ঢাকা,  রোববার
২৩ ফেব্রুয়ারি ২০২৫

The Daily Messenger

ভাষা আন্দোলনের ৭৩ বছর : স্বীকৃতিহীন ভাষা সৈনিক মনসুর আলম

আরিফ হাসান,ঠাকুরগাঁও

প্রকাশিত: ১৭:৪১, ২২ ফেব্রুয়ারি ২০২৫

ভাষা আন্দোলনের ৭৩ বছর : স্বীকৃতিহীন ভাষা সৈনিক মনসুর আলম

ছবি : মেসেঞ্জার

১৯৫২ সালের ভাষা আন্দোলনের কথা বললেই শহিদ সালাম, বরকত, রফিক, জব্বারসহ অনেকের নাম সামনে আসে। ঢাকার রাজপথে তাঁদের আত্মত্যাগের ফলেই বাংলা ভাষা রাষ্ট্রভাষার মর্যাদা পায়। কিন্তু এই আন্দোলন ঢাকায় সীমাবদ্ধ ছিল না, ছড়িয়ে পড়েছিল দেশের নানা প্রান্তে। সেই আন্দোলনের অন্যতম গুরুত্বপূর্ণ কেন্দ্র ছিল ঠাকুরগাঁও। সেখানে ভাষার জন্য লড়াই করেছিলেন অনেকেই, তাঁদের একজন মনসুর আলম মুজিবর রহমান।

এই ভাষা সৈনিক আজও রাষ্ট্রীয় স্বীকৃতি পাননি। বয়সের ভারে ন্যুব্জ, স্মৃতিশক্তি ক্ষীণ, কিন্তু ইতিহাসের পাতায় তাঁর ভূমিকা অমলিন থাকার কথা ছিল। সেই স্বীকৃতি তিনি কি কখনো পাবেন না?

ঠাকুরগাঁওয়ে ভাষা আন্দোলনের উত্তাল দিনগুলো
১৯৪৮ সালে পাকিস্তান সরকার যখন উর্দুকে একমাত্র রাষ্ট্রভাষা করার ঘোষণা দেয়, তখন থেকেই বাংলার ছাত্রসমাজ প্রতিবাদে ফেটে পড়ে। ঢাকার পাশাপাশি দেশের বিভিন্ন অঞ্চলেও গড়ে ওঠে ভাষা আন্দোলনের সংগঠন। ঠাকুরগাঁও ছিল তৎকালীন বৃহত্তর দিনাজপুর জেলার একটি গুরুত্বপূর্ণ মহকুমা। এখানেও বাংলাকে রাষ্ট্রভাষা করার দাবিতে গড়ে ওঠে শক্তিশালী আন্দোলন।

১৯৫২ সালের ২১ ফেব্রুয়ারি ঢাকার রাজপথে পুলিশের গুলিতে সালাম, বরকত, রফিক, জব্বারসহ অনেকে শহিদ হওয়ার খবর ছড়িয়ে পড়লে উত্তাল হয়ে ওঠে গোটা দেশ। এর রেশ ঠাকুরগাঁওয়েও পড়ে। ২২ ফেব্রুয়ারি তৎকালীন ঠাকুরগাঁও এইচ.ই স্কুলের (বর্তমান ঠাকুরগাঁও সরকারি বালক উচ্চ বিদ্যালয়) মুসলিম হোস্টেলের ২ নম্বর কক্ষে গঠন করা হয় ‘ঠাকুরগাঁও মহকুমা রাষ্ট্রভাষা সংগ্রাম কমিটি’।

এই কমিটির সভাপতি নির্বাচিত হন বিদ্যালয়ের দশম শ্রেণির ছাত্র মনসুর আলম মুজিবর রহমান। তাঁর নেতৃত্বে ছাত্ররা ঠাকুরগাঁওয়ে ভাষা আন্দোলনকে আরও বেগবান করে তোলেন।

প্রতিবাদ, মিছিল ও পুলিশের দমননীতি
২১ ফেব্রুয়ারির শহিদদের প্রতি শ্রদ্ধা জানিয়ে ২২ ফেব্রুয়ারি থেকে ঠাকুরগাঁওয়ে শুরু হয় লাগাতার হরতাল, মিছিল ও প্রতিবাদ। টানা সাত দিন শহরের রাস্তায় চলতে থাকে ছাত্রদের বিক্ষোভ।

তখনকার দিনে ঠাকুরগাঁওয়ে মাইকের ব্যবস্থা ছিল না। ফলে পোস্টার, ব্যানার, দেয়াললিখনের মাধ্যমে প্রচার চালানো হতো। আন্দোলনের স্লোগান ছড়িয়ে দিতে পুরাতন বাসন, টিন ও লোহার পাত ব্যবহার করে শব্দ তৈরি করা হতো। এতে করে শহরের সর্বত্র আন্দোলনের বার্তা ছড়িয়ে পড়ত।

পুলিশ তখনকার অনেক ছাত্রনেতাকে গ্রেপ্তার ও হয়রানি করেছিল। আন্দোলনের সংগঠকরা তাঁদের নিরাপদ আশ্রয় হিসেবে বেছে নিয়েছিলেন ঠাকুরগাঁও সরকারি বালক উচ্চ বিদ্যালয়ের মুসলিম হোস্টেল। ওই হোস্টেলের ২ নম্বর কক্ষ ছিল আন্দোলনের অন্যতম পরিকল্পনা কেন্দ্র। এখানেই মিছিলের ব্যানার, পোস্টার তৈরি হতো। পুলিশের হাত থেকে গুরুত্বপূর্ণ কাগজপত্র লুকিয়ে রাখা হতো মনসুর আলমের কক্ষে।

কালো ব্যাজ, কালো পতাকা ও প্রতিবাদ
ঠাকুরগাঁওয়ের বিক্ষোভ যখন তীব্র আকার ধারণ করে, তখন পাকিস্তান সরকার পরিস্থিতি শান্ত করতে তৎকালীন পূর্ব পাকিস্তানের মুসলিম লীগ সভাপতি মাওলানা আব্দুল্লাহিল বাকী আল কোরাইশী ও যোগাযোগমন্ত্রী হাসান আলীকে সেখানে পাঠায়।

ভাষা আন্দোলনকারীরা সিদ্ধান্ত নেন, তাঁদের সামনে কালো ব্যাজ ধারণ করে ও কালো পতাকা উড়িয়ে প্রতিবাদ জানানো হবে। মনসুর আলমসহ অন্যান্য নেতাদের নেতৃত্বে সেই কর্মসূচিও পালিত হয়। ঠাকুরগাঁওয়ের ছাত্ররা সরকারের দমননীতির বিরুদ্ধে দৃঢ় অবস্থান নেন।

মনসুর আলমের সংগ্রামী জীবন
মনসুর আলম মুজিবর রহমানের জন্ম ঠাকুরগাঁও সদর উপজেলার ভুল্লি থানার আওলিয়াপুর ইউনিয়নের পারপুখিয়া গ্রামে। বাবা কসিম উদ্দিন সরকার, মা মোছা. নাসিমা বেগম। চার ভাই ও দুই বোনের মধ্যে তিনি ছিলেন সবার বড়।১৯৪২ সালে তিনি কচুবাড়ি পারপুখিয়া প্রাথমিক বিদ্যালয়ে পড়াশোনা শুরু করেন। এরপর পীরগঞ্জ উচ্চ বিদ্যালয়ে ভর্তি হন। ১৯৫২ সালে যখন তিনি ঠাকুরগাঁও সরকারি বালক উচ্চ বিদ্যালয়ের দশম শ্রেণির ছাত্র, তখনই ভাষা আন্দোলনের সক্রিয় অংশীদার হয়ে ওঠেন।

পরে কর্মজীবনে তিনি ঠাকুরগাঁও জেলা প্রশাসকের কার্যালয়ে প্রধান সহকারী হিসেবে কর্মরত ছিলেন।

স্বীকৃতির অপেক্ষায় এক ভাষা সৈনিক
ভাষা আন্দোলনের ৭৩ বছর পেরিয়ে গেছে। ২১ ফেব্রুয়ারি আজ আন্তর্জাতিক মাতৃভাষা দিবস হিসেবে বিশ্বব্যাপী স্বীকৃত। কিন্তু এই আন্দোলনের তৃণমূল সংগঠকরা, যারা প্রত্যন্ত অঞ্চলে লড়াই করেছেন, তাঁদের অনেকেই আজও উপেক্ষিত।

মনসুর আলম মুজিবর রহমান এখন বয়সের ভারে ন্যুব্জ। স্মৃতিশক্তি প্রায় লোপ পেয়েছে। অথচ তাঁর অবদান ঠাকুরগাঁওয়ের ভাষা আন্দোলনে ছিল অপরিসীম।

দেশ যখন ভাষা শহিদদের সম্মান জানাতে ব্যস্ত, তখন এই জীবন্ত কিংবদন্তি তাঁর শেষ জীবনে এসে রাষ্ট্রীয় স্বীকৃতির আশায় দিন কাটাচ্ছেন। এ দেশের ইতিহাস কি তাঁকে ভুলে যাবে?

মেসেঞ্জার/তুষার