ঢাকা,  বুধবার
১৬ অক্টোবর ২০২৪

The Daily Messenger

উপাচার্যের গোপন কক্ষে মিললো শিক্ষকদের প্রিন্ট করা পোস্টের স্কিনশট

বশেফমুবিপ্রবি প্রতিনিধি

প্রকাশিত: ১৯:১২, ১৫ অক্টোবর ২০২৪

উপাচার্যের গোপন কক্ষে মিললো শিক্ষকদের প্রিন্ট করা পোস্টের স্কিনশট

ছবি : মেসেঞ্জার

বঙ্গমাতা শেখ ফজিলাতুন্নেসা মুজিব বিজ্ঞান ও প্রযুক্তি বিশ্ববিদ্যালয়ে সদ্য পদত্যাগ করা উপাচার্য গোপন কক্ষে পাওয়া গেল বৈষম্য বিরোধী ছাত্র আন্দোলনে বিভিন্ন সময়ে শিক্ষার্থীদের পক্ষে থাকা শিক্ষকদের সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমে দেওয়া পোস্ট ও কমেন্টের প্রিন্ট করা স্ক্রিনশট।

বৈষম্য বিরোধী ছাত্র আন্দোলনে শিক্ষার্থীদের মতোই শিক্ষকেরাও পক্ষে বিপক্ষে অবস্থান নেই। তেমনি বশেফমুবিপ্রবির কিছু শিক্ষকও ছাত্রদের পক্ষে অবস্থান করে এবং সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমে কিছু পোস্ট করেন। নজরদারি বা ব্যবস্থা নেওয়ার উদ্দেশ্যে সংগৃহীত এসব শিক্ষকদের পোস্ট ও মন্তব্যের স্ক্রিনশট উপাচার্যের গোপন কক্ষে পাওয়া গেছে।

খামে ভর্তি দশ পাতার প্রিন্ট করা পোস্ট ও কমেন্টের বিশ্লেষণ করে দেখা যায়। কিছু শিক্ষক ও ট্রেজারের নাম হাইলাইটার পেন দিয়ে মার্ক করা রয়েছে। এতে কিছু শিক্ষার্থীর কমেন্টও দেখা যায়। সেখানে থাকা অধিকাংশ পোস্ট ও কমেন্টগুলোর স্ক্রিনশট নেওয়া হয়েছে পোস্ট করার একদিন পরে।

কিছু কিছু কমেন্ট ও পোস্ট দেখা যাচ্ছে ১৯ ঘন্টা ও ১৭ ঘন্টা আগে পোস্ট করা হয়েছে। স্ক্রিনশটগুলোতে দেখা যায়, বেশিরভাগ পোস্ট করা হয়েছে (৩ আগস্ট) বা তারও আগে। এদিকে সরকারের পতন হয় (৫ আগস্ট)। বিশ্লেষণে বোঝা যায় খাম ভর্তি প্রিন্ট করা স্ক্রিনশটগুলো (৪ আগষ্ট) নেওয়া হয়েছে এবং উপাচার্যের কক্ষে জমা দেওয়া হয়েছে।

কেননা, (৫ আগষ্ট) বিশ্ববিদ্যালয় বন্ধ থাকে এবং এই দিনে সরকার পতন হওয়ার পর থেকে উপাচার্যের কক্ষ তালাবদ্ধ থাকে আর্থিক প্রশাসনিক ও একাডেমিক দায়িত্বে নিয়োগ হওয়ার আগ পর্যন্ত। 

খামে থাকা পোস্টগুলোর স্ক্রিনশট সবচেয়ে বেশি রয়েছে বিশ্ববিদ্যালয়ের সহকারী অধ্যাপক মো. সাইফুল ইসলামের। তিনি বর্তমানে আর্থিক, প্রশাসনিক ও একাডেমিক দায়িত্বে রয়েছেন। তিনি একটি পোস্টে লিখেছেন, "আমার ছাত্র মরলো কেনো? জবাব চাই, বিচার চাই..."।

হাত উঁচু করে লাল কার্ড দেখানো একটি ছবি জুড়ে দেওয়ার আরেকটি পোস্টে তিনি লেখেন, 'ছাত্র-জনতা মুক্তি পাক, খুনীরা সব নিপাত যাক।' এছাড়াও অন্যান্য পোস্টগুলোতেও আন্দোলনের পক্ষে তার স্পষ্ট অবস্থান ফুটে ওঠে।

অন্যদিকে, সহকারী অধ্যাপক সৈয়দ আরিফুল হকের বেশ কয়েকটি পোস্টও প্রিন্ট করা স্ক্রিনশটের মধ্যে রয়েছে। তার পোস্টগুলোর মধ্যে একটি পোস্টে কোরআনের আয়াত এবং আরেকটিতে শহীদ আবু সাঈদের মৃত্যুর শোক প্রকাশ করে লেখেন 'আমরা শিক্ষকরা, যারা ছাত্র-ছাত্রীদের কাছে অভিভাবক হিসেবে পরিচিত সে শিক্ষকরাই  যখন নিজ ক্যম্পাসে শিক্ষার্থীদের নিরাপত্তা দিতে ব্যার্থ, সে আবার কিসের অভিভাবক। এ লজ্জা আমাদের, মেরুদণ্ডহীন শিক্ষকদের। আমি শিক্ষক হিসেবে বাকরুদ্ধ, লজ্জিত,ব্যাথিত।'

স্ক্রিনশট গুলোতে ট্রেজারার মোহাম্মদ আব্দুল মাননানের দুটি ও সমাজ কর্ম বিভাগের সহকারী অধ্যাপক আল মামুন সরকারের একটি মন্তব্য রয়েছে। সেখানে তাদের নামও মার্ক করা রয়েছে। এছাড়াও দশ পাতার প্রিন্ট করা ওসব স্ক্রিনশট গুলোতে বিশ্ববিদ্যালয়ের সাবেক শিক্ষার্থী শাকিল আহমেদ, বর্তমান শিক্ষার্থী তাবাসসুম রাফি ও মামুনুর রশিদ সহ আরো বেশ কয়েক জনের কমেন্ট দেখা যায়।

কিভাবে উপাচার্যের কক্ষে পাওয়া গেলো এই স্ক্রিনশটের খাম তা অনুসন্ধান করতে গিয়ে নাম প্রকাশে অনিচ্ছুক এক জন জানান, সরকার যেকোনো সময় উপাচার্য নিয়োগ দিতে পারে। তাই কক্ষটি তার ব্যবহারের উপযোগী করতে পরিষ্কার-পরিচ্ছন্ন করা হয়। একই সাথে সদ্য পদত্যাগ করা উপাচার্যের ব্যক্তিগত কিছু জিনিসপত্র ছিলো তা গোছাতে গিয়ে তার খাস কামরায় কয়েকটি খাম পাওয়া যায়।

এর বেশিরভাগই নষ্ট কাগজপত্র। সেখানে পাওয়া একটি খাম খুললে একজন শিক্ষকদের ফেসবুক পোস্ট ও কমেন্টের স্ক্রিনশট প্রিন্ট করে মার্কার দিয়ে মার্ক করা। তখন বিষয়টি  অফিসের ঊর্ধ্বতনদের জানানো হয়।

প্রশ্ন উঠেছে, এই স্ক্রিনশটগুলো কিভাবে উপাচার্যের গোপন কক্ষে জমা হলো? সরকারের পতন হওয়ার আগের দিন এই প্রিন্ট কপিগুলো প্রিন্ট করা হয়েছে এবং প্রশাসনকে রিপোর্ট করা হয়েছে বলে অনুমান করা হচ্ছে। উপাচার্যের কক্ষ (৫ আগস্ট) থেকে তালাবদ্ধ অবস্থায় ছিল, তাই স্ক্রিনশটগুলো সম্ভবত আন্দোলনের প্রেক্ষাপটে প্রশাসনের নজরদারি বা শিক্ষকদের বিরুদ্ধে কোনও পরিকল্পনার অংশ হিসেবে সংগ্রহ করা হয়েছে।

এ বিষয় আরো বিস্তারিত জানতে সদ্য পদত্যাগ করা উপাচার্য অধ্যাপক ড. মো. কামরুল আলম খানকে বার বার ফোন করা হলেও তিনি ধরেন নি।

বর্তমানে আর্থিক, প্রশাসনিক ও একাডেমিক দায়িত্ব প্রাপ্ত সহকারী অধ্যাপক মো. সাইফুল ইসলাম এ বিষয় বলেন, '(৮ অক্টোবর) উপাচার্যের কক্ষ পরিষ্কার করার সময় একটি খাম পাওয়া যায়। খামটিতে জুলাই-আগস্ট মাসে শিক্ষকদের আন্দোলন নিয়ে করা কয়েকটি পোস্টের স্ক্রিনশট ছিল, যেখানে শিক্ষকদের নাম হাইলাইট করা। এই ঘটনাটি অত্যন্ত দুঃখজনক এবং রাজনৈতিক প্রতিহিংসার প্রকাশ। ছাত্রদের পক্ষে অবস্থান নেওয়া স্বাভাবিক, কারণ এটি মত প্রকাশের অধিকার।

তিনি আরও উল্লেখ করেন, "চাকরিচুত করা বা অন্য কোন ক্ষতি করার চিন্তা ভাবনা থেকেই এগুলো কেউ করেছে। এই আন্দোলন সফল না হলে যেমন অনেক শিক্ষার্থীর শিক্ষাজীবন চালিয়ে নেওয়া সম্ভব হতো না এবং অনেক হয়রানির শিকার হতে হতো তেমন যেসব শিক্ষক, কর্মকর্তা-কর্মচারী অনলাইন বা অফলাইনে আন্দোলন করেছে তাদের ক্ষেত্রেও এমন কিছুই হত।

তারই প্রক্রিয়া হিসাবে এটা কররেছে মনে হয়। নিয়মিত উপাচার্য আসার পর বিষয়টি নিয়ে তদন্ত করে দায়ীদের বিরুদ্ধে যথাযথ ব্যবস্থা গ্রহণ করতে হবে।"

স্ক্রিনশটগুলোর মধ্যে আরেক শিক্ষক, সহকারী অধ্যাপক সৈয়দ আরিফুল হকের পোস্টও ছিল। বর্তমানে পিএইচডি করতে ওমানে অবস্থানরত থকায় মুঠোফোনে তিনি জানান, "শিক্ষার্থীদের পক্ষে কথা বললে সেটি কোট করে উপাচার্যের কক্ষে দেওয়া হলে, তা অত্যন্ত লজ্জাজনক।" তিনি এ ঘটনার সুষ্ঠু তদন্ত করে বিচার দাবি করেন।

স্ক্রিনশটে থাকা মন্তব্য থাকা সমাজকর্ম বিভাগের সহকারী অধ্যাপক আল মামুন সরকার। তিনি বলেন, "যারা এটি করেছে, তারা একটি গর্হিত কাজ করেছে, যা শাস্তিযোগ্য অপরাধ। স্বৈরাচারী সরকারকে প্রতিষ্ঠা করার জন্যই এমন কাজ করা হয়েছে। 

ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষকের ক্ষেত্রে এমন কাজের জন্য তাকে সাময়িক বরখাস্ত করা হয়েছে এবং তদন্ত কমিটি গঠন করা হয়েছে। আমরাও চাই এখানে তদন্ত কমিটি গঠন করে দোষীদের শাস্তির আওতায় আনা হোক।"

এই ঘটনা বিশ্ববিদ্যালয়ে প্রশাসনিক নজরদারি এবং শিক্ষকদের স্বাধীন মতপ্রকাশের অধিকার নিয়ে গুরুতর প্রশ্ন উত্থাপন করছে। শিক্ষকদের আন্দোলনে অংশ নেওয়া এবং শিক্ষার্থীদের পক্ষে কথা বলার স্বাধীনতা যদি প্রশাসনের নজরদারির অংশ হয়ে থাকে, তবে তা ভবিষ্যতে শিক্ষকদের মতপ্রকাশের অধিকারকে সংকুচিত করতে পারে।

মেসেঞ্জার/শাহারিয়া/তারেক