ছবি : মেসেঞ্জার
চট্টগ্রাম প্রকৌশল ও প্রযুক্তি বিশ্ববিদ্যালয়ে (চুয়েট) চার বছর মেয়াদে স্নাতক পড়াশোনা শেষে সনদ তুলতে নিয়মিত বিড়ম্বনায় পড়তে হচ্ছে শিক্ষার্থীদের। এক সনদপত্র তুলতে একজন শিক্ষার্থীকে সংশ্লিষ্ট ২২ বিভাগ থেকে প্রায় ৬৮ জনের স্বাক্ষর নিতে হয়। এতে চরম ভোগান্তি ও হয়রানির শিকার হয়েছে বিশ্ববিদ্যালয়ের প্রায় সাড়ে চারশত শিক্ষার্থী।
বিশ্ববিদ্যালয় সূত্র জানায়, চুয়েটে চার বছর কোর্স শেষ করলে সংশ্লিষ্টদের বিএসসি প্রকৌশল পাসের সনদ পাওয়ার জন্য একটি ছাড়পত্র নিতে হয়। এই ছাড়পত্রে প্রতিটি বিভাগের ল্যাব টেকনিশিয়ান, বিভাগীয় প্রধান, ইন্সটিটিউট প্রধান, চিকিৎসা কেন্দ্রের একজন চিকিৎসক সহ আরো অনেকের সাক্ষর প্রয়োজন হয়। প্রকৌশল কলেজ চট্টগ্রাম নামে এ প্রতিষ্ঠানটি যাত্রা করার পর থেকেই এ রীতি এখনও চলমান।
জানা গেছে, চুয়েটের প্রতিটি বিভাগে গড়ে ছয় থেকে সাতটি ল্যাব আছে৷ ল্যাব টেকনিশিয়ানরা স্বাক্ষরের পর বিভাগীয় প্রধান স্বাক্ষর করে থাকেন। সকল টেকনিশিয়ানদের স্বাক্ষর সম্পন্ন না হলে বিভাগীয় প্রধান সাক্ষর করেন না। এভাবে একজন শিক্ষার্থীকে পোহাতে হয় অসহনীয় দুর্ভোগ। শিক্ষার্থীরা জানান, চুয়েটে চার বছর পার করা যতটা সহজ হয়, এই ছাড়পত্র নিতে তার চেয়ে বেশি দৌড়াতে হয়।
চারদিন একটি বিভাগে যাওয়ার পর সব স্বাক্ষর মেলে। একজন থাকেন তো আরেক জন থাকেন না। যদি কোনো আর্থিক কিংবা কোনো জিনিস পাওয়া থাকলে তা নিজ বিভাগে অবগত করলে, বিভাগের মাধ্যমে তা পরিশোধ করবে শিক্ষার্থীরা। বিভিন্ন বিভাগের একাধিক শিক্ষার্থী এমন অভিযোগ করেছেন।
ক্লিয়ারেন্স ফর্ম নিয়ে এমন সব বিভাগে যেতে হয়েছে যাদের সাথে কোর্সের সম্পর্ক ছিলো না, তবুও রীতি মেতাবেক সেখান থেকেও স্বাক্ষর নিতে নিতে হয় ৷ পাশাপাশি যাদের স্বাক্ষর দরকার তাদের পাওয়া যায় না সময়মতো। এতে একজনের সাইন আনতে কয়েকবার একই জায়গায় যেতে হয়। যদি অনলাইনে পুরো বিষয়টি সহজিকরণ করা হতো তাদের কম সময়ে শিক্ষার্থীরা সনদপত্র পেতো আর এমন হয়রানির শিকারও হতো না।
চুয়েটের মেকাট্রনিক্স এন্ড ইন্ডাস্ট্রিয়াল ইন্জিনিয়ারিং বিভাগের সদ্য বিদায়ী (১৮ ব্যাচ) শিক্ষার্থী আসিফ আলম এদিকে বুয়েট, কুয়েট এবং রুয়েটে অনলাইন ভিত্তিক অটোমেটিক পদ্ধতিতে এই সাক্ষর সম্পন্ন করা হয়। বিপরীতে ডিজিটাল নথির যুগে নামমাত্র প্রবেশ করলেও চুয়েটে এখনও পুরনো আমলের নীতিতে প্রত্যেক শিক্ষার্থীকে স্বাক্ষর আনতে ২২ টি বিভাগ দৌড়াতে হয়, পোহাতে হয় চরম ভোগান্তি।
যন্ত্রকৌশল বিভাগের বিদায়ী শিক্ষার্থী আশহার ইনজেমাম তাহবির বলেন, চুয়েট ভর্তির চেয়ে বের হওয়া কঠিন। আমাদের গ্রেজুয়েশন শেষে হাড়েহাড়ে তা টের পেয়েছি। একটি প্রথম সারির প্রকৌশল বিশ্ববিদ্যালয় এখনো পুরনো আমলের পদ্ধতির মাধ্যমে বিদায়ী শিক্ষার্থীদের ভোগান্তির সম্মুখীন করা কখনোই কাম্য নয়।
আমি একজন সাধারণ শিক্ষার্থী হিসেবে এই ক্লিয়ারেন্স পদ্ধতির কোনো প্রয়োজনীয়তাই দেখিনা। কোনো চারিত্রিক রেকর্ড বা টাকা পাওনা থাকলে তা ডিপার্টমেন্ট, হল বা ছাত্রকল্যাণ দপ্তর ভেরিফিকেশনের জন্য একটা পোর্টালে থাকলেই হয়। ৩য়-৪র্থ বর্ষের সিএসই এর শিক্ষার্থীরাই এরকম পোর্টাল বানাতে সক্ষম। প্রশাসনের সদইচ্ছা ও স্মার্ট থিংকিং টা প্রয়োজন। এখনো সবরকমের রেজিস্ট্রেশন, ক্লিয়ারেন্স হল বা ডাইনিং ফি সহ যাবতীয় কাজ পেপারলেস বা অনলাইন ভিত্তিক না করতে পারাটা প্রযুক্তি বিশ্ববিদ্যালয়ের বড় ব্যর্থতা হিসেবেই দেখি!
থার্ড পার্টিকে টাকার মাধ্যমেই পাওয়া যায় সকল স্বাক্ষর:
শিক্ষার্থীদের একাধিক সূত্র জানিয়েছে, বিভিন্ন বিভাগের বেশ কয়েকজন কর্মকর্তা ও কর্মচারী ছাড়পত্রে স্বাক্ষর সংগ্রহের কাজ করেন। তবে এক্ষেত্রে একজন শিক্ষার্থীকে গুনতে হয় ৫০০-৬০০ টাকা। তবে একজন শিক্ষার্থীর ছাড়পত্রের সকল স্বাক্ষর যদি কর্মকর্তা কিংবা কর্মচারীগণ টাকার বিনিময়ে সংগ্রহ করতে পারেন তাহলে ছাড়পত্রে স্বাক্ষরের ক্ষেত্রে সংশ্লিষ্টদের দায়বদ্ধতা কতটুকু এমন প্রশ্ন তুলেছেন শিক্ষার্থীরা।
আশহার তাহবির ও একাধিক শিক্ষার্থী জানিয়েছেন, সহজ ও হয়রানি থেকে বাঁচতে শিক্ষার্থীরা থার্ড পার্টির মাধ্যমে স্বাক্ষর গুলো নিয়ে থাকে। তিনি বলেন, থার্ডপার্টির মাধ্যমে করানো যদি যায় তাহলে এই ক্লিয়ারেন্সের দরকারটা আসলে কি? যতজায়গায় গিয়েছি স্বাক্ষরের জন্য সবখানেই কোনো চেকিং বা হিসাব নিকাশ নিতে দেখিনি শুধুই স্বাক্ষর দিয়েছেন সকলেই। ৫০০ টাকা হারে স্বাক্ষর সংগ্রহের কাজ করা একটি মার্কেট রয়েছে। যেখানে ছাড়পত্রে স্বাক্ষরের জন্য গড়ে অর্ধেক শিক্ষার্থীই টাকার বিনিময়ে কাজ করায় যাতে ভোগান্তি কম হয়।
বিশ্ববিদ্যালয় সংশ্লিষ্টরা যা বলেছেন:
চুয়েটের নগর ও অঞ্চল পরিকল্পনা বিভাগের সহকারী অধ্যাপক মো. শাহ জালাল মিশুক সমকালকে জানান, প্রতিটি শিক্ষার্থী কোনো না কোনোভাবে আরেকটি বিভাগের সাথে যুক্ত। তাই প্রতিটি বিভাগ থেকে শিক্ষার্থীদের ছাড়পত্র নিতে হয়। তবে এটি পুরোনো রীতি। তাই, বর্তমান ডিজিটাল যুগে অনলাইনে এ পদ্ধতি সহজিকরণ ও সামগ্রিক পদ্ধতিকে ত্বরান্বিত করবে এমন উদ্যোগ নেয়া দরকার। যাতে শিক্ষার্থীরা খুব দ্রুত সময়ে তাদের সনদ পেতে পারে।
এদিকে প্রকৌশল সনদপত্র সংগ্রহের পর একজন শিক্ষার্থী চারিত্রিক সনদ পেতে ছাত্রকল্যাণ দপ্তর বরাবর আবেদন করতে পারেন। দেশের সরকারি ও বেসরকারি প্রতিষ্ঠান গুলোতে চাকরি নিয়োগের মৌখিক পরীক্ষায় এ চারিত্রিক সনদপত্র গুলো যাচাই বাছাই করে চাকরিদাতা কোম্পানি গুলো। প্রকৌশলের মুল সনদের পর এটির জন্য শিক্ষার্থীদের আবারো অপেক্ষা করতে হয় ২ থেকে পাঁচদিন।
তাই এ পদ্ধতি সহজিকরণ ও অনলাইনে আবেদনের মাধ্যমে সংগ্রহ করা যায় কি না এ বিষয়ে ছাত্রকল্যাণ দপ্তরের উপ-পরিচালক ড. সাইফুল ইসলাম জানান, শিক্ষার্থীদের পক্ষ হতে এখনো দাবি আসেনি। প্রশাসন এখন শিক্ষার্থীদের আরোপিত দাবি গুলোকে গুরুত্ব দিচ্ছে। তবে এটিও গুরুত্বপূর্ণ। শুধু চারিত্রিক কেন, বিষয়টি এমন হওয়া উচিত যে সকল প্রকার সার্টিফিকেট এর জন্য একবার আবেদন ও ফী পরিশোধে সকল সার্টিফিকেট শিক্ষার্থীদের বুঝিয়ে দেওয়া উচিত। শিক্ষার্থীদের আবেদনের প্রেক্ষিতে আশা করছি বিশ্ববিদ্যালয় প্রশাসন এ বিষয়েও পদক্ষেপ গ্রহণ করবে।
চুয়েটের রেজিস্ট্রার (অতিরিক্ত দায়িত্ব) অধ্যাপক শেখ মোহাম্মদ হুমায়ুন কবির বলেন, বিষয়টি অবগত হয়েছি। আমরা শীঘ্রই কাজ শুরু করবো। তবে যেহেতু ‘১৮ ব্যাচ বিদায় হয়েছে, তারা এ পদ্ধতির হয়তো সুবিধা না পেলেও পরবর্তী ব্যাচগুলো অনলাইনে সনদপত্রের আবদেন করতে পারবে আশা করি।
বিশ্ববিদ্যালয়ের ভারপ্রাপ্ত উপাচার্য ও পুরকৌশল অনুষদের ডীন অধ্যাপক ড. সুদীপ কুমার পাল বলেন, বিষয়টি আমাদের নজরে এসেছে, আসলেই এতগুলো স্বাক্ষর নেওয়া শিক্ষার্থীদের জন্য ভোগান্তির। আমরা ইতোমধ্যে এ বিষয়ে আলাপ করেছি, কিভাবে শুধুমাত্র গুরুত্বপূর্ণ সিগনেচার নিয়ে এই সংখ্যা কমিয়ে আনা যায়। নতুন উপাচার্য নিয়োগ হলে, আমরা বিষয়টি উত্থাপন করবো। আশাকরি শীঘ্রই তা বাস্তবায়ন হয়ে যাবে।
মেসেঞ্জার/রাফিন/তারেক