
ছবি : মেসেঞ্জার
ভারতের সিকিম রাজ্যের সোলামো হ্রদ থেকে উৎপত্তি তিস্তা নদীর। মোট ৪১৪ কিলোমিটার নদীর ১১৩ কিলোমিটার বাংলাদেশ অংশে। নীলফামারীর ডিমলা উপজেলার পশ্চিম ছাতনাই ইউনিয়নের কালীগঞ্জে প্রবেশ করে মিশে গিয়েছে গাইবান্ধার যমুনা নদীতে। এক সময়ের প্রমত্তা তিস্তার সেই যৌবন এখন আর নেই। বর্ষা মৌসুমে ভারত পানি ছাড়ায় দুঃখ-দুর্দশায় পড়তে হয় চরাঞ্চলের জনবসতিকে। খরিপ মৌসুমে তিস্তায় জেঁগে উঠে হাজার হাজার একর ধু-ধূ বালুর স্তুপ।
তথ্যমতে, ২০২২ সালে ছোট-বড় বন্যা দেখা দিয়েছে ৬ বার। যা বিপদসীমা ওপর দিয়ে পানি প্রবাহিত হয়েছে ৩ বার, দীর্ঘস্থায়ী বন্যা হয়েছে ২ বার ও বিপদ সীমার কাছাকাছি পৌঁছে ১ বার এবং ২০২৩ সালে বন্যা হয়েছে ১২ বার যা বিপদসীমা ওপর দিয়ে পানি প্রবাহিত হয়েছে ৬ বার, দীর্ঘস্থায়ী বন্যা হয়েছে ৪ বার ও ২ বার বিপদসীমার কাছাকাছি পানি পৌঁছে। হারাতে হয় বসত ভিটা, বাসস্থান ও হাজার একর আবাদী জমি বিলিন নদী গর্ভে।
তিস্তার বুক জুড়ে যেখানে-সেখানে ভেসে উঠেছে বিশাল বালুর চর(স্তূপ)। সেই স্তূপ গুলো সমতলের চেয়ে উচ্চতা নিয়েছে বেশি। স্তূপের ফলে গতি পথ হারিয়ে নদী ও নদীর মোহনা। উজানের পানি আসলেই গতি পথ হারিয়ে সমতলে উঠছে পানি। তা ছাড়া অন্যদিকে ভারতে হঠকারিতায় ছাড়ছে বাংলাদেশ অংশে পানি নেই কোনো নোটিশ কিংবা জরুরী বার্তা। ফলে দেখা দিচ্ছে ছোট-বড় বন্যা, প্রতি বছর হারাতে হচ্ছে বসত ভিটা, বাসস্থান ও হাজার একর আবাদী জমি।
সম্প্রতি নীলফামারীর চরাঞ্চলে গিয়ে এলাকার মানুষের সাথে কথা বলে জানা গেছে, কৃষিকাজ ও মাছ ধরাই তাদের জীবন জীবীকার উৎস। ধান, ভুট্টা,গম, আলু, পেঁয়াজ নানান রকম সবজি তারা চাষ করেন। নিজেরা যা চাষ করেন তাই পরিবারের খাদ্য হিসেবে গ্রহণ করেন। তাদের চাহিদা খুব বেশি নয়। মোটা কাপড় আর মোটা ভাত পেলেই খুশি তারা। কিন্তু কিছু কিছু বিষয় তাদের কষ্ট ও দুর্ভোগের কারণ। তার মধ্যে একটি ছেলে মেয়েদের লেখাপড়া করাতে পারেন না এলাকায় স্কুল না থাকার কারণে। ছোট থাকতেই ছেলেকে বাবার সাথে কাজে পাঠানো হয়। মেয়েরা বড় হতে থাকে গৃহস্থালি কাজকর্ম করতে করতে। গ্রামে কোনো রাস্তা না থাকায় চলাচল করে না কোনো গাড়ি। খুব বেশি প্রয়োজন হলে ঘোড়ার গাড়ি ভাড়া করা হয়। দুর্গম এই চর থেকে শহরে যাওয়ার মাধ্যম নৌকা, ঘোড়া গাড়ি ও ঘাটে যেতে হয় পায়ে হেঁটে। যেটি চলে খেতের মধ্যে দিয়েই। বৃষ্টি হলে কর্দমাক্ত হয়ে হেঁটে চলাচল করাই দায় হয়ে যায়।
কথা হয় ডিমলা উপজেলার বাইশপুকুর গ্রামের গৃহবধূ সুফিয়া খাতুনের সঙ্গে তিনি বলেন, ১৯৯৪ সালে বিবাহ বন্ধনে আবদ্ধ হন। তার সংসার জীবনে প্রথম বন্যা দেখা মিলে ১৯৯৬ সালে বিলিন হয়ে যায় কিসামত সতী ঘাট নামে একটি গ্রামে। সেই থেকে শুরু বাড়ি ভাঙন। পর্যাক্রমে সংসার জীবনে সতেরো বার সরাতে হয়ে বাড়ি। জীবন থেকে হারিয়ে জীবন সঙ্গী। সংসারে নেমে আসে অচমকা কালো অধ্যায় জমিজমা বিলিন হয়ে পাঁচ সন্তানের রুটি রুজি জোগাতে নেমে পরে কাছে। একদিকে স্বামী হারার শোক অন্যদিকে আশ্বিন মাসিয়া মঙ্গা। একবেলা খাবার জুটলেও দুবেলা না খেয়ে থাকাতে হয়ে তাদের।
তিনি জানান, তার মতো সেই বন্যায় হাজার-হাজার পরিবার হারিয়েছে বসতবাড়ি। হারিয়েছে শেষ সম্বল টুকুও। তবে, আশা ছাড়েনি সুফিয়া খাতুন কবে জানি ফিরে পাবে তাদের হারানো সেই সম্পদ। ফিরে যাবে সন্তানকে নিয়ে বাপ-দাদার বসত ভিটাতে।
চর খড়িবাড়ী গ্রামের তারাজুল ইসলাম বলেন, এ এলাকার মানুষ তাদের ছেলেমেয়েদের লেখাপড়া করানোর কথা চিন্তাও করতে পারেন না। বছরের ছয় মাস বর্ষা আর নদী পানি পাড়ি দিতে হয় তাই কেউ ছেলেমেয়েকে স্কুলে পাঠাতে চায়না। জীবনের ঝুঁকি থাকে সব সময়। শিক্ষা, স্বাস্থ্য, যোগাযোগ সব দিক দিয়ে পিছিয়ে আছে। এ এলাকার উন্নয়ন করা খুবই জরুরী। কিন্তু কেউ এলাকা নিয়ে ভাবেনা। তিনি এ এলাকায় স্বাস্থ্যকেন্দ্র করার দাবি জানান।
জেলার জলঢাকা উপজেলার ডাউয়াবাড়ী গ্রামের আব্দুর রাজ্জাক বলেন, রাস্তা না থাকায় সবজি মাথায় করে নৌকা ঘাটে আনতে হয়। এরপর এক মণ সবজি বাজার নিতে খরচ পড়ে ১০০-১৫০ টাকার মতো। বাজারে খাওয়া খেতে আরও একশ টাকা খরচ হয়। সবজি বিক্রি করে যে টাকা পান তাতে খরচ ওঠেনা।
নদী বিশ্লেষক অধ্যক্ষ নজরুল ইসলাম হক্কানী জানান, ২৯০ বছর ধরে তিস্তার কোনো পরিচর্চা নেই। ভারত একতরফা ভাবে পানি নিয়ন্ত্রণ করছে ফলে মরুভ‚মিতে রূপ নিয়েছে। তিস্তা কেবলমাত্র মৌসুমী নদীতে পরিণত হয়েছে, তিস্তাকে বারো মাসি নদী বলা যাবে না। বর্ষায় যে পলি আসে তাতে নদীর ভ‚-গর্ভ ভরে সমতলের সমান উচু হয়ে গেছে। তিস্তায় চ্যানেল একটা না, চ্যানেল এখন অনেক হয়ে গেছে। ভারত যখন পানি ছাড়ে তখন পানি বিভিন্ন চ্যানেলে গিয়ে সময়ে বন্যার সৃষ্টি হচ্ছে।
তিনি বলেন, আমরা ভৌগলিক রাজনীতিতে পরে গেছি। একদিকে চীন চাচ্ছে তিস্তা মহাপরিকল্পনা অন্যদিকে ভারত বাস্তবায়নের যাচ্ছে। নিজের অর্থায়নে তিস্তা মহাপরিকল্পনা বাস্তবায়ন করতে দাবি জানিয়েছি।
তিস্তার বন্যায় সহনুভূতিতা আর ত্রাণের চেয়ে বড় ভূমিকা হয়ে তিস্তা মহাপরিকল্পনা কিংবা নদী শাসন। দ্রæত সময়ে ড্রেজিং এর মাধ্যমে ভূ-গর্ভে বালি অপসরণ। অপর দিকে মহা-পরিকল্পনা বাস্তবায়ন।
মেসেঞ্জার/তুষার