ঢাকা,  বুধবার
১২ ফেব্রুয়ারি ২০২৫

The Daily Messenger

চট্টগ্রাম আইআইইউসিতে কওমিপন্থী দশ শিক্ষককে অব্যাহতি : তোলপাড়

পটিয়া প্রতিনিধি, চট্টগ্রাম

প্রকাশিত: ১৫:৪২, ১২ ফেব্রুয়ারি ২০২৫

চট্টগ্রাম আইআইইউসিতে কওমিপন্থী দশ শিক্ষককে অব্যাহতি : তোলপাড়

ছবি ক্যাপশন: অব্যাহতি পাওয়া ১০ কওমী শিক্ষক -টিডিএম।

আন্তর্জাতিক ইসলামী বিশ্ববিদ্যালয় চট্টগ্রামে (আইআইইউসি) শিক্ষকতার পদ থেকে কোনো কারণ দর্শানো ছাড়াই বিশ্বের বিভিন্ন বিশ্ববিদ্যালয়ের সেরা গ্রেজুয়েট কওমি আলেমদেরকে অন্যায়ভাবে অব্যাহতি দেওয়া হয়েছে।

গত (২৯ জানুয়ারি) বিশ্ববিদ্যালয়ের রেজিস্ট্রার কর্নেল মোহাম্মদ কাশেম, পিএসসি (অবঃ) স্বাক্ষরিত এক পৃথক চিঠিতে এ অব্যাহতি দেওয়ার বিষয়টি জানানো হয়।

পাঠানো একটি চিঠির অনুলিপিতে উল্লেখ রয়েছে, বর্তমানে বিশ্ববিদ্যালয়ে আপনার সার্ভিসের প্রয়োজন নেই বিধায় সূত্রে উল্লিখিত সভার সিদ্ধান্তক্রমে আপনাকে বিশ্ববিদ্যালয়ের চাকুরি থেকে অব্যাহতি প্রদান করা হলো।

আপনার এই অব্যাহতি আদেশ ১ ফেব্রুয়ারি ২০২৫ তারিখ থেকে কার্যকর করা হলো। তবে, আপনাকে তিন মাসের (ফেব্রুয়ারি, মার্চ ও এপ্রিল-২০২৫) বেতন বিশ্ববিদ্যালয় থেকে প্রদান করা হবে। চিঠিতে আরও বলা হয়, আপনার বিভাগসহ সংশ্লিষ্ট অফিসসমূহ থেকে ১২ ফেব্রুয়ারি ২০২৫ তারিখের মধ্যে অনাপত্তি সংক্রান্ত প্রত্যয়নসহ পূরণকৃত Clearance Form পাওয়া সাপেক্ষে অত্র অফিস থেকে আপনাকে অব্যাহতি পত্র (Release Letter) প্রদান করা হবে।

অব্যাহতির ঘটনায় সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমসহ সর্বত্র তোলপাড় সৃষ্টি হয়েছে। সর্বপ্রকার যোগ্যতা ও দক্ষতা থাকা সত্ত্বেও শুধুই কওমি মাদরাসা থেকে উঠে আসায় এবং জামায়াতের রাজনীতির সাথে সম্পৃক্ত না থাকার অপরাধে তাদের বাদ দেওয়া হয়েছে বলে অভিযোগ উঠেছে। অবৈধ নিয়োগের কথা বলা হলেও অব্যাহতি পাওয়া শিক্ষকরা বলছেন, সমস্ত নিয়মকানুন মেনে নিয়োগ বিজ্ঞপ্তি, লিখিত ও ভাইভা পরীক্ষা দিয়েই তাদের নিয়োগ দেওয়া হয়েছিল। নদভী আমলের বলে শুধু কওমি ব্যাকগ্রাউন্ডের কারণেই তাদের ছাটাই করা হয়েছে। এনিয়ে কওমি সমর্থকদের মাঝে ক্ষোভ বিরাজ করছে। শুধু তাই নয়, সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমে অব্যাহতিপ্রাপ্তদের সংশ্লিষ্ট বিভাগসমূহের অধ্যয়নরত শিক্ষার্থীদের মাঝেও ব্যাপক ক্ষোভ ও উত্তেজনা পরিলক্ষিত হয়েছে। এরাবিক ক্লাবসহ কয়েকটি ক্লাব থেকে বিশ্ববিদ্যালয়ের অথরিটির এহেন সিদ্ধান্তের তীব্র নিন্দা বিবৃতি লক্ষ করা গেছে।

অব্যাহতি পাওয়া ১০ শিক্ষক হলেন, ড. মাওলানা আব্দুস সালাম রিয়াদী, (পিএইচডি, রিয়াদ বিশ্ববিদ্যালয়, সৌদি আরব) প্রভাষক, কোরানিক সায়েন্সেস এন্ড ইসলামিক স্টাডিজ। মাওলানা হারুন আজিজি নদভী, (গ্রেজুয়েট, নদওয়াতুল উলামা, লক্ষনৌ ভারত, মাস্টার্স, আইআইইউসি) প্রভাষক, কুরআনিক সায়েন্সেস এন্ড ইসলামিক স্টাডিজ। মাওলানা মোহাম্মদ শাহাদাত হোসাইন, (অনার্স, মাস্টার্স ও এমফিল গবেষক, চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয়) প্রভাষক, কোরানিক সায়েন্সেস এন্ড ইসলামিক স্টাডিজ। মাওলানা মিসবাহ উদ্দিন মাদানী, (গ্রাজুয়েট, মদীনা ইসলামি বিশ্ববিদ্যালয় ও মাস্টার্স, আইআইইউসি) প্রভাষক, কোরানিক সায়েন্সেস এন্ড ইসলামিক স্টাডিজ। ড. শুয়াইব রশীদ মাক্কী (হজের খুতবার বাংলা অনুবাদক), (পিএইচডি, উম্মুল কুরা বিশ্ববিদ্যালয়, মক্কা, সৌদিআরব) প্রভাষক, দাওয়াহ এন্ড ইসলামিক স্টাডিজ। মাওলানা এহতেশামুল হক মাদানী, প্রভাষক, সায়েন্সেস অব হাদিস এন্ড ইসলামিক স্টাডিজ। মাওলানা যুহাইর ফুরকান, (গোল্ডমেডেলিস্ট ও এমফিল গবেষক, চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয়) প্রভাষক, আরবি ভাষা ও সাহিত্য। মাওলানা কাউসার মাহমুদ, (এমফিল গবেষক, চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয়) প্রভাষক, আরবি ভাষা ও সাহিত্য। ড. আসেম মক্কী, (অনার্স, মাস্টার্স ও পিএইচডি, উম্মুল কুরা বিশ্ববিদ্যালয়, মক্কা, সৌদিআরব) প্রভাষক, সায়েন্সেস অব হাদিস এন্ড ইসলামিক স্টাডিজ ও ড. আবদুর রহিম, (অনার্স, মাস্টার্স, আইআইইউসি, পিএইচডি, কিং আব্দুল আজীজ বিশ্ববিদ্যালয়, সৌদি আরব) প্রভাষক, দাওয়াহ এন্ড ইসলামিক স্টাডিজ।

জানা গেছে, ২০২১ সালের ১ মার্চ শিক্ষা মন্ত্রণালয় কর্তৃক আইআইইউসির প্রতিষ্ঠাতার ছেলে, বায়তুশ শরফের বর্তমান পীর মাওলানা আব্দুল হাই নদভীকে সদস্য ও আবু রেজাকে সভাপতি করে বোর্ড অব ট্রাস্টিজ গঠনের অনুমোদন দেওয়া হয়।

২০২২ সালের ২৮ জুন তারিখের বিভিন্ন দৈনিক পত্রিকা ও বিশ্ববিদ্যালয় ওয়েবসাইটে শিক্ষক-কর্মকর্তা-কর্মচারী নিয়োগের সার্কুলার প্রকাশ করা হয়। যাতে ৫ দিন সময় দিয়ে আবেদন আহ্বান করা হয়। সার্কুলারের ভিত্তিতে নতুন এডহক শিক্ষকবৃন্দ এবং বাহির থেকে আরো অনেকেই আবেদন করেন। নিয়মতান্ত্রিক রিটেন ও ভাইভা পরীক্ষায় উত্তীর্ণ হয়ে ২০২২ সালের ৩০ জুলাই তারিখে অনুষ্ঠিত বিশ্ববিদ্যালয়ের ২৪২তম সিন্ডিকেট মিটিং-এ অনুমোদন সাপেক্ষে নির্বাচিত শিক্ষকদেরকে স্থায়ী নিয়োগপত্র প্রদান করা হয়, যা বিশ্ববিদ্যালয় মঞ্জুরি কমিশন (ইউজিসি) কর্তৃকও অনুমোদিত হয়ে আসে।

তারা নিয়মিত দক্ষতার সাথে শিক্ষকতা করে আসছিলেন। কিন্তু জুলাইয়ের বৈষম্যবিরোধী ছাত্র আন্দোলনের পর আওয়ামী লীগের সাবেক এমপি আবু রেজা নদভী আত্মগোপনে চলে গেলে আ ন ম শামসুল ইসলাম পুনরায় বিশ্ববিদ্যালয়ের চেয়ারম্যান হন। গত ২০২৪ সালের নভেম্বর মাসে জামাতপন্থী বর্তমান প্রশাসন নতুনভাবে শিক্ষক-কর্মকর্তা-কর্মচারীর চাহিদা দেখিয়ে সার্কুলার প্রকাশ করে।

জামাতপন্থী প্রশাসন আবু রেজা নদভীর আমলে যথাযথ প্রক্রিয়ায় নিয়োগ পাওয়া সকল শিক্ষককেও পুনরায় আবেদন করতে বাধ্য করে।

এরপর রিটেন-ভাইভা'র নামে প্রহসন করে তাদের পছন্দের লোক নিয়োগ দেয়। তারা যোগ্যতা ও মেধার পরিবর্তে দলীয় ব্যাকগ্রাউন্ড ও আত্মীয়তাকে প্রাধান্য দেয়। অপরদিকে নদভী প্রশাসন কর্তৃক নিয়োগপ্রাপ্ত শিক্ষকগণ বাধ্য হয়ে পুনরায় আবেদন করে রিটেন পরীক্ষায় উত্তীর্ণ হয়। এরপর ভাইভাতে ভালো করার পরেও জামাতের দলীয় ব্যাকগ্রাউন্ড না থাকায় উল্লেখযোগ্য একটি অংশকে অব্যাহতিপত্র ধরিয়ে দেওয়া হয়।

বাদ পড়া শিক্ষক আবদুস সালাম রিয়াদী জানান, আমাদের সম্পূর্ণ অন্যায়ভাবে অব্যাহতি দেওয়া হয়েছে। বৈষম্যের বিরুদ্ধে যুদ্ধ করে জাতি স্বাধীনতা ছিনিয়ে আনলেও আমাদের ওপর বৈষম্য করা হয়েছে।

মাওলানা মিসবাহ উদ্দিন মাদানী জানান, কওমি অঙ্গনে প্রচণ্ড ক্ষোভ প্রকাশ পাওয়ার কারণ হলো, আবু রেজার আমলে নিয়োগপ্রাপ্তদের মধ্যে যারা কওমি ও নন-জামাতি তাদের একজনকেও রাখা হয়নি। অথচ একই সময়ে নিয়োগপ্রাপ্তদের মধ্যে এমন অনেকেই আছেন, যারা শুধুমাত্র জামাত সমর্থক অথবা ট্রাস্টি মেম্বারদের কারও না কারও আত্মীয় হওয়ার সুবাদে স্বীয় পদে বহাল আছেন।

এভাবে মেধার মূল্যায়ন প্রতিষ্ঠার লক্ষ্যে সংগঠিত কোটাবিরোধী জুলাই বিপ্লবকে চরম কলঙ্কিত করলো আইআইইউসির বর্তমান প্রশাসন।

বৈষম্যহীন নতুন বাংলাদেশে দলীয় ও আত্মীয় কোটায় শিক্ষক নিয়োগ দিয়ে মেধাকে অবমূল্যায়ন করায় বিশ্ববিদ্যালয়ের সাধারণ ছাত্র, সারাদেশের মানুষ, বোদ্ধামহল ও বিশেষভাবে কওমি অঙ্গনে ব্যাপক নিন্দা ও সমালোচনার ঝড় সৃষ্টি হয়। প্রতিষ্ঠানকে দলীয়করণের অভিযোগ এসেছে চট্টগ্রামের আন্তর্জাতিক ইসলামী বিশ্ববিদ্যালয়ের বর্তমান জামাত সমর্থক প্রশাসনের বিরুদ্ধে।

এ প্রসঙ্গে আন্তর্জাতিক ইসলামি বিশ্ববিদ্যালয় চট্টগ্রামের রেজিস্ট্রার কর্নেল মোহাম্মদ কাশেমকে ফোন দেওয়া হলে তার নম্বরটি বন্ধ পাওয়ায় বক্তব্য জানা সম্ভব হয়নি।

মেসেঞ্জার/রানা/তুষার