ঢাকা,  শুক্রবার
২৯ নভেম্বর ২০২৪

The Daily Messenger

ধানমন্ডিতে ৩০০ কোটি টাকার সরকারি সম্পত্তি বেহাত

নজরুল ইসলাম

প্রকাশিত: ১১:২৮, ১৩ ডিসেম্বর ২০২৩

আপডেট: ১১:৩৫, ১৩ ডিসেম্বর ২০২৩

ধানমন্ডিতে ৩০০ কোটি টাকার সরকারি সম্পত্তি বেহাত

ছবি : মেসেঞ্জার

ঢাকার ধানমন্ডি এলাকায় ২০ কাঠা বা ৩৩ শতাংশের একটি সরকারি প্লট বেহাতের অভিযোগ উঠেছে। ভুয়া মালিক সাজিয়ে অবমুক্ত করে প্লটটি বিক্রি ও দখল করার অভিযোগটি দুর্নীতি দমন কমিশনে (দুদক) জমা পড়েছে। এতে সরকারের ৩০০ কোটি টাকা ক্ষতি হচ্ছে বলে অভিযোগ আনা হয়েছে। দুদকের যাচাই-বাছাই কমিটি (যাবাক) অভিযোগটি গ্রহণ করেছে বলে দুদক সূত্রে জানা গেছে।

দুদক সূত্র জানিয়েছে, জাতীয় গৃহায়ন কর্তৃপক্ষের কাছে অভিযোগটির বিষয়ে জানিয়ে তাদের মতামত চাওয়া হয়েছে।

এই বিষয়ে কোনো তদন্ত কমিটি গঠন করা হয়েছে কিনা, মঙ্গলবার রাতে জানতে চাইলে জাতীয় গৃহায়ন কর্তৃপক্ষের চেয়ারম্যান খোন্দকার মোস্তাফিজুর রহমান দ্য ডেইলি মেসেঞ্জারকে বলেন, ‘ফাইল দেখে বলতে পারবো, জমিজমার বিষয়। কাগজপত্র না দেখে তো বলতো পারবো না।’

গত ১ ডিসেম্বর সরেজমিন ধানমন্ডির ৪ নম্বর রোডের ৩০ নম্বর (পুরাতন ১৩৪) প্লটে গিয়ে দেখা যায়, দীপ্তায়ন নামের একটি সাইবোর্ড ঝোলানো রয়েছে। গেটে নক করার পর একজন নারী কেয়ারটেকার আসেন। তিনি জানান, ভেতরে ঢোকা নিষেধ। জুয়েল, মনির ও শিল্পপতি শাহীন সাহেব ঢুকতে নিষেধ করেছেন। বাড়িটি ভাঙা হবে। সব দায়িত্ব আবদুল কাদের ভূইয়ার।

ওই নারী কেয়ারটেকার জানান, নাসরিন আক্তার মৌ নামের এক নারী বাড়িটার পেছনে লেগেছেন।

পরে বায়তুল ওভারসিজ ও বর্নমালা ওভারসিজের ম্যানেজিং পার্টনার আবদুল কাদের ভূইয়ার মোবাইল নম্বরে কল দিলে তিনি দ্য ডেইলি মেসেঞ্জারকে বলেন, ‘আমি ম্যানেজার। আমার বস শাহীন আহমেদ বিষয়টি বলতে পারবেন। তিনিসহ ৩৯ জন এটা কিনেছেন। কাগজ সঠিক আছে বলেই তিনি কিনেছেন।’

দীপ্তায়নের বিষয়ে জানতে চাইলে তিনি বলেন, ‘এটা আমাদের একটা সমিতি।’ পরে তার কাছে শাহীন আহমেদের মোবাইল নম্বর চাইলে তিনি কল কেটে দেন।    

প্লটটির বিষয়ে দুদকে দেওয়া অভিযোগে বলা হয়েছে, সৈয়দ তোরাব মজিদের প্রকৃত নাম সৈয়দ তোরাব হোসেন। তার বাবার নাম আবদুল মজিদ নয় সৈয়দ মনোয়ার হোসেন। তারা সাত ভাই। সৈয়দ তোরাব হোসেনকে লোভ দেখিয়ে ব্যবসায়ী আবু সুফিয়ানের কাছে নিয়ে যান লালমাটিয়ার আলী হোসেন ওরফে মোহাম্মদ আলী। মিথ্যা তথ্য দিয়ে গণপূর্ত মন্ত্রণালয়ের অসৎ কর্মচারীদের সহায়তায় আবু সুফিয়ান ও তার স্ত্রী পারভীন প্রপার্টিজ অ্যান্ড টেকনোলজিস লিমিটেডের ব্যবস্থাপনা পরিচালক পারভীন আকতার প্লটটি হাতিয়ে নেন। তারা ২০১১ সালের ২৩ আগস্ট সেটি পারভীন প্রপার্টিজ অ্যান্ড টেকনোলজিস লিমিটেডের নামে রেজিস্ট্রিও (দলিল নম্বর-৪৮৪৭) করে নেন। পরে প্লটটি বিক্রির জন্য পূর্ত মন্ত্রণালয়ের অনুমতি নেয়। 

পারভীন প্রপার্টিজ অ্যান্ড টেকনোলজিস লিমিটেডের ওয়েবসাইটে পাওয়া তিনটি মোবাইল নম্বরে কল করা হলে দুটি নম্বর রিসিভ করা হয়নি। একটি নম্বর রিসিভ করে একজন নারী জানান, এটি ভুল (পারভীন প্রপার্টিজ অ্যান্ড টেকনোলজিস লিমিটেডের নম্বর নয়) নম্বর।

আবু সুফিয়ানের মোবাইল নম্বরে কল করা হলে সেটি বন্ধ পাওয়া যায়। সৈয়দ আবদুল মজিদের নম্বরও বন্ধ পাওয়া গেছে।

সৈয়দ তোরাব মজিদ ও পারভীন প্রপার্টিজ অ্যান্ড টেকনোলজিস লিমিটেডের মধ্যে সম্পাদিত দলিল সূত্রে জানা গেছে, সাবেক লালবাগ বর্তমানে ধানমন্ডি থানা এলাকা মৌজায় পূর্ব পাকিস্তান সরকারের সিবি অ্যান্ড আই ডিপার্টমেন্টের নগর উন্নয়ন শাখার মাধ্যমে আবাসিক এলাকা নামে একটি অভিজাত এলাকা গড়ে তোলা হয়। ১৯৫১ সালের ১৮ সেপ্টেম্বর তৈরি ও প্রকাশিত লে আউট প্ল্যান নম্বর পি-২বি মোতাবেক পৃথক পৃথক প্লট তৈরি করে মৃত সৈয়দ আব্দুল আজিজের ছেলে সৈয়দ আবদুল মজিদের পক্ষে লে-আউট প্ল্যানের ১৩৪ নম্বর প্লটটি ১৯৫০ সালের ৬ আগস্ট তারিখে বরাদ্দ দেওয়া হয়। ১৯৫২ সালের ২৯ জানুয়ারি ঢাকা সদর জয়েন্ট সাব-রেজিস্ট্রি অফিসে রেজিস্ট্রি করা ৭৮০ নম্বর দলিলের মাধ্যমে সৈয়দ আব্দুল মজিদকে রেজিস্ট্রি করে দেওয়া হয়। ভোগ দখলে থাকাবস্থায় ১৯৭২ সালের প্রথম দিকে কিছু অপরিচিত দুষ্কৃতিকারীর হুমকির পর প্লটটি ছেড়ে তিনি অন্যত্র চলে যান। তারপর বাড়িটি বেদখল হিসেবে সরকারের পরিত্যক্ত বাড়ির তালিকায় চলে যায়।

১৯৮৬ সালে সরকারের ঘোষণা মোতাবেক তখনকার গণপূর্ত মন্ত্রণালয়ের আওতায় প্রথম সেটেলমেন্ট কোর্টে পরিত্যক্ত তালিকা থেকে অবমুক্তির জন্য দরখাস্ত দাখিল করেন সৈয়দ আবদুল মজিদ। ১৯৯০ সালের ১৯ জুলাই তারিখে সৈয়দ তোরাব মজিদকে একমাত্র বৈধ ওয়ারিশ রেখে মারা যান সৈয়দ আব্দুল মজিদ। পরে সৈয়দ তোরাব মজিদ প্রথম সেটেলমেন্ট কোর্টের মামলা নম্বর ১৭৫/১৯৯৫ এর বাদী সৈয়দ আব্দুল মজিদের স্থলে নিজের নাম অন্তর্ভুক্ত করান। প্রথম সেটেলমেন্ট কোর্ট বাড়িটি পরিত্যক্ত বাড়ির তালিকা থেকে অবমুক্ত করার রায় দেন। কিন্তু, সৈয়দ তোরাব মজিদ বাড়িটি বুঝে না পাওয়ায় হাইকোর্টে রিট পিটিশন (নম্বর-৪০১৫/২০০৪) দায়ের করেন। হাইকোর্ট দখল বুঝিয়ে দেওয়ার জন্য আদেশ দেন। কিন্তু, হাইকোর্টের রায়ের বাস্তবায়ন না করে সরকার সুপ্রিম কোর্টের অ্যাপিলেট ডিভিশনে সিভিল পিটিশন ফর লিভ টু আপিল দায়ের করে। শুনানি শেষে তিনি রায় পান।

সব কোর্টের রায়ের আদেশ বাস্তবায়নের লক্ষ্যে এবং কনটেম্পট মামলার (নম্বর-২৩১/১০) আদেশের প্রেক্ষিতে ২০১০ সালের ৫ ডিসেম্বর গৃহায়ন ও গণপূর্ত মন্ত্রণালয় ১৯৮৬ সালের ২৩ সেপ্টেম্বরের বাংলাদেশ গেজেটে প্রকাশিত ‘ক’ তালিকা থেকে প্লটটি অবমুক্ত করে সৈয়দ তোরাব মজিদকে মালিকানা বুঝিয়ে দেয়। ২০১১ সালের ২১ মার্চ গণপূর্ত রক্ষণাবেক্ষণ বিভাগ প্লটটি তার কাছে হস্তান্তর করে, তিনি ১৬ জুন নামজারি করে নেন। টাকার প্রয়োজনে তিনি প্লটটি বিক্রি করতে চাইলে গৃহায়ন ও গৃণপূর্ত মন্ত্রণালয়ের উন্নয়ন শাখা ২০১১ সালের ১২ ‍জুলাই অনুমতি দেয়।

জমির মূল্য ৮ কোটি ও জরাজীর্ণ ইমারতের মূল্য ১২ লাখ ৭৫ হাজার টাকাসহ মোট ৮ কোটি ১২ লাখ ৭৫ হাজার টাকা নগদ গ্রহণ করে ২০১১ সালে ২৫ আগস্ট সৈয়দ তোরাব মজিদ প্লটটি পারভীন প্রপার্টিজ অ্যান্ড টেকনোলজিস লিমিটেডের কাছে বিক্রি করেন। দলিল গ্রহীতা হিসেবে পারভীন প্রপার্টিজ অ্যান্ড টেকনোলজিস লিমিটেডের ব্যবস্থাপনা পরিচালক পারভীন আকতার স্বাক্ষর করেন। তিনি বসুন্ধরা গ্রুপের সাবেক পরিচালক আবু সুফিয়ানের স্ত্রী বলে জানা গেছে।

১৯ সেপ্টেম্বর, ২০২৩ তারিখের গৃহায়ণ ও গণপূর্ত মন্ত্রণালয়ের উন্নয়ন অধিশাখার (৭) যুগ্মসচিব মুহাম্মদ ইকবাল হুসাইন স্বাক্ষরিত এক চিঠি সূত্রে জানা গেছে, পারভীন প্রপার্টিজ অ্যান্ড টেকনোলজিস লিমিটেডের আবেদনের প্রেক্ষিতে ৩৯ জন ব্যক্তির নামে প্লটটি হস্তান্তর ও নামজারির অনুমতি দেওয়া হয়। হস্তান্তর করেছেন পারভীন প্রপার্টিজ অ্যান্ড টেকনোলজিস লিমিটেডের ব্যবস্থাপনা পরিচালক পারভীন আকতার।

মেসেঞ্জার/দিশা