ঢাকা,  রোববার
২২ ডিসেম্বর ২০২৪

The Daily Messenger

টেকব্যাক টু সংঘাতময় রাজনীতি: দিতে হবে মারাত্নক খেসারত

প্রকাশিত: ১৫:৫৫, ৪ অক্টোবর ২০২৩

আপডেট: ১৭:১৫, ৪ অক্টোবর ২০২৩

টেকব্যাক টু সংঘাতময় রাজনীতি: দিতে হবে মারাত্নক খেসারত

রাষ্ট্রীয় স্থাপনায় হামলার হুমকি কোনো রাজনৈতিক দলের এজেন্ডা হতে পারে না। রাজনৈতিক দলগুলোকে জনগণের সুবিধা অসুবিধা বিবেচনায় রেখে কর্মসূচি গ্রহণ করা উচিত। ছাড়া রাজনৈতিক দলের ভিত মজবুত হয়ে থাকে দলের কর্মী সমর্থকদের মতামতের ভিত্তিতে। সে কারণেই এমন কোনো কর্মসূচি গ্রহণ করা উচিত হবে না যার পরিপ্রেক্ষিতে সর্বস্তরের জনগণকে অসুবিধার সন্মুখীন হতে হয়। কাজেই আসন্ন নির্বাচনকে সামনে রেখে প্রত্যেকটি রাজনৈতিক দলের উচিত, জনগণের সুবিধা অসুবিধার বিষয়সমূহ বিবেচনায় নিয়ে পরিকল্পিত উপায়ে রাজনৈতিক কর্মসূচি প্রণয়ন করা। এখন যদি কোনো দল সুপ্রিম কোর্ট প্রাঙ্গন কিংবা বাংলাদেশের প্রধানমন্ত্রীর অফিস ঘেরাওয়ের হুমকি প্রদান করে তাহলে ধরনের কর্মসূচি প্রণয়নের পূর্বাভাসে যে ধরনের অবস্থার সূচনা ঘটতে পারে তার সামান্য আলোচনা উপস্থাপন করার চেষ্টা থাকবে নিবন্ধে।

বিএনপি জামায়াতের ১০০ দিনের টানা হরতাল অবরোধে পেট্রোল বোমায় অগ্নিদগ্ধ হয়ে ১৫৩ জন মারা যায়। ঢাকা মেডিকেল কলেজের তথ্যানুযায়ী পেট্রোল বোমায় অগ্নিদগ্ধ হয়ে ১৮১ জন ভর্তি হয় এবং চিকিৎসারত অবস্থায় মারা যায় ২২ জন। ২০১৪ সালের ফেব্রুয়ারি মাসে সংসদে এক আলোচনায় উঠে আসে, বিএনপি জামায়াত জোটের অবরোধ হরতালে প্রথম ৫২ দিনের সহিংসতায় লাখ ২০ হাজার কোটি টাকার অধিক আর্থিক ক্ষতি সাধিত হয়েছে। সময়ে কমপক্ষে ১০১ জনের মৃত্যু সহস্রাধিক আহত হয়েছেন। হাজার ১৭৩ টি যানবাহনে অগ্নিসংযোগের ঘটনা ঘটেছে। ঢাকা চেম্বার অব কমার্স অ্যান্ড ইন্ডাস্ট্রিজ এক পরিসংখ্যানে বলছে, এক দিনের হরতালে ক্ষতি হয় হাজার ৬০০ কোটি টাকা। বিজিএমই-এর মতে একদিনের হরতালে পোশাক খাতে ক্ষতির পরিমাণ ১৪০ কোটি টাকা। পরিবহন মালিকদের মতে গাড়ি চলাচল বন্ধ থাকায় দিনে কমপক্ষে ২৫০ কোটি টাকার ক্ষতি হয়। এখন যদি টেকব্যাক বাংলাদেশের নামে পুনরায় বাংলাদেশকে পিছনে টেনে সংঘাতময় রাজনীতির পুনরাবৃত্তি করা হয় তাহলে সেটি হবে বাংলাদেশের জন্য অত্যন্ত ক্ষতিকর।

রাষ্ট্রে যদি কোনো পক্ষ সংঘাতময় পরিস্থিতি সৃষ্টির প্রেক্ষাপট তৈরি করে তাহলে পুরো রাষ্ট্রের নিরাপত্তা ব্যবস্থা (Security Issues) নিয়ে চিন্তার উদ্রেক ঘটবে। ক্ষেত্রে দায়িত্বশীলদের ব্যাপারে নতুন করে চিন্তা ভাবনা সমেত পলিসি প্রণয়নে সচেষ্ট ভূমিকা পালন করতে হবে। কোনো একটি পক্ষ যদি এতদসংক্রান্তে হুমকি প্রদান করে রাষ্ট্রীয় স্থাপনা তথা রাষ্ট্রের গুরুত্বপূর্ণ জায়গায় আঘাত করার পায়তারা করবে তখন সংগতভাবেই রাজনৈতিক অস্থিতিশীলতা (Political Instability) দেখা দিবে। আদতে যারা সংঘাতের সূচনা করতে চায়, এর আগে তাদের সংঘাত করার পূর্ব ইতিহাস রয়েছে; রাজনৈতিক বিরোধিতা হলেও তাদের বিপক্ষে কোনো না কোনো পক্ষ দাঁড়িয়ে যাবে এবং এর প্রভাব পড়বে সংশ্লিষ্ট রাজনৈতিক দলগুলোর সমর্থকদের মধ্যে। তাহলে স্বাভাবিকভাবেই ধরে নেওয়া যায় সংঘাত কিংবা অস্থিতিশীল পরিস্থিতির পায়তারা সৃষ্টিকারী যেমন রয়েছে ঠিক তেমনিভাবে সংঘাত প্রতিহতকল্পে রাজনৈতিক দলও রয়েছে। সুতরাং দুই পাশে দুই পক্ষ দাঁড়িয়ে গেলে পরিস্থিতি নিয়ন্ত্রণের বাইরে চলে যাবে এবং রাষ্ট্রে একটি অস্থিতিশীল পরিবেশের সৃষ্টি হবে।

সাম্প্রতিক সময়ে দেখা যাচ্ছে বাংলাদেশে ব্যাপকভাবে বিদেশি বিনিয়োগ আসছে এবং বিদেশিদের একটি আগ্রহ তৈরি হয়েছে বাংলাদেশে বিনিয়োগের ব্যাপারে। এর অন্যতম মূল কারণ হচ্ছে বাংলাদেশে দীর্ঘদিন ধরে রাজনৈতিক স্থিতিশীলতা রয়েছে এবং বাংলাদেশে বিনিয়োগ করে দ্রুত লাভবান হওয়া যায়। সে কারণেই পৃথিবীর অনেক প্রতিষ্ঠিত কোম্পানি অন্যান্য দেশে ব্যবসা গুটিয়ে বাংলাদেশে ব্যবসা শুরুর পরিকল্পনা করছে। এখন যদি কোনো কারণে বাংলাদেশের রাজনৈতিক পরিস্থিতি উত্তপ্ত হয়ে পড়ে, অস্থিতিশীল হয়ে উঠে, জনগণের মধ্যে বিভেদ বিদ্বেষ তৈরি হয় তাহলে কিন্তু অর্থনৈতিক অগ্রগতি স্থবির (Economic Turmoil) হয়ে পড়বে এবং সামগ্রিকভাবে সেসবের উপর বিরূপ প্রতিক্রিয়ার সৃষ্টি হবে।

বিশেষ করে বিদেশি বিনিয়োগ (Foreign Investment) কমে আসলে দেশের অভ্যন্তরীণ অর্থনৈতিক কর্মকান্ডে মারত্নকভাবে নেতিবাচক প্রভাব পড়বে এবং সৃষ্ট পরিস্থিতির কারণে দেশের ভেতর অনিয়ম, বিশৃঙ্খলা এবং অপরাধের উৎস তৈরি হবে। সব মিলিয়ে প্রভাব কিন্তু দেশের উপরেই পড়বে এবং ফলশ্রুতিতে দেশের অভ্যন্তরীন স্থিতি স্বাভাবিকতা বিনষ্ট হবে। সুতরাং রাজনৈতিক সংঘাত রাজনৈতিক বিরোধ দেশের অর্থনীতি রাজনৈতিক স্থিতিতে নেতিবাচক প্রভাব ফেলে।

ছাড়া সাম্প্রতিককালে দেখা যায়, রাজনৈতিক দলগুলো যখন পরস্পরবিরোধী সমাবেশের আহ্বান করে তখনই মানুষের মধ্যে এক ধরনের আতঙ্ক ছড়িয়ে পড়ে। মানুষের মাঝে অপরাধে আক্রান্ত হওয়ার ভয় (Fear on Crime) কাজ করে, ঘর থেকে বের হওয়ার সময় প্রায় প্রত্যেকেই আতঙ্কগ্রস্থ হয়ে পড়ে, যেকোনো ধরনের অনাকাঙ্ক্ষিত পরিস্থিতির মুখোমুখি হতে হবে এমন ভাবনা প্রায় সকলের মধ্যে কাজ করে।

আবার দেখা যায়, দুষ্টু চক্র তো ওত পেতেই থাকে সুযোগের সন্ধানে। রাজনৈতিক দলগুলোর বিরোধের পরিক্রমা থেকে সুযোগসন্ধানীরা অপরাধে ঝুঁকে পড়ে এবং এতে সাধারণ মানুষ ব্যাপকভাবে ক্ষতিগ্রস্থ হয়। ধরনের উত্তপ্ত বিরুদ্ধ পরিবেশে আইন-শৃঙ্খলা পরিস্থিতি সকলের জন্য স্বাভাবিক নিরাপদ রাখার লক্ষ্যে কাজ করতে গিয়ে বাহিনীগুলোকে মারাত্নক হুমকির (Threat on Law Enforcement Agency) মুখে পড়তে হয়।

দেশে রাজনৈতিক অস্থিতিশীলতা বিরাজ করলে পুলিশবাহিনী দিয়ে জনগণের নিরাপত্তা নিশ্চিত করা অনেক সময় কঠিন হয়ে পড়ে। কারণ জনগণের আনুপাতিক হারে পুলিশের সংখ্যা তুলনামূলকভাবে কম। দক্ষিণ এশিয়ার অন্যান্য দেশের তুলনায় বাংলাদেশে জনগণের সংখ্যার তুলনায় পুলিশের সংখ্যা অনেকটা কম। এই স্বল্পসংখ্যক সদস্য দিয়ে উত্তপ্ত পরিবেশে যথাযথভাবে সবার নিরাপত্তা নিশ্চিত করা কঠিন হয়ে পড়ে।

কোনো রাজনৈতিক দল যদি সংঘাতের সৃষ্টি করতে চায় তাহলে দেশব্যাপী তাদের প্রত্যেকটি উইং কাজে তাদেরকে সহায়তা করবে। অনেক সময় দেখা যায় কোনো কারণ বিবেচনা ছাড়াই দলের উপর মহলের নির্দেশনা সাপেক্ষে ইউনিটগুলো ধ্বংসাত্নক কর্মকাণ্ডে লিপ্ত হয়ে পড়ে। বিশেষ করে বিশ্ববিদ্যালয়গুলোয় সংশ্লিষ্ট দলের ছাত্র ইউনিটগুলো বিশৃঙ্খল পরিবেশের পায়তারা করে থাকে এবং শিক্ষা প্রতিষ্ঠানগুলো (Educational Institution) উত্তপ্ত হয়ে উঠে। শিক্ষা প্রতিষ্ঠান উত্তপ্ত হয়ে উঠলে সমগ্র দেশেই এর নেতিবাচক প্রভাব পড়ে।

দেখা গেছে, যদি কোনোভাবে একটি উচ্চ শিক্ষা প্রতিষ্ঠানে যৎসামান্য ঘটনা ঘটলেও এর রেশ বাকি প্রতিষ্ঠানগুলোয় খুব দ্রুত ছড়িয়ে পড়ে যায়। আবার সাম্প্রতিক সময়ে দেখা যায় একটি পক্ষই রয়েছে যারা গুজবের মাধ্যমে ঘটনাকে প্রভাবিত করতে চায়, অনাকাঙ্ক্ষিত পরিস্থিতির সৃষ্টি হয়। চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয়ে শাটলে অনাকাঙ্ক্ষিত দুর্ঘটনাকে ঘিরে একজন শিক্ষার্থীর মৃত্যুর গুজবে যে ক্ষয়ক্ষতি সাধিত হয়েছে তা নজিরবিহীন, গুজব সৃষ্টিকারীরা দেশের সব জায়গায় ওত পেতে আছে। আমরা মনে করি, রাজনৈতিক দলগুলো ধরনের গুজব সৃষ্টিকারীদের কোনোরূপ সুযোগ প্রদান করবে না।

সবশেষ যে কথাটি বলা যায় তা হচ্ছে রাজনৈতিক সংঘাতের আবির্ভাব হলে সামগ্রিকভাবে দেশের গুণগত ব্যবস্থাপনা (Total Quality Management) অত্যন্ত দুর্বল হয়ে পড়ে। সে জন্যই রাজনৈতিক দলগুলোর সুস্পষ্ট ইতিবাচক ভূমিকা সবসময়ই কাঙ্ক্ষিত। রাজনৈতিক দলগুলো কোনোভাবে ভুল করে ফেললে দীর্ঘমেয়াদে ব্যাপক ক্ষয়ক্ষতি সাধিত হয়। যার বিভিন্ন প্রমাণ কিন্তু রয়েছে। রাজনৈতিক দলগুলো যদি হরতাল অবরোধের মত ধ্বংসাত্নক কার্যক্রম শুরু করে তাহলে কিন্তু দেশের অর্থনীতি ব্যাপকভাবে ক্ষতিগ্রস্থ হয়ে পড়বে।

২০১৪ সালের নির্বাচনের প্রাক্কালে হরতাল অবরোধের তাণ্ডবে যে ক্ষয়ক্ষতি হয়েছে তা দেশের জনগণ ভুলে যায়নি। মানুষের মধ্যে অপরাধে আক্রান্ত হওয়ার ভয় কাজ করেছে এবং ভয়ে মানুষ অতিপ্রয়োজন ব্যতীত ঘর থেকে বেরও হয়নি। দেশের অর্থনীতি ব্যাপকভাবে ক্ষতিগ্রস্থ হয়েছিল, ভুক্তভোগী হয়েছিল সারা দেশের মানুষ। সামনে নির্বাচন। নির্বাচনকে সামনে রেখে রাজনৈতিক দলগুলো সর্বোচ্চ সতর্কতা অবলম্বন করে কোনো ধরনের বিরুদ্ধ পরিবেশ সৃষ্টি না করে বাংলাদেশকে সামনের দিকে এগিয়ে নেওয়ার প্রত্যয়ে ঐক্যবদ্ধভাবে কাজ করবে। যেখানে সংঘাত সহিংসতার কোনোরূপ জায়গা হতে পারে না।

পরিশেষে বলা যায়, যে সকল রাজনৈতিক দল সরকারি স্থাপনায় হামলার হুমকি দিবে, প্রকারান্তরে সুযোগ পেলে হামলা করে দিতে তারা পিছপা হবে না। এখন যদি টেকব্যাক বাংলাদেশের নাম করে কোনো রাজনৈতিক দল সংঘাতের সূচনা ঘটায়, তাহলে রাজনীতিতে তাদেরকে মারাত্নক খেসারত দিতে হবে। মনে রাখতে হবে সরকারি সম্পদ দেশের সকলের, সরকারি সম্পদের ক্ষতি যারা করবে তারা দেশের জনগণের শত্রু। তাদের হাতে দেশ নিরাপদ থাকতে পারে না। সে লক্ষ্যেই রাজনৈতিক দলগুলোকে যেকোনো মূল্যে আলাপ আলোচনার ভিত্তিতে সমঝোতায় আসতে হবে। কতিপয় রাজনৈতিক দলের বিদেশপ্রীতি নিয়েও কথা উঠছে। বিদেশপ্রীতি পরিহার করে অভ্যন্তরীণ উপায়ে রাজনীতিতে যেকোনো সমস্যার সমাধান করা সম্ভব। বিষয়গুলো মাথায় নিয়েই রাজনৈতিক দলগুলো তাদের উপর অর্পিত দায়িত্ব যথাযথভাবে পালন করবে-এমনটিই প্রত্যাশা দেশের আপামর জনতার।

লেখক: চেয়ারম্যান, ক্রিমিনোলজি অ্যান্ড পুলিশ সায়েন্স বিভাগ, চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয়।

মেসেঞ্জার/আল আমিন