ঢাকা,  রোববার
১২ জানুয়ারি ২০২৫

The Daily Messenger

জামালখানের বই উৎসব পরিনত হয়েছে মিলন মেলায়

সাখাওয়াত আলম, চট্টগ্রাম

প্রকাশিত: ২০:২৬, ১১ জানুয়ারি ২০২৫

জামালখানের বই উৎসব পরিনত হয়েছে মিলন মেলায়

ছবি : মেসেঞ্জার

জ্ঞানের পরিধি বাড়াতে বইয়ের বিকল্প নেই। আবার একটি বইয়ের শেষ বলতেও কিছু নেই। তাই  জ্ঞানের অন্বেষণে বইপোকারা প্রচুর অর্থ ব্যয় করে বই কেনেন এবং পড়েন। পড়া শেষ হলে সেই বই স্থান পায় বুকসেল্ফে। নয়তো ভাঙ্গারি দোকানে। যেখান থেকে এসব বইয়ের শেষ পরিনতি হয় ঝালমুরির দোকনে নয়তো বাংলা টিস্যু নামে ব্যবহৃত হয় নিম্নমানের খাবার দোকানগুলোতে।

এদিকে লাইব্রেরিগুলোতে বই বিনিময়ের সুযোগ না থাকায় নতুন বই কিনতে গেলে ভাবতে হয় পকেটের অবস্থা। একাডেমিক বই কিংবা গাইড কেনার ক্ষেত্রে অর্থের বিকল্প নেই। এর কারণে অনেক শিক্ষার্থীর ঘুরতে হয় মানুষের দ্বারে দ্বারে। পুরনো বই খুঁজতে গেলে পড়তে হয় বিড়ম্বনায়। শিক্ষার্থী ও বইপোকাদের এমনসব সমস্যা থেকে পরিত্রাণের উপায় নেই। তাদের মতো মানুষের কথা মাথায় রেখে চট্টগ্রাম জেলা পরিষদ ও সংস্কৃতি বিষয়ক মন্ত্রণালয়ের পৃষ্ঠপোষকতায় স্টোরিটেলিং প্লাটফর্ম ফেইল্ড ক্যামেরা স্টোরিজের উদ্যোগে দিনব্যাপি আয়োজিত হয়েছে বই বিনিময় উৎসব।

শুক্রবার (১০ জানুয়ারি) সকাল থেকে সন্ধ্যা পর্যন্ত নগরের জামালখান মোড়ে ষষ্ঠবারের মতো "বই নয়, জ্ঞানের বিনিময়" স্লোগানে বই বিনিময় উৎসব আয়োজন করা হয়।

সরেজমিনে দেখা গেছে, জামালখান মোড়ে খাস্তগীর স্কুলের সামনে রাস্তার দুই পাশের ফুটপাতে ১১টি স্টল বসানো হয়েছে। এবারের আয়োজনে জুলাই বিপ্লবীদের স্মৃতি অমলিন করতে স্টলের নাম দেওয়া হয়েছে শহীদদের নামে। করা হয়েছে নজরুল স্মৃতিতে নজরুল কর্ণার। রেজিস্ট্রেশন বুথ দু'টোর নাম শহীদ ওয়াসিম আকরাম রেজিষ্ট্রেশন বুথ ও শহীদ ফয়সাল আহমেদ শান্ত রেজিষ্ট্রেশন বুথ নামে রাখা হয়েছে। শিশুতোষ ও ম্যাগাজিন স্টলের নাম রাখা হয় শহীদ রিয়া গোপ এর নামে। এছাড়া রাজনীতি, আত্মজীবনী ও ইতিহাস স্টলের নাম রাখা হয়েছে শহীদ শহীদুল ইসলাম, একাডেমিক শহীদ রিপন, সমগ্র শহীদ জামাল, কথাসাহিত্য (ক) শহীদ হৃদয় তরুয়া, ক্যারিয়ার ও বিজ্ঞান শহীদ তানভীর সিদ্দিকী, হুমায়ুন আহমেদ শহীদ আহসান হাবীব, কবিতা শহীদ ইউছুফ, কথাসাহিত্য (খ) শহীদ ইসমামুল হক, প্রবন্ধ ও অন্যান্য শহীদ ওমর বিন নুরুল আবসার, ধর্মতত্ত্ব ও দর্শন শহীদ ফরহাদ হোসেন এর নামে।

দিনের প্রতিটি সময় দর্শনার্থীদের উপচে পড়া ভীড় দেখা গেছে বই বিনিময় উৎসবে। শিশু, কিশোর থেকে শুরু করে চাকরী প্রত্যাশীরাও ভীড় জমিয়েছিল স্টল গুলোতে। কারো প্রয়োজন একাডেমিক বই, কারোর সাহিত্য, কারোর ক্যারিয়ার গঠনের সহায়ক বই। তবে একাডেমিক স্টলে তিল ধারণ করার মত ক্ষমতা ছিল না। সকাল থেকেই এই স্টলে উপচে পড়া ভীড় লক্ষ্য করা গেছে।

সরকারি মুসলিম উচ্চ বিদ্যালয়ের নবম শ্রেণীর শিক্ষার্থী আইমান এসেছেন একাডেমিক সাজেশন বইয়ের খোঁজে। তিনি বলেন, আমার প্রয়োজনীয় বেশিরভাগ বই পেয়ে গেছি। গতবারের বই বিনিময় উৎসব থেকে বেশ কিছু একাডেমিক বই নিয়ে গিয়েছিলাম। পুরনো কারিকুলাম ফিরে আসবে তাই ওই কারিকুলামের বই নিয়েছি।

অবসর সময়ে পড়ার জন্য গল্পের বইয়ের সন্ধানে এসেছেন লাবিবা চৌধুরী। তিনি সাতকানিয়া সরকারি কলেজ থেকে স্নাতক পাস করেছেন। একাডেমিক বেশ কিছু বই রেখেছেন। এসময় তিনি বলেন, একাডেমিক বই নিতে পারিনি। তবে পুরনো একাডেমিক বেশ কিছু বই দিয়েছি। অল্পকিছু গল্পের বই নিলাম। তবে এত সুন্দর উদ্দ্যোগের জন্য আয়োজকেরা প্রশংসার দাবিদার। সকল শিক্ষার্থীদের কথা বিবেচনায় বছরে দুইবার এমন উদ্দ্যোগ নেওয়া হলে শিক্ষার্থীরা উপকৃত হবে।

উম্মে সাইমা এসেছেন নগরের বাকলিয়া এলাকা থেকে। তিনি সাদার্ন বিশ্ববিদ্যালয় থেকে সিভিল ইঞ্জিয়ারিংয়ে স্নাতক পাস করেছেন। বই বিনিময়ের সময় তিনি বলেন, থ্রিলার সিরিজ নিয়েছি। দেশের বাইরে যাওয়ার প্রস্তুতি চলছে। প্রতিবারের বই বিনিময় উৎসবে এসেছি। আগামিবারে আসতে পারবো কিনা জানি না। তবে এই আয়োজনের আয়োজকদের জন্য সব সময় দোয়া ও শুভেচ্ছা রইল।

৮৮টি বই দিয়ে ২০২১ সালে যাত্রা করা এই বই বিনিময় উৎসবের সমন্বয়ক এবং আয়োজক সংগঠন ফেইল্ড ক্যামেরা স্টোরিজের পরিচালক সাইদ খান সাগর দ্যা ডেইলি মেসেঞ্জারকে বলেন, বর্তমানে আমাদের ছয় হাজার বই রয়েছে। এবারের আয়োজনে ২৩ হাজার বই বিনিময় হয়েছে। সার্বিক তত্ত্বাবধানে ছিলেন ১০৫ জন স্বেচ্ছাসেবক। আমরা আজ থেকে চার বছর আগে পাঠক তৈরির মহান উদ্দেশ্যে যে বই বিনিময় উৎসব শুরু করেছিলাম সেটা আমাদের জাতীয় সাংস্কৃতিক জীবনে বৈচিত্র‍্য ঘটিয়েছে। বইমেলার মতো বই বিনিময় উৎসবের জন্যও পাঠক এখন অপেক্ষা করে থাকেন। বিশেষ করে যারা বই কিনতে চান কিন্তু পারেন না অর্থাভাবে তাদের জন্য বই বিনিময় উৎসব বই পড়া অব্যাহত রাখতে সাহায্য করছে। বই বিনিময় উৎসব এই প্রজন্মের প্রতিক। আর এই প্রজন্মের গর্বের নাম জুলাই অভ্যুত্থান। তাই আমরা এবার ৬ষ্ঠ বই বিনিময় উৎসবকে জুলাইয়ের রঙ্গে সাজিয়েছি। জুলাইয়ের স্বাধিকারবোধ যেন সর্বদা জাগ্রত থাকে।

জাতীয় সংগীত পরিবেশনের মাধ্যমে শুরু হয় ৬ষ্ঠ বই বিনিময় উৎসব। উৎসবের উদ্বোধন করেন গণপ্রজাতন্ত্রী বাংলাদেশ সরকারের শরণার্থী ত্রান ও প্রত্যাবাসন কমিশনার মিজানুর রহমান। প্রধান অতিথি ছিলেন একুশে পদকপ্রাপ্ত সাংবাদিক এম এ মালেক। 

বিশেষ অতিথি হিসেবে উপস্থিত ছিলেন উপসচিব ও চট্টগ্রাম জেলা পরিষদের প্রধান নির্বাহী কর্মকর্তা শাব্বির ইকবাল, নজরুল ইন্সটিটিউট এর পরিচালক, প্রখ্যাত লেখক লতিফুল ইসলাম শিবলী। তিনি বই বিনিময় উৎসবের নজরুল কর্ণার উদ্বোধন করেন। উদ্বোধন শেষে তিনি জুলাইয়ে নজরুলের যে সাম্য-দ্রোহ চেতনা সে চেতনায় উদ্বুদ্ধ হয়ে দেশ গড়ার আহবান জানান। জুলাই এবং নজরুলের কবিতাকে মিলে সাজানো হয় নজরুল কর্ণারের। এই নজরুল কর্ণার উদ্বোধন করেন লতিফুল ইসলাম শিবলী।

বই বিনিময় করার নিয়ম

বই বিনিময় উৎসবে প্রথমত রেজিস্ট্রেশন বুথে বই জমা দিতে হবে। এরপর জমা দেওয়া বইয়ের ক্যাটাগরি অনুযায়ী স্টল নম্বর লিখে দেয় দায়িত্বরত ভোলান্টিয়ার। সে অনুযায়ী স্টলে গিয়ে পছন্দমত বই সংগ্রহ করতে পারে যে কেউ। এতে একাডেমিক বইয়ের ক্যাটাগরি ছাড়া অন্য ক্যাটাগরির যে কোন ৫টি বই বিনিময় করার সুযোগ দেওয়া হয়েছে। একাডেমিক বই বিনিময়ের ক্ষেত্রে রাখা হয়নি কোন নিয়ম। বইয়ের বিনিময়ে বই যত ইচ্ছা নেওয়া যাবে।

জানা যায়, বই বিনিময় উৎসবের প্রথম আয়োননে নয় হাজার ৪০০ বই বিনিময় হয়। এরই ধারাবাহিকতায় দ্বিতীয় বারে ১৯ হাজার ৩২০টি, তৃতীয় বারে ২৯ হাজার ৩২০টি, চতুর্থ বারে বৃষ্টির কারণে কিছুটা কম হলেও সাড়ে ১৩ হাজার বই বিনিময় হয়। সর্বশেষ পঞ্চম বারের আয়োজনে বই বিনিময় হয় সাড়ে ২২ হাজার।

মেসেঞ্জার/সাখাওয়াত/এসকে/ইএইচএম