ঢাকা,  শনিবার
২২ ফেব্রুয়ারি ২০২৫

The Daily Messenger

বান্দরবানের বেতছড়া হাইস্কুল

সরকারি ভবন হেডম্যানের দখলে, পাঠদান চলে ইউনিয়ন পরিষদ কার্যালয়ে!

টিংশৈপ্রু মংটিং, বান্দরবান

প্রকাশিত: ১৫:৩৬, ১৮ ফেব্রুয়ারি ২০২৫

সরকারি ভবন হেডম্যানের দখলে, পাঠদান চলে ইউনিয়ন পরিষদ কার্যালয়ে!

ক্যাপশন: তারাছা ইউনিয়ন পরিষদ ভবনে চলছে পাঠদান - টিডিএম।

১৯৯২ সালে কাঁচা একটি ঘরে যাত্রা শুরু হয় বান্দরবানের রোয়াংছড়ি উপজেলার বেতছড়া হাইস্কুলের। এর এক বছর আগে ১৯৯১ সালে ইউনিয়নটির বেতছড়া বাজার ঘেঁষা খাস ভূমিতে স্কুলটির জন্য জায়গা নির্ধারণ করা হয়। পরবর্তীতে উন্নত পরিবেশে শিক্ষা কার্যক্রম পরিচালনার সুবিধার্থে স্কুলের জায়গায় ২০০৬-৭ অর্থ বছরে একটি একতলা ও ২০০৮-৯ অর্থবছরে আরেকটি দোতলা ভবন করে দেয় বান্দরবান পার্বত্য জেলা পরিষদ। তবে মৌজাটির বর্তমান হেডম্যান হ্রাথোয়াইহ্রী মারমার বিরুদ্ধে দুটি ভবনই দখলের অভিযোগ করেন স্থানীয় ও স্কুল সংশ্লিষ্টরা। বিভিন্ন সময় আলোচনা এলেও হ্লাথোয়াইহ্রীর কারণে শেষ পর্যন্ত এমপিওভুক্ত হয়নি প্রতিষ্ঠানটি। ভবন বেদখল ও অর্থাভাবসহ বিভিন্ন কারণে বেশ কয়েকবার বন্ধ ছিল শিক্ষা কার্যক্রম। অবশ্য ২০২৩ সালের শেষ দিকে শিক্ষা কার্যক্রম পরিচালনার জন্য তারাছা ইউনিয়ন পরিষদ ভবনে তিনটি কক্ষ ব্যবহারের অনুমতি দিয়েছেন চেয়ারম্যান উনুমং মারমা।

স্কুলসংশ্লিষ্টরা বলছেন, ১৯৯০ সালে বেতছড়া হাইস্কুলসহ জেলার ১৮টি বেসরকারি হাইস্কুল অনুমোদন দেয় তৎকালীন স্থানীয় সরকার পরিষদের (বর্তমান নাম বান্দরবান পার্বত্য জেলা পরিষদ) চেয়ারম্যান সাচিংপ্রু জেরী। এর পর ১৯৯১ সালে খাসজমিতে স্কুলটির জন্য জায়গা নির্ধারণ করে দেন তৎকালীন হেডম্যান ও হ্লাথোয়াইহ্রীর বাবা অংসাপ্রু মারমা। এ পরিপ্রেক্ষিতে ১৯৯২ সালে বেতছড়া হাইস্কুল প্রতিষ্ঠা ও পাঠদান যাত্রা শুরু হয়। সে সময় এ স্কুলটি উদ্বোধনও করেন সাচিংপ্রু জেরী।

পরবর্তীতে ২০০৬-৭ অর্থবছরে একটি একতলা ও ২০০৮-৯ অর্থবছরে আরেকটি দোতলা ভবন করে দেয় পার্বত্য জেলা পরিষদ। কিন্তু ২০০৯ সাল থেকে স্কুলটি  টানা ১২ বছর বন্ধ ছিল। এর মধ্যে ২০১১ সালে জনৈক অভিজিত চাকমা নামের এক ব্যক্তির কাছ থেকে ২ একর দ্বিতীয় শ্রেণীর জমি ক্রয় করে হ্লাথোয়াইহ্রী ও তার বোন ঞোমাহ্রী মারমা। যার খতিয়ান নাম্বার ৬। এর মধ্যে তার বোনের নামে ৪০ শতাংশ ও তার নিজের নামে এক একর ষাট শতক। ইতিমধ্যে তার অংশ হতে একাধিক ব্যক্তিকে বিক্রির পর বর্তমানে হ্লাথোয়াইহ্রীর অবশিষ্ট রয়েছে এক একর তিন শতক।

হ্লাথোয়াইহ্রী পর পর তিনবার তারাছা ইউনিয়ন পরিষদ ও একবার রোয়াংছড়ি উপজেলা পরিষদের চেয়ারম্যান ছিলেন৷ এছাড়া উত্তরাধিকার সুত্রে তার পিতা অংসাপ্রু মারমা প্রয়াত হবার পর বেতছড়া মৌজার হেডম্যান পদে দায়িত্ব পান তিনি। পতিত আওয়ামী লীগ সরকারের সময়ে বন্টনে পাওয়া দায়িত্ব বলে বর্তমানে তিনি বাজার ফান্ডের বান্দরবান জেলা সদরেরও বাজার চৌধুরী। এ কারণে ক্ষমতার অপব্যবহার করে  অভিজিত চাকমার কাছ থেকে কেনা জমির কাগজে দীর্ঘ বছর ধরে জায়গা ও সরকারি ভবন দখল করে রেখেছে। একইসঙ্গে ভাড়া দেয়া ও বেতছড়া মৌজার হেডম্যানের কার্যালয় ও তারাছা আওয়ামী লীগ কার্যালয় নামে সাইনবোর্ড টাঙিয়ে নিজের পরিবার নিয়ে বসবাস করছে। তবে ৫ আগষ্টের পর তারাছা আওয়ামী লীগ কার্যালয় সম্বলিত সাইনবোর্ডটি সরিয়ে রাখা হয়।

সংশ্লিষ্টদের আরো অভিযোগ, ২০০২ সালে তৎকালীন জেলা মাধ্যমিক শিক্ষা কর্মকর্তার পরামর্শ অনুযায়ী হাই স্কুলকে এমপিওভুক্ত করার জন্য স্কুলের নামে ব্যাংকের  সাধারন হিসাবে ৬০ হাজার টাকা ও সংরক্ষিত হিসাবে ৬৫ হাজার টাকা জমা দিয়েছিল। সেসময় স্কুল পরিচালনা কমিটির সভাপতি ছিলেন হ্লাথোয়াইহ্রী। একই বছরে এমপি বীর বাহাদুর উশৈসিংয়ের বাস ভবনে স্কুলের শিক্ষকরা গিয়ে স্কুলকে এমপিওভুক্ত করার আবেদন করেন। সেসময় হ্লাথোয়াইহ্রীকে ডেকে স্কুলকে এমপিওভুক্ত করার জন্য দ্রুত প্রয়োজনীয় ব্যবস্থা নিতে বলেন বীর বাহাদুর৷ কিন্তু কোন উদ্যোগ নেয়নি হ্লাথোয়াইহ্রী। এতে নিরাশ হয়ে চাকুরি ছেড়ে দেন শিক্ষকেরা।

অন্যদিকে বেতছড়া খালের দক্ষিণ দিকে একটি ড্রাগন ফল বাগানের জমির হোল্ডিং নাম্বার ৭৭ এ ২ একর দ্বিতীয় শ্রেণীর জমি রয়েছে তার। ওই জমির কাগজ হতে ১ একর জমি স্কুলটির জন্য দান করে দানবীর সাজানোর ফন্দি করেছে সে। যার নামজারি মামলা প্রক্রিয়াধীন। কিন্তু দানের জমি দাবি করে পরিকল্পিত ভাবে ১১৫ নাম্বার হোল্ডিংয়ের ফোথোয়াই উ নামের প্রয়াত এক ব্যক্তির ওয়ারিশদের ভোগদখলীয় তিন একর দ্বিতীয় শ্রেণীর জমি হতে জোর করে স্কুলের নাম দেখানো ওই এক একর জমি বুঝিয়ে দেয়ার অপচেষ্টা করে চলেছেন হ্লাথোয়াইহ্রী। এতে ভুক্তভোগিরা অভিযোগ দিয়েছে তার বিরুদ্ধে। তার এই সুক্ষ পরিকল্পনার উদ্দেশ্য হলো স্কুলের নামে ভূমি সংক্রান্ত কৃত্রিম জটিলতা বাঁধিয়ে সবার মনোযোগ ভিন্ন দিকে ঘুরিয়ে দেয়া। স্কুলের প্রকৃত জমিসহ সরকারি দুটি ভবন চিরস্থায়ী ভাবে দখলে নেয়ার উদ্দেশ্যে এসব অপকর্ম করে বেরাচ্ছে সে।

স্থানীয়রা জানায়, এলাকাবাসীর দাবীর পরিপ্রেক্ষিতে ২০২৩ সালের শেষের দিকে বেতছড়া হাই স্কুলের শিক্ষা কার্যক্রম পরিচালনা ও পাঠদানের জন্য ইউনিয়ন পরিষদ ভবনে তিনটি কক্ষ ব্যবহারের অনুমতি দিয়েছেন তারাছা ইউনিয়ন পরিষদের চেয়ারম্যান উনুমং মারমা। এর ফলে এলাকার অন্তত ১৮-২০ পাড়ার  ছেলেমেয়েরা মাধ্যমিক শিক্ষা গ্রহণের সুযোগ পেয়েছে। এছাড়া উনুমং এর উদ্যোগে দীর্ঘদিন হ্লাথোয়াইহ্রীর দখলে থাকা দুটি সরকারি ভবনকে দুরের পাড়ার শিক্ষার্থীদের জন্য হোস্টেল করা হয়েছে। গত এক বছর ধরে হোস্টেল পরিচালিত হচ্ছে।

এসব বিষয় জানতে সেলফোনে একাধিকবার কল করেও কোন সাড়া না পাওয়ায় হ্লাথোয়াইহ্রীর বক্তব্য পাওয়া যায়নি।

স্কুল কার্যক্রম কাজে বাধা দেয়ার বিষয়ে জানতে চাইলে ১৯৭৭-৭৮ সালে তার বাবার নামে বন্তোবস্তি পাওয়া জমি বলে জানিয়েছেন  প্রয়াত ফোথোয়াই উ মারমার ছেলে মংবাথোয়াই মারমা। তিনি ডেইলি মেসেঞ্জারকে বলেন,  আমার বাবা লেখাপড়া জানতেন না। এ জন্য তৎকালীন হেডম্যান ও বর্তমান হেডম্যান হ্লাথোয়াইহ্রীর বাবা মৃত অংসাপ্রু মারমা চালাকি আমাদের জমি ভোগ করতে চেয়েছিল। কিন্তু বর্তমানে হ্লাথোয়াইহ্রী যে জমিটি স্কুলকে দান দেখাচ্ছে সে জমির কাগজে থাকা চৌহদ্দীর সঙ্গে জমির বাস্তবতার মিল নাই। অপরদিকে আমাদের জমির কাগজের চৌহদ্দীর সঙ্গে জমির চৌহদ্দীর হুবহু মিল রয়েছে। যা গত মাসের ৫ তারিখ ইউএনওর উপস্থিতিতে মিলিয়ে দেখা হয়েছেে। এছাড়া ইউনিয়ন পরিষদের তদন্তেও এসব বিষয় উঠে এসেছে বলে জানান তিনি।

ইউনিয়ন পরিষদ ভবনে পাঠদানের বিষয় নিশ্চিত করেছেন তারাছা ইউনিয়ন পরিষদের চেয়ারম্যান উনুমং মারমা। তিনি নিজেও ৯৬-৯৭ সালে বেতছড়া হাই স্কুলে অধ্যয়ন করেছেন জানিয়ে বণিক বার্তাকে বলেন, গত বছর থেকে বেতছড়া হাই স্কুলের পুরানো দুটি ভবন শিক্ষার্থীদের জন্য হোস্টেল করা হয়েছে। দ্বিতল ভবনের উপরের তলায় মৌজার হেডম্যান হ্লাথোয়াইহ্রী থাকেন। ১৫ টি পাড়ার সম্মিলিত সহযোগিতায় হোস্টেলটি পরিচালিত হচ্ছে। প্রতি মাসে যে যার সামর্থ্যনুযায়ী চাল, নিত্যপণ্য, নগদটাকা প্রভৃতি সহযোগিতা করছেন। এছাড়া সরকারি শিক্ষক শিক্ষিকারাও সহযোগিতা করছেন। শিক্ষার জন্য সম্মিলিত এ প্রচেষ্টা ও মহৎ উদ্যোগ বিরল দৃষ্টান্ত। এর ফলে গত কয়েক মাসে স্কুলে ও হোস্টেলে শিক্ষার্থীর সংখ্যা বেড়েছে। বর্তমানে ৬ষ্ঠ থেকে অষ্টম শ্রেণী মিলে মোট ৭৩ জন ছেলেমেয়ে অধ্যয়ন করছে। গত বছর নিয়োগ পাওয়াসহ মিলে স্কুলে পাঁচ জন শিক্ষক কর্মরত আাছেন। এছাড়া অন্যান্য পদেও জনবল রয়েছে। পর্যায়ক্রমে এমপিওভুক্তকরণসহ অষ্টম শ্রেণী থেকে উন্নীত করে পরিপুর্ণ একটি উচ্চ বিদ্যালযে পরিণত করা হবে জানান তিনি।

সরকারি ভবন দখল সংক্রান্ত কেউ কোনো অভিযোগ দিলে যথাযথ ব্যবস্থা নেয়া হবে বলে জানিয়েছেন রোয়াংছড়ি উপজেলা নির্বাহী কর্মকর্তা মো. সাইফুল ইসলাম। সার্বিক বিষযে তিনি বণিক বার্তাকে বলেন, কোন ব্যক্তি যদি স্কুলের জন্য কিছু দিয়ে থাকেন সেটা অন্যভাবে ব্যবহার করা অন্যায়। স্কুল সংক্রান্ত  অভিযোগের তদন্ত চলছে। বিষয়টি দ্রুত সমাধান করে সাবলীলভাবে শিক্ষা কার্যক্রম পরিচালনাসহ পাঠদানের ব্যবস্থা নিশ্চিত করা হবে বলে জানান তিনি।

তারাছা ইউনিয়নের সচেতন মহলের মতে, বেতছড়া হাই স্কুলের নির্ধারিত জমিতে প্রচুর অর্থ ব্যয় করে একাধিক ভবন করে দিয়েছে সরকার। এ বাস্তবতায় হ্লাথোয়াইহ্রী যদি স্কুলের জন্য জমি দান করতে এতই আন্তরিক হয়ে থাকেন তাহলে তিন দশক আগে স্থাপিত জমিটিকে স্কুলের নামে করে দিলেই পারে৷

মেসেঞ্জার/তুষার