ঢাকা,  বৃহস্পতিবার
০২ জানুয়ারি ২০২৫

The Daily Messenger

উন্নয়ন ও মানবিক প্রচেষ্টার রূপান্তর ঘটাচ্ছে লোকালাইজেশন

মেসেঞ্জার অনলাইন

প্রকাশিত: ১৬:৪৯, ৩০ ডিসেম্বর ২০২৪

উন্নয়ন ও মানবিক প্রচেষ্টার রূপান্তর ঘটাচ্ছে লোকালাইজেশন

ছবি : মেসেঞ্জার

বাংলাদেশের উপকূলীয় অঞ্চলের উন্নয়ন কর্মকাণ্ডে বড় পরিবর্তন ঘটাচ্ছে লোকালাইজেশন বা স্থানীয়করণ। এই পদ্ধতি নিজেদের উন্নয়নে স্থানীয় মানুষদের আরও বেশী শক্তিশালী করছে এবং উন্নয়ন অংশীদারদের আবহমান সহায়তা প্রদানের পদ্ধতিসমূহের বিপরীতে আরও সহজ ও কার্যকরি পদ্ধতি হিসেবে প্রতিষ্ঠিত করছে।

বাংলাদেশে শেয়ার ট্রাস্টের লোকাল কোয়ালিশন অ্যাক্সিলারেটর (এলসিএ) উদ্যোগের মাধ্যমে সুন্দরবন কোয়ালিশন এই পরিবর্তন ঘটাচ্ছে। এই কোয়ালিশনের মূল লক্ষ্য হলো কমিউনিটি ও কমিউনিটি-বেসড সংগঠনগুলোর (সিবিও) মাধ্যমে মানুষদের ক্ষমতায়ন করা। ২০২২ সালে উত্তরণ, সিএনআরএস, জাগো নারী এবং আভাস একত্র হয়ে সুন্দরবন কোয়ালিশন গঠন করে। এই জোটের আওতায় সুন্দরবন অঞ্চলের চারটি জেলার ১২টি সিবিও কাজ করছে। তাদের উদ্দেশ্য দক্ষিণ-পশ্চিম উপকূলীয় অঞ্চলে দুর্যোগ মোকাবেলায় দক্ষ কমিউনিটি গড়ে তোলা এবং স্থানীয় মানুষের মাধ্যমেই সমাধানের উপায় খুঁজে বের করা ও সমাধান নিশ্চিত করা। সুন্দরবন কোয়ালিশনের মাধ্যমে গত তিন বছরে, শ্যামনগর, কয়রা, কলাপাড়া ও তালতলীর মতো সুন্দরবন অধ্যুশ্যিত এলাকায় প্রায় ১,২০,০০০ মানুষের জীবনে পরিবর্তন এসেছে।

এই কোয়ালিশনের একটি উল্লেখযোগ্য দিক তাদের সরাসরি অর্থায়নের কৌশল। এতে মোট বাজেটের ৮০% কর্মসূচি বাস্তবায়নে এবং ২০% ব্যবস্থাপনা খাতে ব্যয় হয়। এর ফলে আন্তর্জাতিক সংস্থার তুলনায় পরিচালন ব্যয় কমেছে ৩২%। এছাড়া এই পদ্ধতিতে কমিউনিটির সদস্যরাও  বিভিন্নভাবে (শ্রম, জমি এবং অর্থসহ) অবদান রাখে, যা স্থানীয় নেতৃত্বকে আরও  বেশি শক্তিশালী করে। এই কোয়ালিশন ১৬ সদস্য বিশিষ্ট গভর্নেন্স কাউন্সিলের মাধ্যমে পরিচালিত, যা সকল সদস্যের প্রতিনিধিত্ব নিশ্চিত করে। দুর্যোগ প্রতিরোধ, দুর্যোগ ঝুঁকি হ্রাস, ওয়াশ, জীবিকা এবং অবকাঠামো উন্নয়নের ক্ষেত্রে স্থানীয় চাহিদার ওপর ভিত্তি করে যৌথ কর্মপরিকল্পনা করা হয় এবং কর্মকান্ড বাস্তবায়ন করা হয়।

সুন্দরবন কোয়ালিশনের আয়োজনে সম্প্রতি ঢাকায় অনুষ্ঠিত হয়েছে ‘স্ট্রেনদেনিং ডিজাস্টার রেজিলিয়েন্স থ্রু দ্য এলসিএ মডেল: লেসনস ফ্রম বাংলাদেশ’স কোস্টাল রিজিওন’ শীর্ষক রাউন্ড টেবিল আলোচনা। এতে কোয়ালিশনের অর্জন, চ্যালেঞ্জ এবং ভবিষ্যতের দিকনির্দেশনা নিয়ে আলোচনা হয়। আলোচনায় সুন্দরবন কোয়ালিশনের অন্যতম ফোকাল পারসন জহুরুল হাসান সোহেল এবং ধুলাসার উপকূল সার্বিক গ্রাম উন্নয়ন সমবায় সমিতির নির্বাহী পরিচালক ও কোয়ালিশন সদস্য উম্মে হাফসা রিপা। এতে কোয়ালিশনের কার্যক্রম, গভর্নেন্স, জয়েন্ট অ্যাকশন প্ল্যান, কমপ্লায়েন্সসহ বিভিন্ন বিষয় উপস্থাপন করেন কোয়ালিশনের হোস্ট সংস্থা উত্তরণের হেড অফ প্রোগ্রাম জাহিদ আমিন শাশ্বত। সঞ্চালনায় ছিলেন দ্য শেয়ার ট্রাস্টের কান্ট্রি রিপ্রেজেন্টিভ মাহফুজা মালা।

আভাস-এর নির্বাহী পরিচালক রহিমা সুলতানা কাজল বলেন, ‘‘আমরা লোকালাইজেশনকে নিজের মতো করে সংজ্ঞায়িত করি। ৯০-এর দশকে সংস্থাগুলো আমাদের কাছে প্রকল্প এনে বলত কী করতে হবে এবং কীভাবে অর্থ ব্যয় করতে হবে। এখন আর তা হয় না। বর্তমানে আমরা নিজেদের অভিজ্ঞতা ও দক্ষতা অনুযায়ী নিজেরাই প্রকল্প জমা দিই। লোকালাইজেশন আইসিআরের মতো শুধুমাত্র একটি নীতি নয়, এটি মানুষের কল্যাণ নিশ্চিত করে, স্থানীয় সরকার ও বেসরকারি খাতকে সম্পৃক্ত করে এবং স্থানীয় সংস্থাগুলোকে তাদের দায়িত্ব পালনের সুযোগ করে দেয়। আবার এটি স্থানীয় সংগঠন হিসেবে আমাদের নিজের প্রয়োজনীয়তা প্রকাশ করার জায়গা রয়েছে কিনা তাও নিশ্চিত করে। যদি এমন হয় তাহলে বলতে পারি লোকালাইজেশন কার্যকর হচ্ছে।’’

নেদারল্যান্ডসের বাংলাদেশ দূতাবাসের সিনিয়র পলিসি অ্যাডভাইজার মো. শিবলি সাদিক বলেন, ‘‘যখন আমরা কোনো প্রকল্প গ্রহণ করি সেখানে কমপ্লায়েন্সের মতোই পার্টনারদের জন্য কিছু নিয়ম থাকে। এসব নিয়ম প্রায় কঠিন হয়। ফলে অনেক দক্ষ সংস্থার সঙ্গে চাইলেও কাজ করা সম্ভব হয় না। এটি অবশ্য ট্র্যাডিশনাল সমস্যা। বর্তমানে গ্লোবালি এ বিষয়ে আলোচনা হচ্ছে এবং আমরাও নিজেদের লক্ষ্য থেকে সরে যাচ্ছি কি না তা ভাবছি। আমরা বর্তমানে উত্তরণ এবং ফ্রেন্ডশিপ-এর সঙ্গে আরটিএফ (রিভার্সি দ্য ফ্লো) উদ্যোগ নিয়ে কাজ করছি। আশা করছি এর মাধ্যমে তাদের কাছ থেকে একটি কার্যকর ফ্রেমওয়ার্ক পাব। পাশাপাশি এই কর্মসূচির অধীনে আমরা কিছু জায়গায় সরাসরি অর্থায়ন করছি। অভ্যন্তরীণভাবে কী পরিবর্তন আনতে হবে তা নিয়েও আলোচনা চলছে।’’

লোকালাইজেশনের বিকাশকে প্রাধান্য দিলেও এই আলোচনায় বিশেষজ্ঞরা উন্নয়ন কার্যক্রমের বিভিন্ন চ্যালেঞ্জ, সুযোগ এবং দৃষ্টিকোণও নিয়ে তাদের মতামত তুলে ধরেন। তারা উল্লেখ করেন, দুর্যোগ, রাজনৈতিক ক্রাইসিস ও ফান্ড সংকটের মুখে লোকালাইজেশনের সুষ্পষ্ট ন্যারেটিভ প্রয়োজন। অপরদিকে কমিউনিটি-বেসড সংগঠনের ক্ষমতায়তনে আরটিএফ এবং এলসিএর মতো উদ্যোগগুলো গুরুত্বপূর্ণ পদক্ষেপ হিসেবে দেখা হচ্ছে।

লোকালাইজেশন নিয়ে বাংলাদেশে কাজ করা অন্যতম আন্তর্জাতিক সংগঠন স্টার্ট ফান্ড বাংলাদেশের কান্ট্রি ম্যানেজার সাজিদ রায়হান বলেন, ‘‘লোকালাইজেশন ধারণাটি এসেছে গ্লোবাল নর্থ থেকে। ফলে এর স্পষ্ট ন্যারেটিভ প্রয়োজন। বর্তমানে বিশ্বজুড়ে দুর্যোগ, রাজনৈতিক সংকট এবং যুদ্ধ বাড়ছে। একই সঙ্গে কমে আসছে ফান্ড। তাই আমাদের এই সীমিত ফান্ড আরও কার্যকরভাবে কীভাবে ব্যবহার করা যায় এবং কমিউনিটি বেসড সংগঠনগুলোর কীভাবে ক্ষমতায়ন করা যায় তা নিয়ে ভাবতে হবে। আরটিএফ এবং এলসিএর মতো প্রকল্পগুলো লোকালাইজেশনের ন্যারেটিভ তৈরির প্রচেষ্টা। এই প্রকল্পগুলো লোকালাইজেশনকে স্থানীয়রা কীভাবে দেখে তা বুঝতে সাহায্য করবে; বিশেষ করে ফান্ড কীভাবে ব্যয় হবে, কীভাবে পার্টনারশিপ গড়ে তোলা যাবে এবং কমপ্লায়েন্স নিশ্চিত করা যাবে।’’

ক্রিশ্চিয়ান এইডের কান্ট্রি ডিরেক্টর নুজহাত জাবিন বলেন, ‘‘আন্তর্জাতিক সংস্থা হিসেবে আমরা অনেক বিষয় নিয়ে কাজ করছি। এর মধ্যে রয়েছে প্রান্তিক জনগোষ্ঠী বিশেষ করে তৃতীয় লিঙ্গের জনগোষ্ঠী এবং ঝুঁকিপূর্ণ নারীদের সহায়তা করা। লোকালাইজেশন নিয়ে আলোচনায় আমরা সক্ষমতা ও জবাবদিহিতার ঘাটতি পেয়েছি। আমরা এসব বিষয়েও কাজ করি। আসলে আমরা সবাই ঝুঁকি ভাগাভাগি করি এবং নির্দিষ্ট প্রকিউরমেন্ট অনুযায়ী কাজ করি। আমাদের লক্ষ্য হলো দীর্ঘমেয়াদে স্থানীয় সংগঠনগুলোর সঙ্গে কাজ করা এবং ঘাটতি কমাতে মেন্টরিং দেওয়া।’’

বাংলাদেশে এলসিএ মডেল সফলতা পেলেও এটি এখনো কিছু চ্যালেঞ্জের মুখোমুখি। যেমন বাংলাদেশ এনজিও অ্যাফেয়ার্স ব্যুরোর কমপ্লায়েন্স সংক্রান্ত বিধিনিষেধ, যা অনিবন্ধিত সিবিওগুলোকে বিদেশি তহবিল পাওয়া থেকে বিরত রাখে। এছাড়াও রয়েছে বিভিন্ন চাহিদা মেটাতে সীমিত বাজেট ও সক্ষমতার ঘাটতি। যদিও সিদ্ধান্ত গ্রহণে স্বচ্ছতা, কোয়ালিশন তৈরি এবং দীর্ঘমেয়াদী পরিকল্পনা এসব চ্যালেঞ্জ মোকাবিলায় কার্যকর প্রমাণিত হয়েছে। লোকালাইজেশনে আরও জোর দিতে নীতি সংস্কার, সক্ষমতা বৃদ্ধি এবং অন্তর্ভুক্তিমূলক ফান্ডিং মডেলের সুপারিশও করেন বিশেষজ্ঞরা। এসব পদক্ষেপ কমিউনিটিগুলোকে তাদের কার্যক্রম পরিচালনার পাশাপাশি স্থানীয় অগ্রাধিকার অনুযায়ী টেকসই উন্নয়ন নিশ্চিত করবে।

মেসেঞ্জার/তুষার