ঢাকা,  শনিবার
২২ ফেব্রুয়ারি ২০২৫

The Daily Messenger

প্রধান দুই পদে ভারপ্রাপ্ত, চিকিৎসা কার্যক্রমে হযবরল অবস্থা

বিল্লাল হোসেন, যশোর প্রতিনিধি

প্রকাশিত: ১৯:১৬, ৯ ফেব্রুয়ারি ২০২৫

প্রধান দুই পদে ভারপ্রাপ্ত, চিকিৎসা কার্যক্রমে হযবরল অবস্থা

ছবি : মেসেঞ্জার

যশোর ২৫০ শয্যা জেনারেল হাসপাতালে তত্ত্বাবধায়ক ও আবাসিক মেডিকেল অফিসারের (আরএমও) পদ ভারপ্রাপ্ত কর্মকর্তাকে দিয়ে পরিচালনা করা হচ্ছে। প্রধান দুটি পদে ভারপ্রাপ্ত দিয়ে চলার কারণে চিকিৎসা ও প্রশাসনিক কার্যক্রমে হযবরল অবস্থা বিরাজ করছে। হাসপাতালের চেইন অব কমান্ড নেই বললেই চলে। নানা অনিয়মের কারণে স্মরণকালের ভয়াবহ বাজে অবস্থা বিরাজ করছে সরকারি এই হাসপাতালে।

হাসপাতালের প্রশাসনিক সূত্রে জানা গেছে, হাসপাতালের প্রধান দুটি পদ স্থায়ী না করার ব্যাপারে মন্ত্রণালয়ের কোনো সাড়া নেই। বছরের পর বছর পদ দুটিতে ওএসডি কোনো কর্মকর্তাকে সংযুক্তি করে কার্যক্রম চালানো হচ্ছে। ২০২৪ সালের ১২ ডিসেম্বর তত্ত্বাবধায়কের পদটি খালি হলেও ৫ বছরেরও বেশি সময় ধরে সহকারী পরিচালক পদে কেউ নেই।  ২০০৯ সালে হাসান আল মামুনকে তত্ত্বাবধায়ক (উন্নয়ন) পদ থেকে বরখাস্ত করা হয়। এরপর থেকে আর কেউ এই পদে আসেননি। পরে স্বাস্থ্য মন্ত্রনালয় উন্নয়নের তত্ত্বাবধায়ক পদটি বিলুপ্ত করে। এছাড়া সহকারি পরিচালক পদ সৃষ্টি করা হয়নি। বর্তমানে তত্ত্বাবধায়ক ও সহকারি পরিচালক পদটি পরিচালনা করা হয় অন্য কাউকে সংযুক্তি করে। প্রশাসনিকভাবে গুরুত্বপূর্ণ দুটি পদ সৃষ্টির জন্য স্বাস্থ্য মন্ত্রণালয়ে একাধিকবার চিঠি পাঠানো হয়েছে। কিন্তু সাড়া মেলেনি।

সূত্রটি আরও জানায়, সংযুক্তিতে থাকা তত্ত্বাবধায়ক ডা. হারুন অর রশিদ গত ১২ ডিসেম্বর অন্যত্র বদলি হন। ভারপ্রাপ্ত তত্ত্বাবধায়কের দায়িত্ব গ্রহণ করেন চক্ষু বিভাগের সিনিয়র কনসালটেন্ট ডা. হিমাদ্রী শেখর সরকার। এদিকে, প্রায় ৬ মাস ধরে ভারপ্রাপ্ত আবাসিক মেডিকে অফিসারের (আরএমও) দায়িত্ব পালন করছেন অর্থোপেডিক বিভাগের চিকিৎসক ডা. আনম বজলুর রশিদ টুলু। তত্ত্বাবধায়কের অর্ডারে তিনি আরএমও পদে রয়েছেন।

খোঁজ নিয়ে জানা গেছে, চেইন অব কমান্ড দুর্বল থাকায় বর্তমানে সরকারি এই হাসপাতালে চিকিৎসা সেবায় রয়েছে নানা অনিয়ম। কর্মরত বিশেষজ্ঞরা শুধু খাতা কলমে রয়েছেন। বাস্তবে তারা ঠিকমতো দায়িত্ব পালন করেন না। মাঝে মাঝে ওয়ার্ড রাউন্ডে গেলেও তড়িঘড়ির কারণে রোগীরা ঠিকমতো কথা বলতে পারেন না। এ ছাড়া যশোর মেডিকেল কলেজের ডাক্তাররা হাসপাতালে ঠিকমতো চেম্বারে বসেন না। তারা ইচ্ছামতো আসেন আর যান। মেডিকেল কলেজের অধীনে থাকায় হাসপাতাল কর্তৃপক্ষ তাদের বিরুদ্ধে জোরালোভাবে ব্যবস্থা নিতে পারেন না। তাদের অনিয়মের কারণে রোগীরা সরকারি হাসপাতালে সঠিক চিকিৎসাসেবা থেকে বঞ্চিত হচ্ছেন। জেনারেল হাসপাতালের চিকিৎসকদের নিয়েও রোগীদের অভিযোগের শেষ নেই। হাসপাতালের চিকিৎসক, সেবিকা, কর্মকর্তা ও কর্মচারীরা চলছেন নিজেদের ইচ্ছামতো। ব্যক্তিগত বাণিজ্যে ব্যস্ত রয়েছেন তারা। বিনা চিকিৎসায় রোগীর মৃত্যু, প্রয়োজনের সময় বিশেষজ্ঞ চিকৎসক না পাওয়া, নিয়মবর্হিভূতভাবে ইন্টার্ণ চিকিৎসক রোগীর অস্ত্রোপচার ও রেফার্ড করছেন, হাসপাতাল থেকে রোগী ভাগানো, কমিশন বাণিজ্য, দাপট চিকিৎসাসেবায় অবহেলা, জখমী সনদ বাণিজ্য, বখশিস বাণিজ্য, বহিরাগতদের দাপট, বিনামূল্যের ওষুধ সঠিকভাবে বিতরণ না করা, রোগী ও স্বজনদের সাথে দুর্ব্যবহার করা এখন নিত্যনৈমত্তিক ব্যাপার হয়ে দাঁড়িয়েছে। এছাড়া একজনের দায়িত্ব আরেকজন পালন করা, চাকরিভাড়া দেয়া, অস্বাস্থ্যকর পরিবেশ, দালালের উৎপাতসহ নানাভাবে নাজেহাল হচ্ছেন রোগী ও স্বজনেরা। এতে করে এখানকার চিকিৎসার প্রতি আস্থা হারাচ্ছেন মানুষ। অথচ যশোরসহ আশপাশের  কয়েকটি জেলা ও উপজেলার রোগীদের আশা ভরসার স্থল হলো এই হাসপাতালটি।

অভিযোগ উঠেছে, বিশেষজ্ঞরা ঠিকমতো দায়িত্ব পালন করেন না। তারা ক্লিনিক-ডায়াগনস্টিক সেন্টারে ব্যক্তিগত বাণিজ্য নিয়ে ব্যস্ত। বিশেষজ্ঞরা শুধু খাতা কলমে রয়েছে। ইন্টানরা এখন মূল ভূমিকায় রয়েছেন। ইন্টার্নরা ছাড়াও ওয়ার্ডবয় আয়া ও ঝাঁড়ুদার রোগীর চিকিৎসাসেবা দিচ্ছেন। ভর্তি ওয়ার্ডে কাটা ছেড়া রোগী আসলেই এগিয়ে আসেন ওয়ার্ডবয়, আয়া নতুবা ঝাড়ুদার। রোগীর স্বজনদের হাতে চিকিৎসা সামগ্রী কেনার শর্ট স্লিপ ধরিয়ে দেন। এরপর ইনজেকশন সিরিঞ্জ, স্যালাইন, সুই সুতো নিয়ে তারাই করেন চিকিৎসা। আবার ক্যানোলা, ইউরিন ব্যাগ, খাদ্য গ্রহণের পাইপ লাগানো কাজও তারা করেন। এতে তারা লাভবান হন। কেননা প্রতি রোগীর স্বজনদের জিম্মি করে হাসপাতালের কর্মীরা অর্থবাণিজ্য করেন। সার্জারী, মেডিসিন, গাইনী ওয়ার্ডে অধিকাংশ সময় চিকিৎসকের ভূমিকায় ওয়ার্ডবয় ও ঝাঁড়ুদারকে দেখা যায়। অর্থ ছাড়া কোন কাজই করছেন না তারা। কাজ করেই তারা বলেন আমরা বিনা বেতনে কাজ করি। এই বলেই টাকা দাবি করেন। দাবির চেয়ে টাকার পরিমাণ কম হলেই তার বেকে বসেন। জরুরি বিভাগ থেকে রোগী নিয়ে ওয়ার্ডে যাওয়ার পর ট্রলি নেয়া কর্মচারীরে দিতে ২০০ টাকা।

হাসপাতালের একটি সূত্র জানিয়েছে, বর্তমানে হাসপাতালের চেইন অব কমান্ড দুর্বল হয়ে পড়ায় চিকিৎসক সেবিকা ও কর্মকর্তা কর্মচারীরা যা ইচ্ছা তাই করছেন। সঠিকভাবে তদারকি ব্যবস্থা ও জবাবদিহিতা না থাকায় হাসপাতালে অনিয়ম বেড়েই চলেছে। বিশেষজ্ঞ চিকিৎসকরা রোগীর প্রতি চরম উদাসিন। হাসপাতালে সঠিকভাবে দায়িত্ব পালন না করে ক্লিনিক-ডায়াগনস্টিকে ব্যস্ত থাকেন তারা। চিকিৎসা অবহেলায় রোগীর মৃত্যুতে হাসপাতালে হট্টগোল হচ্ছে।

গত ২৩ জানুয়ারি দুপুর ৩ টা ১৫ মিনিটে পেটে ব্যথা নিয়ে হাসপাতালের পুরুষ মেডিসিন ওয়ার্ডে ভর্তি হন যশোর শহরের বারান্দীপাড়া বউ বাজার এলাকার মৃত বাবু মিয়ার ছেলে নজরুল ইসলাম। চিকিৎসাধীন অবস্থায় ২৪ জানুয়ারি রাত পৌনে ১০ টার দিকে তিনি মারা যান। নজরুল ইসলামের মৃত্যুর পর তার ছেলে ইমরান হোসেনসহ অন্য স্বজনরা ক্ষুব্ধ হয়ে ওয়ার্ডে দায়িত্বরত ইন্টার্ন চিকিৎসক  ইফতে খায়রুল আলম শুভর ওপর চড়াও হন। এসময় তাকে কিল-ঘুষি মেরে আহত করা হয়। পরে  অন্য রোগীর স্বজনরা ওই চিকিৎসককে উদ্ধার করে চিকিৎসার জন্য হাসপাতালের জরুরি বিভাগে নিয়ে যান। মৃত রোগীর স্বজনদের দাবি ছিলো, চিকিৎসা অবহেলা ও ইন্টার্নের ভুল চিকিৎসায় মারা যান নজরুল ইসলাম।

অভিযোগ উঠেছে, হাসপাতালে প্রকাশ্যে নানা অনিয়ম হলেও কর্তৃপক্ষ কোন ব্যবস্থা গ্রহণ করেননা। হাসপাতালের ফার্মেসী থেকে ভুয়া চিকিৎসকের প্রেসক্রিপশন ও টোকেনে একটি চক্র সরকারি মূল্যবান ওষুধ তুলছিলো। হাসপাতালের কতিপয় সেবিকা, কর্মচারি, মেডিকেল অ্যাসিস্টেন্ট ও প্রশিক্ষণার্থী সেবিকারা চক্রের সাথে জড়িত। এ নিয়ে গত ২৭ জানুয়ারি গণমাধ্যমে সচিত্র সংবাদ প্রকাশ হয়। এতে টনক নড়ে হাসপাতাল কর্তৃপক্ষের। এ ঘটনায় একটি তদন্ত কমিটি গঠন হয়। কিন্তু তদন্তের নামে আইওয়াশ করা হয়েছে। নামমাত্র তদন্তে সত্য ঘটনাকে মিথ্যা প্রমাণিত করা হয়েছে।

প্রধান পদ ভারপ্রাপ্ত দিয়ে চলার বিষয়ে কথা হলে হাসপাতালের হিসাব রক্ষক ইসরাফিল হোসেন মামুন জানান, ডা. হিমাদ্রী শেখর সরকার নামমাত্র তত্ত্বাবধায়কের পদে রয়েছেন। তিনি আয়ন-ব্যয়ন ক্ষমতা না গ্রহণ করেননি। ফলে হাসপাতালের ইন্টার্ন, কর্মকর্তা ও কর্মচারীরা কেউ জানুয়ারি মাসের বেতন পাননি। এছাড়া পথ্য (খাদ্য) ও ধোলাই ঠিকাদার বিল, লিলেন, মনোহরি সামগ্রী ক্রয় ও উন্নয়ন কার্যক্রম বন্ধ রয়েছে।

হাসপাতালের ভারপ্রাপ্ত তত্ত্বাবধায়ক ডা. হিমাদ্রী শেখর সরকার জানান, তিনি তত্ত্বাবধায়কের দায়িত্ব গ্রহণের পর থেকে রোগীদের চিকিৎসাসেবা নিশ্চিত করতে আপ্রাণ চেষ্টা চালিয়ে যাচ্ছেন। এরপরও কিছু সমস্যা রয়েছে। মন্ত্রণালয়ের দায়িত্বপ্রাপ্ত তত্ত্বাবধায়ক যোগদান করার পর অনিয়মগুলো ঠিক হয়ে যাবে।

উল্লেখ্য, অতিত কজের মূল্যায়ন থেকে একাধিকবার দেশসেরার খ্যাতি অর্জন করেছিলো যশোর ২৫০ শয্যা জেনারেল হাসপাতাল। স্বীকৃতি স্বরুপ মিলেছে স্বাস্থ্যমন্ত্রী জাতীয় পুরস্কার- ২০১৯। এর আগে ২০১৭ সাল এবং ২০১৮ সালেও দেশসেরা হাসপাতালের পুরস্কার অর্জন করে হাসপাতালটি। নানা সুনাম ও দুর্নামের মধ্য দিয়েই দেশসেরার পুরস্কারগুলো পায় হাসপাতাল। কিন্তু বর্তমানে হাসপাতালের চিকিৎসাসেবা ও প্রশাসনিক কার্যক্রম নিয়ে নানা অনিয়ম বিরাজ করছে।

মেসেঞ্জার/তুষার

আরো পড়ুন