে আলমডাঙ্গা একই গ্রামের অনেকগুলো যুবককে একটি চক্র ইতালি নেওয়ার কথা বলে তাদেরকে আটক রাখা হয়েছে এবং বিভিন্ন সময় তাদেরকে আরও প্রেরনের জন্য চাপ দেয়া হচ্ছে। আমি এটি পুলিশ সুপারের সাথে আলোচনা করেছি ইতিমধ্যে মামলা হয়েছে। আমি বলব প্রবাসে যাওয়ার ক্ষেত্রে সবাইকে আরো সতর্ক হতে হবে। এ ক্ষেত্রে জেলা পর্যায়ে সরকারি দপ্তর আছে, প্রবাসী কল্যাণ মন্ত্রণালয়ের যে অফিসগুলো আছে তাদের সাথে যোগাযোগ করা প্রয়োজন। তারপরও যেহেতু ঘটনা ঘটেছে আমি আশা করব পুলিশ খুব শীঘ্রই তাদেরকে গ্রেপ্তার করে আওতায় নিয়ে আসবে।
মেসেঞ্জার/লিটন/তুষার