ঢাকা,  শুক্রবার
৩১ জানুয়ারি ২০২৫

The Daily Messenger

‘য়োকরাল’ কীটনাশকে পুড়েছে অর্ধশত বিঘা জমির পেঁয়াজ

মেহেরপুর প্রতিনিধি

প্রকাশিত: ২০:৪০, ২৫ জানুয়ারি ২০২৫

‘য়োকরাল’ কীটনাশকে পুড়েছে অর্ধশত বিঘা জমির পেঁয়াজ

ছবি : মেসেঞ্জার

মেহেরপুরের মুজিবনগর উপজেলায় কয়েকটি গ্রামে মানহীন কীটনাশক ব্যবহার করে প্রায় ৬০ বিঘার জমির পেঁয়াজ পুড়ে গেছে বলে অভিযোগ করেছেন কৃষকরা। মার্সাল এগ্রোভেট কেমিক্যাল ইন্ড্রাষ্ট্রিজ লি: নামের একটি কোম্পানীর ‘য়োকরাল’ নামক বালাইনাশক (পেস্টিসাইড) পেঁয়াজ ক্ষেতে ব্যবহার করে পথে বসতে যাচ্ছেন উপজেলার অর্ধশতাধিক চাষী। পাঁচ/ছয়দিন আগে কৃষকরা স্থানীয় সার কীটনাশক ব্যবসায়ীদের কাছ থেকে ‘য়োকরাল’ নামক এই ছত্রাকনাশক (পেস্টিসাইড) তাঁদের জমির উঠতি পেঁয়াজের পঁচন রোধে দিয়েছিলেন।

গত শুক্রবার (২৪ জানুয়ারি) দুপুরে সরেজমিনে মুজিবনগরের নাজিরাকোনা গ্রামের নাগার মাঠসহ এলাকার বিভিন্ন মাঠে গিয়ে দেখা গেছে, এলাকার প্রায় অর্ধশতাধিক কৃষকের প্রায় জমির পেঁয়াজ খেত এখন জমিতেই লুটিয়ে পড়েছে। পেঁয়াজ গাছের কলি হলুদ হয়ে চুপসে যাচ্ছে। ডগা শুকিয়ে লুটিয়ে পড়ছে মাটিতে। পাশের জমির পেঁয়াজ গাছ বড় হয়ে গেলেও আক্রান্ত জমির পেঁয়াজ রয়েছে মাটির সাথে সুয়ে। এবারের শীত মৌসুমে এমন পরিস্থিতিতে পড়েছেন মুজিবনগর উপজেলার নাজিরাকোনা, শিবপুর, ভবরপাড়া, কেদারগঞ্জ, মানিকনগর গ্রামের অর্ধ শতাধিক কৃষক।

তাঁদের অভিযোগ, স্থানীয় ব্যবসায়ীদের পরামর্শে পেঁয়াজের ছত্রাকজনিত রোগ থেকে বাঁচতে মার্সাল এগ্রোভেট কেমিক্যাল ইন্ড্রাষ্ট্রিজ লি: এর ‘য়োকরাল’ নামক বালাইনাশক (পেস্টিসাইড) প্রয়োগের পরেই এ অবস্থা হয়েছে পেঁয়াজ ক্ষেতের। স্থানীয় কৃষকের মতে, প্রায় অর্ধশত বিঘা জমির পেঁয়াজ নষ্ট হয়ে যাওয়ায় কয়েক লক্ষ টাকা ক্ষতি হতে পারে।

নাজিরাকোনা গ্রামের পেঁয়াজ চাষী আবুল হোসেন জানান, বর্গা নেওয়া এক বিঘা জমিতে চাষ করছেন পেঁয়াজ। জানুয়ারি মাসের শুরুর দিকে পেঁয়াজ খেত ছত্রাকজনিত রোগ থেকে বাঁচাতে স্থানীয় ব্যবসায়ীর পরামর্শে য়োকরাল নামের ওই বিষ দেওয়া হয়। এর পর থেকেই হলুদ হয়ে মাটিতে লুটিয়ে পড়ছে পেঁয়াজ গাছ। এমন অবস্থায় অসহায় হয়ে পড়েছেন তিনি। তিনি জানান, ইতোমধ্যে আমার ৮০ থেকে ৯০ হাজার টাকা খরচ হয়ে গেছে। ধার দেনা করে এক বিঘা জমিতে এই চাষ করেছেন তিনি। পেঁয়াজ নষ্ট হয়ে যাওয়ায় চরম বিপদের মধ্যে আছেন তিনি। পেঁয়াজ বিক্রি করে এবছর তার প্রায় আড়াই থেকে তিন লাখ টাকা হতো বলে জানান তিনি।

একই গ্রামের আফর আলীর এক বিঘা জমিতে, আব্দুল আলীম এক বিঘা হাফিজুল ইসলামের এক বিঘা, অ্যাডভোকেট আ্ব্দুল আলীমের এক বিঘা, শহিদুল ইসলামের এক বিঘা জমি, জনি মন্ডলের ৫ বিঘা জমির পেঁয়াজের মধ্যে ২ বিঘা জমিসহ এই গ্রামের প্রায় ১৫ জন কৃষকের প্রায় ৩০ বিঘা জমিতে এই ছত্রাক নাশক কীটনাশকটি প্রয়োগ করে সব পেঁয়াজ ক্ষেত নষ্ট হয়ে গেছে।

শিবপুর গ্রামের কৃষক হিরন আলী জানান, আমি প্রতি বছরই পেঁয়াজের চাষ করি। এবছরও আমি তিন বিঘা জমিতে এই চাষটি করেছি। এছাড়া আমার ভাই হাফিজুল ইসলামেরও তিন বিঘা এবং রকিবুল সর্দারের এক বিঘা জমির পেঁয়াজ ক্ষেতে এই কীটনাশকটি ব্যবহার করেছিলাম। আমাদের মাঠে আরও বেশ কয়েকজন পেঁয়াজ চাষীর ক্ষেতে এই কীটনাশকটি স্প্রে করে পেঁয়াজের চারা এখন ধুকে ধুকে মরছে।

এছাড়া বল্লভপুর গ্রামের পেঁয়াজ চাষী জাহিদুল ইসলাম জানান, আমিসহ এলাকার বেশ কয়েকজন চাষী পেঁয়াজ ক্ষেতে মার্সাল এগ্রোভেট কেমিক্যাল ইন্ড্রাষ্ট্রিজ লি. এর নি¤œমানের য়োকরাল নামক বালাইনাশক (পেস্টিসাইড) প্রয়োগের পরেই এ অবস্থা হয়েছে।

নাজিরাকোনা গ্রামের আবুল হোসেন, হাফিজুল ইসলাম শুধু নয়, এই উপজেলার কয়েকটি গ্রামের আরও অর্ধশতাধিক কৃষক একই পরিস্থিতে পড়েছেন। ‘য়োকরাল’ নামের কীটনাশকটি ব্যবহার করার দুই-তিন দিন পর থেকেই পেঁয়াজের গাছগুলো শুকিয়ে যাওয়া শুরু করে। শেকড়ে পচন ধরে সব শেষ হয়ে গেছে। ধারদেনা করে আবাদ করা জমির ফসল নষ্ট হয়ে যাওয়ায় এখন দিশেহারা হয়ে পড়েছেন এসব কৃষক। এখন ওই কোম্পানির কাছ থেকে ক্ষতিপূরণ চান ক্ষতিগ্রস্ত কৃষকেরা।

কৃষকদের অনেকেই স্থানীয় উপসহকারী কৃষি কর্মকর্তাদের বিরুদ্ধে অভিযোগ করে বলেন, কৃষি কর্মকর্তারা যদি মাঠে আসতেন, পরামর্শ দিতেন, তাহলে এই অবস্থা হতো না।

কীটনাশক কোম্পানির নাজিরাকোনা গ্রামের সার ও কীটনাশক ব্যবসায়ী আব্দুল জব্বার জানান, মার্সাল এগ্রোভেট কেমিক্যাল ইন্ড্রাষ্ট্রিজ লি. এর ‘য়োকরাল’ ব্যবহারের পর এ রকম অভিযোগ আসছে সব জায়গা থেকে। তিনি বলেন, ইতোমধ্যে, ওই কোম্পানীর স্থানীয় ডিলার ও কোম্পানীর উর্দ্ধতন কর্মকর্তারা মাঠে এসে কৃষকদের ফসলের নমুনা সংগ্রহ করেছেন। তারা ক্ষতিগ্রস্থ কৃষকদের ক্ষতি পুরণ দেওয়ারও প্রতিশ্রুতি দিয়েছেন।

মার্সাল এগ্রোভেট কেমিক্যাল ইন্ড্রাষ্ট্রিজ লি. এর টেরিটরি অফিসার আসাদুল ইসলাম বলেন, এখন পর্যন্ত আমার কাছে এলাকার ২০ জন কৃষক তাঁদের ৩৩ বিঘা জমির পেঁয়াজ ক্ষেত নষ্ট হয়েছে বলে অভিযোগ দিয়েছেন। আমি বিষয়টি উর্দ্ধতন কর্মকর্তাদের জানালে কোম্পানীর প্রধান কার্যালয় থেকে কয়েকজন উর্দ্ধতন কর্মকর্তা এলাকায় সরেজমিন পরিদর্শন করেছেন। ক্ষতিগ্রস্থ পেঁয়াজ চাষীয়দের সাথে কথা বলেছেন এবং পেঁয়াজের স্যাম্পল পরিক্ষার জন্য নিয়ে গেছেন।

মেহেরপুর কৃষি সম্প্রসারণ অধিদপ্তরের উপপরিচালক (ডিডি) বিজয় কৃষ্ণ হালদার বলেন, ‘বিষয়টি আমার জানা নেই। আমাদের কাছে কৃষকেরা অভিযোগ করেনি। অভিযোগ করলে ব্যবস্থা নেওয়া হবে।

এদিকে, হাতে গোনা কয়েকটি কীটনাশক কোম্পানী ছাড়া অধিকাংশ মানহীন বালাইনাশকের (পেস্টিসাইড) কারণে আর্থিক ক্ষতির মুখে পড়ছেন এলাকার কৃষকরা। আবার ডিলারনির্ভর ব্যবসায়ীরা অতিরিক্ত মুনাফার আশায় মানহীন বালাইনাশক (পেস্টিসাইড) ভুল ব্যাখ্যা দিয়ে কৃষকদের মাঝে বিপনন করছেন। যার ফলে প্রায়শই কৃষকরা নানা রকমের ক্ষতির শিকার হচ্ছেন।

মেসেঞ্জার/চান্দু/তুষার