ঢাকা,  বৃহস্পতিবার
১৯ সেপ্টেম্বর ২০২৪

The Daily Messenger

ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় কি আদৌ শিক্ষা বান্ধব?

মাহমুদ নকীব 

প্রকাশিত: ১৯:২৩, ১৪ সেপ্টেম্বর ২০২৪

ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় কি আদৌ শিক্ষা বান্ধব?

ছবি : মেসেঞ্জার

শিক্ষা অর্জন বা জ্ঞান অর্জনের জন্য পরিবেশ একটি গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করে৷ শিক্ষা প্রতিষ্ঠানের পরিবেশ যদি মনোরম হয়, অর্থাৎ এই পরিবেশ যদি শিক্ষার্থীদের মনকে প্রশান্ত করতে পারে তাহলে যেমন তা শিক্ষা অর্জনকে চালিত করে, তেমনি কোলাহলপূর্ণ পরিবেশ শিক্ষাকে ব্যাহত করে বহুলাংশে।

অবস্থানের কারণেই ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় সবসময়ই গুরুত্বপূর্ণ একটি জায়গা। তবে, ঢাকা শহরের প্রাণকেন্দ্রে অবস্থিত এ বিশ্ববিদ্যালয়ের প্রধান সমস্যাগুলোর অন্যতম 'বহিরাগত সমস্যার' সৃষ্টি এর অবস্থানের কারণেই। যুগ যুগ ধরে চলে আসা এ সমস্যাটিকে কিভাবে দেখছে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের নতুন প্রশাসন। সেটিই জানার চেষ্টা করা হয়েছে এ প্রতিবেদনে।

ঢাকা শহরের অবস্থানগত এবং নান্দনিকতার কারণে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় ঢাকাবাসী মানুষের কাছে যেন স্বস্তির ঠিকানা। আড্ডা, খোঁশগল্প করার জন্য পারফেক্ট একটি জায়গা। এছাড়া, যেকোনো আন্দোলন-সংগ্রামের সুতিকার ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে আন্দোলন সংগ্রাম চলতেই থাকে। ক্যাম্পাসটি যেন এসবের জন্য সবচেয়ে উপযুক্ত একটি জায়গা। অথচ ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের প্রধান কার্যক্রম 'শিক্ষা' প্রদান। ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় ক্যাম্পাস কতটুকু শিক্ষা-শিক্ষার্থী বান্ধব?

বহিরাগত সমস্যা

ঘুরে বেড়ানো, আড্ডা দেওয়ার জন্য ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় ক্যাম্পাস আদর্শ একটি জায়গা। প্রতিদিন বিকাল হলেই বহিরাগতদের আনাগোনা বাড়ে ক্যাম্পাসে। যা ঢাবি শিক্ষার্থীদের জন্য অসুবিধাজনক। মঙ্গলবার (১০ সেপ্টেম্বর) বহিরাগত কমানোর লক্ষ্যে টিএসসিসহ ক্যাম্পাসে সকল ভাসমান দোকান উচ্ছেদ করেছে বিশ্ববিদ্যালয় প্রশাসন। অথচ, ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের সকল প্রবেশমুখ অরক্ষিত। এসব প্রবেশমুখ দিয়ে অবাধে ঢুকছে বহিরাগত ব্যক্তি, গাড়ি এমনকি বাস-ট্রাকও। জুলাই বিপ্লবে অস্ত্রধারী বহিরাগতদের হাতে নির্মমভাবে হামলার শিকার হতে হয় ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় শিক্ষার্থীদের। এরপর থেকে ক্যাম্পাসে শিক্ষার্থীদের নিরাপত্তার বিষয়টি উঠে আসে।

অথচ হল, পুরো ক্যাম্পাসের নিরাপত্তার জন্য প্রায় ৭০০ নিরাপত্তাপ্রহরী নিয়োজিত আছেন বিশ্ববিদ্যালয়ে। কিন্তু ক্যাম্পাসে তাদের দেখা মেলা ভার। ৭০০ নিরাপত্তা কর্মীর কোন নির্দিষ্ট পোশাক নেই, তাই দেখে বোঝার উপায় নেই আসেপাশে কে নিরাপত্তা কর্মী। সাবেক উপাচার্য মাকসুদ কামাল নিরাপত্তা কর্মীদের নির্দিষ্ট পোশাকের আওতায় আনতে চাইলেও তিনি তা পারেননি। জানাগেছে, ইউনিফর্ম পড়ে ডিউটি করতে এসব নিরাপত্তা কর্মীদের অনেকেই নারাজ। 

এদিকে, ২০২৩ সালের (১৬ জুন) অনিয়ন্ত্রিত যানবাহন ও বহিরাগতদের অবাধ প্রবেশ ঠেকাতে শাহবাগ, নীলক্ষেত (গণতন্ত্র ও মুক্তি তোরণ গেট), শেখ রাসেল টাওয়ারের সামনে ও দোয়েল চত্বর থেকে ক্যাম্পাস অভিমুখে পাঁচটি সিকিউরিটি সার্ভিল্যান্স (নিরাপত্তাচৌকি) বসিয়েছে বিশ্ববিদ্যালয়। সরেজমিনে পরিদর্শন করে, ক্যাম্পাসের নিরাপত্তা চৌকিগুলোতে কোন নিরাপত্তারক্ষীকে খুঁজে পাওয়া যায়নি। ফলে ২৪ ঘণ্টা অরক্ষিত ভাবেই থাকে এ বিশ্ববিদ্যালয় ক্যাম্পাস।

উদ্বাস্তু আতঙ্ক 

নিজ ক্যাম্পাসে উদ্বাস্তু-ছিন্নমূল মানুষের দ্বারা হেনস্তার শিকার হতে হয় ঢাবি শিক্ষার্থীদের। প্রতিদিন সন্ধ্যা হলেই ক্যাম্পাস যেন উদ্বাস্তু, নেশাখোরদের আবাসস্থলে পরিণত হয়। টিএসসি, শহীদমিনার, কার্জন, শহিদুল্লাহ হল, বাংলা একাডেমি এলাকা, ফুলার রোড, কাজী নজরুল ইসলামের সমাধি, সমাজ বিজ্ঞান চত্বর, আইএমএল’র সম্মুখের যাত্রী ছাউনি, রোকেয়া হলের পাশের ফুটপাতসহ ক্যাম্পাসের যেকোনো ফুটপাতেই ভাসমান নেশাগ্রস্তদের অবাধ বিচরণ দেখা যায়। অনেকে তাদের পরিবার নিয়ে সংসার পেতে বসেছে ক্যাম্পাস এলাকায়। তাদের যত্রতত্র মল-মুত্র ত্যাগ করে ক্যাম্পাসের পরিবেশ অস্বস্তিকর করে তুলেছে। এদের দ্বারা বিভিন্ন সময় হেনস্তার শিকার বলে বিভিন্ন সময়ে অভিযোগ করেছেন নারী শিক্ষার্থীরা। 

শিক্ষা বান্ধব ?

ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের প্রাণ কেন্দ্র টিএসসি, রাজু ভাস্কর্য চত্ত্বর, ডাস ও হাকিম চত্বরের পাশেই বিশ্ববিদ্যালয়ের কেন্দ্রীয় গ্রন্থাগার। ঢাবি শিক্ষার্থীদের অধিকার আদায়ের প্রধান জায়গা রাজু ভাস্কর্য। অভ্যুত্থান পরবর্তী সময়ে রাজুতে সমাবেশ মিছিল মিটিংএর হার বেড়েছে কয়েকগুণ। এমনকি বহিরাগত, রিকশাওয়ালারাও সন্ত্রাস বিরোধী রাজু ভাস্কর্যের পাদদেশে কর্মসূচি করছে। এসব সভা সমাবেশে ব্যবহৃত মাইক-সাউন্ড বক্স থেকে সৃষ্ট শব্দে কেন্দ্রীয় গ্রন্থাগারে অধ্যয়নরত শিক্ষার্থীদের পোহাতে হচ্ছে নানা ঝামেলা। পড়াশোনায় মনোযোগ বিচ্ছিন্ন হওয়াসহ নানা ঝামেলায় পড়তে হচ্ছে। ক্যাম্পাসে শিক্ষার্থীদের মূল কাজ পড়াশোনা ব্যাহত হচ্ছে।

এদিকে, ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের টিএসসি এলাকাতে প্রায় সময়ই যানজট লেগেই থাকে। এই এলাকাতে রোকেয়া হল, শামসুন্নাহার হলের অবস্থান হওয়ায় এসব হলের আবাসিক ছাত্রদের পড়ালেখা, ঘুমসহ বিভিন্ন কাজে ব্যাঘাত ঘটে। পরীক্ষার সময় এ সংকট আর তীব্রতর হয়।

বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থার মতে, ৬০ ডেসিবেল মাত্রার বেশী শব্দ হলে সেই এলাকা দূষিত বলে চিহ্নিত হবে। শোবার ঘরে ২৫ ডেসিবেল, শ্রেণীকক্ষে ৩০ থেকে ৪০ ডেসিবেল, লাইব্রেরিতে ৩৫ থেকে ৪০ ডেসিবেল শব্দ মাত্রা সহনীয়।

পরিবেশ অধিদফতর, নিরাপদ ডেভেলাপমেন্ট ফাউন্ডেশন ও ওয়ার্ক ফর বেটার বাংলাদেশ ট্রাস্ট ঢাকা শহরের শব্দদূষণের অবস্থা নিরূপণের জন্য ২০১৩ সালের নভেম্বর মাসে শব্দের মাত্রা জরিপ করে। জরিপের তথ্য অনুসারে, দিনের বেলায় ঢাবির পার্শ্ববর্তী শাহবাগ মোড়ে শব্দের মাত্রা ৯২ ডেসিবেল, নীলক্ষেত মার্কেটে শব্দ মাত্রা ৮০ ডেসিবেল, নীলক্ষেত মোড়ে শব্দ মাত্রা ৯৫ ডেসিবেল, নিউমার্কেটের সামনে শব্দমাত্রা ৯৪ ডেসিবেল। ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় ক্যাম্পাসে শব্দমাত্রা ৭৯ ডেসিবেল। একজন সুস্থ মানুষের কাছে সহনশীল শব্দমাত্রার চেয়ে এটি দ্বিগুণেরও বেশী। প্রতিনিয়ত এ ধরনের উচ্চ শব্দের পরিবেশে বাস করলে উচ্চ রক্তচাপ, অনিয়মিত হৃদস্পন্দন, মাথা ধরা, বদহজম, পেপটিক আলসার, অনিদ্রাসহ বধির হয়ে যাওয়ার মতো ঘটনা ঘটতে পারে বলে আশঙ্কা করেছেন সংশ্লিষ্টরা।

বুয়েটের সাথে তুলনা

ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের পাশেই অবস্থিত বাংলাদেশ প্রকৌশল বিশ্ববিদ্যালয় (বুয়েট)। অথচ বুয়েটের সাথে ঢাবির পরিবেশের তফাৎ ব্যাপক। বুয়েট ক্যাম্পাসের প্রবেশমুখগুলোতে নিরাপত্তারক্ষীদের অবস্থানের কারণে বহিরাগত কেউ ক্যাম্পাসে প্রবেশ করতে পারে না। এমনকি বুয়েট ক্যাম্পাসে যানবাহন চলাচল থাকে সীমিত। ফলে, ঢাবি ক্যাম্পাসের মতো শব্দ দূষণ , যানজটসহ বহিরাগতদের উৎপাত দেখা যায় না সেখানে। যার কারণে শিক্ষার্থীরা একটি শান্ত ও মনোরম ক্যাম্পাসে পায়। সেটি পড়াশোনা করার জন্য আদর্শ একটি পরিবেশ।

এ বিষয়ে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের প্রক্টর সহযোগী অধ্যাপক সাইফুদ্দিন আহমদ মেসেঞ্জারকে বলেন, আমরা( বিশ্ববিদ্যালয় প্রশাসন) এসব বিষয়ে কনসার্ন। কিন্তু বর্তমানে বিশ্ববিদ্যালয়ে প্রতিদিনই আন্দোলন সংগ্রাম চলমান থাকায় এসব বিষয়ে ব্যবস্থা গ্রহণে দেরি হচ্ছে। তিনি বলেন, ঢাবি প্রক্টরিয়াল টিমের জন্য ভেস্টের ব্যবস্থা করেছি। একসপ্তাহের মধ্যেই তারা সেটি পেয়ে যাবে। নিরাপত্তারক্ষীদের জন্যও আমরা পোশাকের বিষয়ে ভাবছি। আমি ইতোমধ্যেই এস্টেট অফিসকে সার্ভিলেন্স বক্সগুলোকে চালু করার জন্য নির্দেশ দিয়েছি। খুব শীঘ্রই সার্ভিলেন্স বক্সগুলো সচল হবে।'

ক্যাম্পাসে সভা সমাবেশ নিয়ে তিনি বলেন, ক্যাম্পাসে যেকোন জায়গায় সভা সমাবেশের চর্চাটি পুরনো, এটি নিয়ন্ত্রণে একটু সময়ের প্রয়োজন। তবে আমরা চিন্তা করেছি, এখন থেকে ক্যাম্পাসে সভা সমাবেশ করতে অনুমতি নিতে হবে। এছাড়া, একাডেমিক এরিয়া বিশেষ করে কলা ভবন থেকে সামাজিক বিজ্ঞান অনুষদ এলাকায় কোন ধরনের সভা সমাবেশ, মাইকিং করা যাবে না। এছাড়া, টিএসসিতে রাত ১০টার পরে লাউড স্পিকারে কোন প্রোগ্রাম করা যাবে না। যানবাহন চলাচল নিয়ে তিনি বলেন, এই সপ্তাহের মধ্যেই ডিসি (ট্রাফিক) ও শাহবাগ থানার সাথে ক্যাম্পাসের ভেতরে যানচলাচল নিয়ন্ত্রণ নিয়ে বসার পরিকল্পনা রয়েছে। 

বুয়েটের সাথে তুলনা নিয়ে ঢাবি প্রক্টর

ঢাবি প্রক্টর বলেন, বুয়েটের ব্যাপার হলো তাদের ক্যাম্পাসের পুরো রাস্তাটিই তাদের মালিকানাধীন। কিন্তু ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের রাস্তাগুলো সিটি কর্পোরেশনের আন্ডারে। আমরা চিন্তা করেছি ক্যাম্পাসের কনফাইন্ড এরিয়াগুলো রেস্ট্রিকট করবো। ক্যাম্পাসের সিটি কর্পোরেশন বজ্য নিষ্কাশন, লাইটিং, রাস্তা উন্নয়নে কাজ করে। ক্যাম্পাসের রাস্তায় যানচলাচল এবং অন্যান্য বিষয়াদি নিয়ে আমরা সিটি কর্পোরেশন ও ডেসার সাথে খুব শীঘ্রই বসবো।

মেসেঞ্জার/তারেক

×
Nagad