ঢাকা,  বৃহস্পতিবার
৩০ জানুয়ারি ২০২৫

The Daily Messenger

দুর্নীতি প্রমাণিত হওয়ার পরেও চাকুরিতে বহাল

দোয়ারাবাজার(সুনামগঞ্জ) প্রতিনিধি

প্রকাশিত: ১৪:৫১, ২৯ জানুয়ারি ২০২৫

আপডেট: ১৪:৫৪, ২৯ জানুয়ারি ২০২৫

দুর্নীতি প্রমাণিত হওয়ার পরেও চাকুরিতে বহাল

ছবি: মেসেঞ্জার

বিগত আওয়ামীলীগ সরকারের আমলে বরইউড়ি দারুস সুন্নাত বহুমুখী আলিম মাদ্রাসায় নিজের একচ্ছত্র কর্তৃত্ব বিস্তার করেছিলেন মাদ্রাসার অধ্যক্ষ মাওলানা সৈয়দ হোসেন কবির। প্রতিষ্ঠানের অর্থআত্মসাৎ, ভুয়া নিয়োগ এবং নিয়োগ বানিজ্যসহ একের পর এক বিভিন্ন অনিয়ম ও দূর্নীতিতে জড়িয়েছেন তিনি।

প্রশাসনের তদন্তে দূর্নীতি প্রমাণিত হওয়ার পরেও সুনামগঞ্জের দোয়ারাবাজার উপজেলার বরইউড়ি দারুস সুন্নাত বহুমুখী আলিম মাদ্রাসায় অধ্যক্ষ পদে বহাল তবিয়তে রয়েছেন সৈয়দ হোসেন কবির ও তাঁর মাধ্যমে অবৈধভাবে নিয়োগপ্রাপ্ত শিক্ষক-কর্মচারীরা। এব্যাপারে একাধিকবার অভিযোগ দেওয়া হলেও কেবলমাত্র তদন্ত করেই দায় এড়ানো হচ্ছে। এখনো পর্যন্ত অধ্যক্ষ সৈয়দ হোসেন কবির ও তাঁর সহযোগীদের বিরুদ্ধে কোনো ধরণের পদক্ষেপ নেওয়া হয়নি।

অনুসন্ধান করে দেখা গেছে, বরইউড়ি দারুস সুন্নাত বহুমুখী আলিম মাদ্রাসায় ২০১৫ সালে চারজন প্রভাষককে নিয়োগ দেখিয়ে ২০২৪ সালে এমপিও করা হয়। তাঁরা হলেন আরবি প্রভাষক মাহবুবুর রহমান, বাংলা প্রভাষক মাহমুদুল হাসান, রাষ্ট্রবিজ্ঞান প্রভাষক মুজিবুর রহমান ও ইংরেজি প্রভাষক আব্দুছ ছালাম। অথচ ২০১৫ সালে এই প্রতিষ্ঠানে কোনো নিয়োগই হয়নি।

এমনকি ২০২৪ সালের আগে এই চারজন প্রভাষক একদিনও মাদ্রাসায় পাঠদান করেননি এবং তাদেরকে এলাকার কেউ আগে কখনো দেখেওনি। অভিযোগ রয়েছে, মোটা অংকের টাকার বিনিময়ে অবৈধভাবে এই চার প্রভাষক নিয়োগ দিয়েছেন অধ্যক্ষ সৈয়দ হোসেন কবির। এই চারজনের নিয়োগকে বৈধতা দিতে গিয়ে তিনি পত্রিকায় কোনো নিয়োগ বিজ্ঞপ্তি ছাড়াই ভুয়া নিয়োগ বিজ্ঞপ্তির মাধ্যমে প্রতারনার আশ্রয় নিয়েছেন। শুধু তাই নয়, নিয়োগ কমিটির নামেও প্রতারণা করা হয়েছেন।

শিক্ষক নিয়োগের ফলাফল সিটে নিয়োগ পরীক্ষার সাক্ষাৎকার গ্রহণের সময় দেখানো হয়েছে ২০১৫ সালের ১৭ মে। নিয়োগ কমিটির স্বাক্ষরে কলাউরা দারুসসুন্নাত কাশেমিয়া সিনিয়র মাদ্রাসার প্রিন্সিপাল হিসেবে রফিকুল ইসলামের সাক্ষর দেখানো হয়েছে। অথচ এর দুইবছর আগে ২০১৩ সালে রফিকুল ইসলাম মৃত্যুবরণ করেছেন এবং ২০১২ সালে অধ্যক্ষ পদ থেকে তিনি অবসরে গেছেন। প্রশ্ন উঠেছে তাহলে মারা যাওয়ার পর ২০১৫ সালে শিক্ষক নিয়োগের ফলাফল সিটে কলাউরা দারুসসুন্নাত কাশেমিয়া সিনিয়র মাদ্রাসার প্রিন্সিপাল হিসেবে রফিকুল ইসলামের সাক্ষর আসলো কিভাবে ? এছাড়াও বরইউড়ি দারুস সুন্নাত বহুমুখী আলিম মাদ্রাসায় ২০২০ সালের চতুর্থ শ্রেণীর কর্মচারী নিয়োগ প্রক্রিয়াটিও ছিলো ক্রটিপূর্ণ। নিয়োগ প্রক্রিয়ায় একজন যোগ্য প্রার্থীর সর্বনিন্ম বয়স ১৮ হতে হয়।

কিন্তু এরচেয়েও কম বয়সী একজন প্রার্থীকে ওইসময় নিয়োগ দেওয়া হয়। এভাবেই প্রতারনা ও জালিয়াতির মাধ্যমে চারজন শিক্ষকসহ একজন কর্মচারী নিয়োগ দেন সৈয়দ হোসেন কবির। ২০২৪ সালের ১৪ নভেম্বর অধ্যক্ষ সৈয়দ হোসেন কবিরের দূর্নীতির নিয়ে তদন্ত করে একটি তদন্ত প্রতিবেদন দেয় দোয়ারাবাজার উপজেলা প্রশাসন। যার স্মারকনং-০৫.৪৬.৯০৩৩.০০০.০৪.০০৮.২০. ৯৭৩।

দোয়ারাবাজার উপজেলা নির্বাহী কর্মকর্তা (ইউএনও) নেহের নিগার তনুর স্বাক্ষরিত ও সুপারিশকৃত ওই তদন্ত প্রতিবেদনেও উল্লেখ করা হয়, অধ্যক্ষ সৈয়দ হোসেন কবির মোটা অংকের টাকার বিনিময়ে অবৈধভাবে চারজন শিক্ষকসহ একজন কর্মচারী নিয়োগ দিয়েছেন। এছাড়াও তিনি সরকারি নীতিমালা অনুসরণে কোনো কাজ করেননি। বছরের পর বছর ধরে অবৈধভাবে প্রতিষ্ঠানের টাকা ব্যাংকে না রেখে নিজের কাছে রেখেছেন। বিগত বছরের কোনো ব্যয়ের হিসাব দিতে পারেননি তিনি। মাদ্রাসার শিক্ষক কর্মচারিদের কাছ থেকে এমপিও করে দেওয়ার নামেও কয়েক লাখ টাকা হাতিয়ে নিয়েছেন প্রিন্সিপাল সৈয়দ হোসেন কবির।

সরেজমিনে বরইউড়ি দারুস সুন্নাত বহুমুখী আলিম মাদ্রাসায় গিয়ে দেখা যায়, প্রিন্সিপাল সৈয়দ হোসেন কবিরের মাধ্যমে অবৈধভাবে নিয়োগ পাওয়া চার শিক্ষক ও এক কর্মচারী এখনো পর্যন্ত চাকুরিতে বহাল রয়েছেন। তদন্তের সময় দুইমাস তাদের বেতন ভাতা বন্ধ থাকলেও অদৃশ্য কারণে গত ডিসেম্বর মাস থেকে বেতন ভাতা পুনরায় চালু হয়েছে। সাংবাদিকদের উপস্থিতি টের পেয়ে পালিয়ে যাচ্ছিলেন এই চার শিক্ষক। পরে এদের মধ্যে দুজন শিক্ষকের মুখোমুখি হলে তারা জানান, ইউএনও’র কাছে অনুরোধ করে বেতন চালু করেছেন। তবে এবিষয়ে আর কোনো কথা বলতে অপারগতা প্রকাশ করেন তাঁরা।

মাদ্রাসার গভর্নিংবডির সদস্য আব্দুল মালেক জানান, শিক্ষকদের অতিরিক্ত বেতনসহ অন্যান্য খাতের খরচ দেখিয়ে প্রতিষ্ঠানের ৬ লাখ ৩৮ হাজার টাকা এবং প্রতিষ্ঠানের আয় গোপন করে প্রায় ৮ লাখ টাকা আত্মসাৎ করেছেন অধ্যক্ষ সৈয়দ হোসেন কবির।

মাদ্রাসার গভর্নিংবডির সদস্য ও সহকারি মৌলভী মোঃ অহিদুল ইসলাম বলেন, ‘প্রায় ২২ বছর ধরে প্রিন্সিপাল হিসেবে দায়িত্ব পালন করছেন মাওলানা সৈয়দ হোসেন কবির। কিন্তু এই ২২ বছরের মধ্যে মাদ্রাসার যতো আর্থিক লেনদেন ও আয় ব্যয় হয়েছে তার কোনো হিসাব তিনি দিতে পারেননি। মাদ্রাসায় উনার একক কর্তৃত্ব প্রতিষ্ঠা করতে গিয়ে তিনি স্থানীয় এমপি ও আওয়ামীলীগ নেতাদের দাপট দেখাতেন।

শিক্ষার্থীদের ভর্তি, বেতন, প্রশংসা পত্র, ফরম ফিলাপ, রেজিস্ট্রেশন ফি এবং টিউশন ফির সব টাকা প্রিন্সিপাল এবং কেরানি মুজিবুর রহমান মিলে আত্মসাৎ করেছেন। চলতি বছরের শিক্ষার্থী ভর্তির কোনো হিসাবও তিনি দিচ্ছেন না। প্রতিষ্ঠানের টাকা ব্যাংকে না রেখে নিজের কাছে রাখেন। নিজের ইচ্ছেমতো বিল ভাউচার বানাতেন। আমরা প্রতিবাদ করলে আমাদেরকে বিভিন্নভাবে হয়রানি করা হতো।’

তিনি আরো বলেন, ‘আমাদের শিক্ষকদের এমপিও করানোর কথা বলে তিন শিক্ষকের কাছ থেকে তিন লাখ টাকা নিয়েছেন প্রিন্সিপাল সৈয়দ হোসেন কবির। বিগত দিনে আমরা শিক্ষকরা কোনো বেসরকারি বেতন পাইনি। অথচ আমাদের বেসরকারি বেতনের টাকাও তিনি আত্মসাৎ করেছেন।’

ভারপ্রাপ্ত অধ্যক্ষ মাওলানা আব্দুল আজিজ বলেন, ‘প্রিন্সিপাল সৈয়দ হোসেন কবিরের বিভিন্ন অনিয়ম ও দূর্নীতির বিষয়ে পরপর তিনবার তদন্ত হয়েছে। তদন্তে তাঁর দূর্নীতি প্রমাণিত হওয়ার পর তাকে অপসারণের দাবি জানিয়েছেন শিক্ষার্থী, অভিভাবক ও এলাকাবাসী। ছাত্রজনতার তোপের মুখে তিনি এখন আর প্রতিষ্ঠানে আসেন না। কলেজের গভর্নিংবডি ও ইউএনও মহোদয় আমাকে বিধি মোতাবেক ভারপ্রাপ্ত অধ্যক্ষের দায়িত্ব দিয়েছেন।’

মাদ্রাসার গভর্নিংবডির সাবেক সভাপতি হাসমত উল্লাহ বলেন, ‘আমি সভাপতি থাকাকালীন হঠ্যাৎ চারজন শিক্ষক তাদের বিল সই করানোর জন্য আমার কাছে আসে। আমি উনাদের কাউকেই চিনতাম না এবং এর আগে কখনো মাদ্রাসায় দেখিনি। মাদ্রাসায় না এসে, পাঠদান না করে কিভাবে বিল তুলতে আসলো তা নিয়ে আমার শুরু থেকেই সন্দেহ হয়। আমি সই না দিলে তাদের বিলে সই দিতে আমাকে জোড়ালো ভাবে অনুরোধ করেন প্রিন্সিপাল সৈয়দ হোসেন কবির।

এরপরই আমার সন্দেহ বেড়ে যায়। পরবর্তীতে আমি ছয়মাস তাদের বিল আটকে রাখি। কিন্তু ওই চার শিক্ষক এসে আমার হাতে পায়ে ধরে কান্নাকাটি করেন এবং প্রিন্সিপাল ও কমিটির সদস্যদের চাপে শেষ পর্যন্ত তাদের বিলে সাক্ষর করি। তাদের কাছ থেকে আমি কোনো টাকা পয়সা গ্রহণ করিনি। তবে মাদ্রাসার উন্নয়নের জন্য মাদ্রাসার ফান্ডে তারা চারজন ১ লাখ ৯০ হাজার টাকা দিয়েছিলো আমাদের অনুরোধে। আমি কখনোই জানতাম না যে চারজন প্রভাষকের ভুয়া বিজ্ঞপ্তির মাধ্যমে আমার মাদ্রাসায় চাকুরি হয়েছে। জানলে তাদের বিলে সই করতাম না।’

বিভিন্ন অনিয়ম ও দূর্নীতির বিষয়ে জানতে চাইলে বরইউড়ি দারুস সুন্নাত বহুমুখী আলিম মাদ্রাসার সৈয়দ হোসেন কবির বলেন, ‘আমার বিরুদ্ধে বিভিন্ন ষড়যন্ত্র চলছে। আমি অসুস্থ। আমি এসব তদন্তের বিষয়ে কিছুই জানিনা। তাঁরা তাদের মতো করে এসব করছে।’
ভুয়া বিজ্ঞপ্তির মাধ্যমে শিক্ষক নিয়োগের বিষয়ে জানতে চাইলে তিনি কোনো উত্তর না দিয়ে কলে কেটে দেন। পরে একাধিক বার কল দেওয়া হলেও তিনি রিসিভ করেননি।

জানতে চাইলে মাদ্রাসার গভর্নিং বডির সভাপতি ও দোয়ারাবাজার উপজেলা নির্বাহী কর্মকর্তা (ইউএনও) নেহের নিগার তনু জানান, ‘তদন্তের সময় বেতন বন্ধ রেখেছিলাম। তদন্ত শেষ তাই বতন পুনরায় চালু করেছি। তদন্ত করে প্রিন্সিপাল সৈয়দ হোসেন কবিরের অনিয়ম ও দূর্নীতির প্রমাণ পেয়েছি। তাঁর বিরুদ্ধে বিধি মোতাবেক প্রয়োজনীয় ব্যবস্থা গ্রহণের জন্য উর্ধ্বতন কর্তৃপক্ষের নিকট সুপারিশ করেছি। এখন যা পদক্ষেপ নেওয়ার তারা নেবে।’

সুনামগঞ্জ জেলা মাধ্যমিক শিক্ষা কর্মকর্তা মোঃ জাহাঙ্গীর হোসেন জানান, ‘প্রিন্সিপাল সৈয়দ হোসেন কবিরের বিরুদ্ধে তদন্ত করে দূর্নীতির প্রমাণ পাওয়া গেছে। সর্বশেষ তদন্তের রিপোর্ট এখনো চলমান। এই রিপোর্ট হাতে আসার পর পরবর্তী পদক্ষেপ নেওয়া হবে। আর ভুয়া বিজ্ঞপ্তির মাধ্যমে শিক্ষক নিয়োগ হয়ে থাকলে তাদের বিরুদ্ধেও বিধি মোতাবেক ব্যবস্থা নেওয়া হবে।

মেসেঞ্জার/আশিস/জেআরটি