
ছবি : মেসেঞ্জার
জীবনের কঠিন বাস্তবতা আর দারিদ্র্যের সঙ্গে লড়াই করে উঠে আসা এক সংগ্রামী নারীর নাম সাথী আক্তার। এক সময় যার সংসার চালাতে হিমশিম খেতে হতো, সেই সাথী এখন সফল নারী উদ্যোক্তা। নিজের হাতে গড়া ‘সাথী চা’ নামের ব্যবসার মাধ্যমে তিনি শুধু নিজের ভাগ্য বদলাননি, আশপাশের অনেক নারীকেও স্বাবলম্বী হওয়ার সুযোগ করে দিয়েছেন।
সংগ্রামের শুরু : পাঁচ টাকার জন্য মাংস না কেনার আক্ষেপ
সাথী আক্তারের জন্ম পঞ্চগড় জেলার তেঁতুলিয়া উপজেলায় শালডাঙ্গা গ্রাম। বিয়ের পর স্বামীর সঙ্গে ঢাকায় পাড়ি জমিয়েছিলেন ভালো কিছু করার আশায়। সেখানে একটি কোম্পানিতে কাজ শুরু করলেও নানা সমস্যার কারণে আবার ফিরতে হয় শ্বশুরবাড়ি ঠাকুরগাঁওয়ে। ফিরে এসে তার স্বামী একটি দোকানে মাত্র ৫ হাজার টাকা বেতনে চাকরি নেন। এত সামান্য আয়ে সংসার চালানো কষ্টসাধ্য হয়ে ওঠে।
একদিন বাজার করতে গিয়ে ৩০ টাকা দিয়ে অল্প মাংস কিনতে চাই। কিন্তু মাংসের দাম ছিল ৩৫ টাকা।মাত্র পাঁচ টাকার জন্য মাংস কিনতে না পারার ঘটনাটি তাকে দারুণভাবে নাড়া দেয়। তখনই তিনি সিদ্ধান্ত নেন, শুধু স্বামীর আয়ের ওপর নির্ভরশীল না থেকে নিজেও কিছু করবেন। কিন্তু কাজ খোঁজার পথ মোটেও সহজ ছিল না।
এক কাজ থেকে আরেক কাজে ছুটে বেড়ানো
কিছু একটা করার লক্ষ্যে তিনি প্রথমে ঠাকুরগাঁও গোদুরি বাজারের একটি জ্যাকেট কারখানায় পরিচ্ছন্নতা কর্মীর কাজ নেন। সেখানে তিন দিন কাজ করার পরও কোনো পারিশ্রমিক পাননি। পরে তিনি একটি লন্ড্রি দোকানে কাজ নেন, যেখানে প্রতিটি কাপড় ধোয়ার জন্য দুই টাকা দেওয়ার কথা বলা হয়। কিন্তু ৫ দিন কাজ করার পর মালিক জানান, মাস শেষে টাকা দেওয়া হবে। এভাবে প্রতারিত হয়ে তিনি আবার কাজ ছাড়তে বাধ্য হন।
চা ব্যবসার শুরু: পায়ে হেঁটে মাইলের পর মাইল
শেষমেশ, হতাশ না হয়ে নিজের গ্রামে ফিরে যান এবং চা ব্যবসার সম্ভাবনা খুঁজতে থাকেন। প্রথমে মাত্র ২০০ টাকার কিছু চা পাতা কেনেন এবং নিজেই বিক্রি করার উদ্যোগ নেন। কিন্তু শুরুটা সহজ ছিল না। প্রথম তিনদিন চা বিক্রি করতে না পারায় দুশ্চিন্তা বেড়ে যায়। তবে চতুর্থ দিনে ২০০ টাকার চা বিক্রি করতে সক্ষম হন।
এরপর আর পেছনে তাকাতে হয়নি। ধীরে ধীরে ব্যবসার পরিধি বাড়াতে তিনি আরও চা কিনতে শুরু করেন। প্রথমে হেঁটে হেঁটে বিভিন্ন বাজারে চা বিক্রি করতেন। পরে অনেক কষ্ট করে একটি সাইকেল কেনেন, যা ব্যবসার গতি বাড়িয়ে দেয়। একসময় তার চায়ের প্রতি মানুষের আস্থা বাড়তে থাকে, এবং ধীরে ধীরে তার ‘সাথী চা’ নামে পরিচিতি লাভ করে।
সফল উদ্যোক্তা: সাতজন নারীর কর্মসংস্থান
বর্তমানে তার অধীনে সাতজন নারী কাজ করছেন, যারা তার কাছ থেকে চা নিয়ে বিক্রি করেন এবং কমিশনের ভিত্তিতে উপার্জন করেন। সাথী জানান, যারা তার সঙ্গে যুক্ত হতে চান, তারা খুব সহজেই ‘সাথী চা’ বিক্রি করে নিজের ভাগ্য পরিবর্তন করতে পারবেন।
এখন তিনি দিনে ৩০ থেকে ৪০ হাজার টাকার চা বিক্রি করেন। শুধু তাই নয়, তার স্বামীরও এখন নিজস্ব একটি দোকান রয়েছে, যেখান থেকে তারা বিভিন্ন বাজারে চা সরবরাহ করেন।
সাফল্যের গল্পে এলাকাবাসীর প্রশংসা
সাথী আক্তারের এই সাফল্যের গল্প শুধু তার নিজের নয়, এটি গোটা এলাকাবাসীর জন্য অনুপ্রেরণা হয়ে দাঁড়িয়েছে। ঠাকুরগাঁওয়ের স্থানীয় বাসিন্দা আব্দুল হাকিম বলেন, “সাথীর মতো নারীরা আমাদের সমাজের জন্য দৃষ্টান্ত। তিনি শুধু নিজের জন্য নয়, আরও অনেক নারীর জন্য পথ খুলে দিয়েছেন।”
মাহবুবুর রহমান বলেন, “সাধারণ একজন গৃহবধূ থেকে উদ্যোক্তা হয়ে ওঠা সাথী প্রমাণ করেছেন, ইচ্ছা থাকলে দারিদ্র্যকে হারানো সম্ভব। সরকার যদি তার মতো উদ্যোক্তাদের সহযোগিতা করে, তাহলে আরও অনেক নারী স্বাবলম্বী হতে পারবে।”
স্বামী আব্দুল লতিফ বলেন, “একসময় আমি মানুষের দোকানে কাজ করতাম। সেই দিনগুলো ছিল সংগ্রাম ও অসুবিধায় ভরা—জীবনের প্রতিটি মুহূর্তে ছিল কষ্টের ছাপ। তবে কঠোর পরিশ্রম, অধ্যবসায় এবং আত্মবিশ্বাসের মাধ্যমে আজকের এই সাফল্যের পথচলা শুরু হয়। বর্তমানে আমার নিজস্ব একটি দোকান রয়েছে, যেখান থেকে আমরা দেশের বিভিন্ন প্রান্তে চা বিক্রি করে থাকি। এই দোকানটি শুধু আমার নিজের জীবনের চিত্রই পরিবর্তন করেনি, বরং আমাদের পরিবারের মানসিক ও আর্থিক অবস্থা এক নতুন দিগন্তে পৌঁছে দিয়েছে।
আজ আমরা সেই পুরনো কষ্ট আর সংগ্রামের দিনগুলোর তুলনায় অনেক সুন্দর ও শান্তিপূর্ণ জীবন যাপন করতে পারছি। প্রতিটি বিক্রি, প্রতিটি গ্রাহকের মুখে হাসি আমাদের পরিশ্রমের ফলস্বরূপ এসেছে। জীবনের যে কঠিন অধ্যায়গুলি অতিক্রম করেছি, তা এখন আমাদের ভবিষ্যতের নতুন আশার সূচনা করে।”
নারীদের জন্য বার্তা
সাথী আক্তার বলেন, “আমি চাই, আরও নারীরা স্বাবলম্বী হোক। আমরা নারীরা যদি সাহস করি, তাহলে আমাদের জীবন বদলে যেতে পারে। শুধু সুযোগ খুঁজতে হবে এবং পরিশ্রম করতে হবে।”
তিনি আরো বলেন, “আমাদের ভেতরে যে শক্তি আছে, তা চিনে নিয়ে, নিজের পথ নির্ধারণ করতে হবে। প্রতিটি চ্যালেঞ্জ আমাদের শেখায় যে, যদি আমরা সুযোগকে সঠিকভাবে কাজে লাগাই এবং পরিশ্রমের সাথে নিজেকে নিবদ্ধ রাখি, তবে আমাদের জীবন ধীরে ধীরে বদলে যেতে পারে।” এই বার্তা দিয়ে তিনি নারীদের মনে আত্মবিশ্বাস ও স্বাধীনতার আলো জ্বালিয়ে দিতে চান।
প্রশাসনের প্রতিক্রিয়া
এ বিষয়ে ঠাকুরগাঁও সদর উপজেলা নির্বাহী কর্মকর্তা (ইউএনও) মো. খাইরুল ইসলাম বলেন, “সাথী আক্তারের মতো উদ্যোক্তারা আমাদের দেশের অর্থনীতিকে সমৃদ্ধ করতে পারেন। আমরা তার ব্যবসায়িক উন্নয়নের জন্য সব ধরনের সহযোগিতা করতে প্রস্তুত।”
মেসেঞ্জার/তুষার