ঢাকা,  বৃহস্পতিবার
২১ নভেম্বর ২০২৪

The Daily Messenger

বায়ান্ন বছরের বাংলাদেশের হোঁচট খাওয়া নির্বাচন ও গণতন্ত্র

জুয়েল রাজ

প্রকাশিত: ১৫:৩৬, ৬ জানুয়ারি ২০২৪

আপডেট: ১৫:৫০, ৬ জানুয়ারি ২০২৪

বায়ান্ন বছরের বাংলাদেশের হোঁচট খাওয়া নির্বাচন ও গণতন্ত্র

ছবি : মেসেঞ্জার

স্বাধীনতা পরবর্তী বায়ান্ন বছরের পথচলায় বারবার গণতন্ত্রের চর্চা ব্যাহত হয়েছে, ১৯৭৩ সালের সংসদের পথচলা থেকে যদি স্বাভাবিক  প্রক্রিয়ায় গণতন্ত্রের চর্চা হয়ে আসত, তাহলে বাংলাদেশের গণতন্ত্র ও তার চর্চা আরও সুসংঠিত হত। কিন্তু শুরুতেই হোঁচট খাওয়া গণতন্ত্র এখনো খুঁড়িয়ে খুঁড়িয়ে পথ চলছে। স্বাধীন দেশে  ১৯৭৩ শালে প্রথম সাধারণ  নির্বাচন অনুষ্ঠিত হয়। সেই নির্বাচনে ১৪টি দলের এক হাজার ৯১ জন প্রার্থী অংশ নিয়েছিলেন। মোট ভোটারের ৫৫ শতাংশ প্রদত্ত ভোটের ৭৩ শতাংশ ভোট পেয়ে বিজয়ী হয়েছিল আওয়ামী লীগ। মোট আসন পেয়েছিল ২৮২ টি। জাসদ ৬.৫২ শতাংশ ভোট পেয়ে ২৭৩ আসনে প্রতিদ্বন্ধিতা করে আসন পেয়েছিল মাত্র ১ টি। ৫ জন স্বতন্ত্র প্রার্থী ও সেই নির্বাচনে বিজয়ী হয়েছিলেন।

১৯৭৫ সালে বঙ্গবন্ধুকে সপরিবারে হত্যার মধ্যদিয়ে, জাতীয় নেতাদের জেলে হত্যা করে ক্ষমতার  দৃশ্যপটে উঠে আসেন সেনা শাসক জিয়াউর রহমান, শুরু হয় গণতন্ত্র ও নির্বাচনের সাথে ছেলেখেলা।

১৯৭৭ সালে জিয়াউর রহমান একটি গণভোটে তার ক্ষমতাকে বৈধ করার জন্য জনসমর্থন চান। তাতে ৮৮ দশমিক ৫ শতাংশ ভোটার ভোট দিতে আসে বলে সরকারি বার্তা সংস্থা প্রচার করে। যা আদতে শতভাগ ভূয়া ছিল বাস্তবে এক দুই শতাংশ ভোটও পড়ে নাই বলেই ইতিহাস স্বাক্ষ্য দেয়।

একই ভাবে  জিয়াউর রহমান ১৯৭৮ সালে সামরিক শাসন থেকে রাষ্ট্রপতি পদে নিজেকে অধিষ্ঠিত করতে আরেকটি পাতানো  রাষ্ট্রপতি নির্বাচনের আয়োজন করেন। তার সাথে গণতান্ত্রিক ঐক্যজোটের প্রার্থী হিসেবে। প্রতিদ্বন্ধিতা করেন জেনারেল ওসমানী। জিয়াউর রহমান নিজ পক্ষে দেওয়া ৭৭ শতাংশ ভোট পান বলে সরকারিভাবে প্রকাশ করেন। 

আবার ১৯৭৯ সালে সাধারণ নির্বাচনের আগে জিয়াউর রহমান বিএনপি গঠন করে রাজনীতির মাঠে নামেন সেখানে মোট ২৯টি দলের দুই হাজার ১১৫ জন প্রার্থী প্রতিদ্বন্দ্বিতা করেন। সংসদের ৩০০ আসনের মধ্যে বিএনপি লাভ করে ২০৭টি। আওয়ামী লীগ (মালেক) ২৫ শতাংশ ভোট পেয়ে ৩৯টি আসনে জয়ী হয়। আওয়ামী লীগ (মিজান) শূন্য দশমিক ৩৬ শতাংশ ভোট পেয়ে দু’টি আসন পায়, মুসলিম লীগ ও আইডিএল ২৬৬ আসনে প্রতিদ্বন্দ্বিতা করে ১০ শতাংশ ভোট এবং ২০টি আসন পায়। জাসদ ২৪০ আসনে প্রতিদ্বন্দ্বিতা করে ৫ শতাংশ ভোট ও আটটি আসন পায়। ন্যাপ (মো.) কুঁড়েঘর নিয়ে সোয়া ২ শতাংশ ভোট ও একটি আসন, একতা পার্টি একটি আসন লাভ করে। ৪২২ জন স্বতন্ত্র প্রার্থী ১০ শতাংশ ভোট ও ১৬টি আসন পায়। সেই নির্বাচনে বিএনপির প্রার্থীরা অভিযোগ তুলেন যে সরকার হিসাব কষে তাদের ফেল করিয়ে অন্যদের বিজয়ী দেখিয়েছে।

একই ভাবে ১৯৮১ সালের নির্বাচনে ৫৫ দশমিক ৪৭ শতাংশ ভোটার ভোট দিতে আসে। এ ভোটের সাড়ে ৬৫ শতাংশ ভোট পেয়ে আবদুস সাত্তার রাষ্ট্রপতি নির্বাচিত হন। আবার ১৯৮৬ সালের নির্বাচনে নির্বাচনের ফল দাঁড়াল ৩০০ আসনে প্রতিদ্বন্দ্বিতা করে এক কোটি ২১ লাখ ভোট নিয়ে ১৫৩ আসনে বিজয়ী হয় জাতীয় পার্টি।

২৫৬ আসনে নেমে ৭৫ লাখ ভোট সংগ্রহ করে ২৬ শতাংশ ভোট পেয়ে আওয়ামী লীগ ৭৬ আসন পায়। ৪ শতাংশ ভোট নিয়ে ১০টি আসন পায় জামায়াত। মনি সিংহের কমিউনিস্ট পার্টি আড়াই লাখ ভোট নিয়ে পাঁচটি আসন লাভ করে। মো: ন্যাপ পায় দু’টি, ন্যাপ, বাকশাল তিনটি, জাসদ চারটি, জাসদ (সিরাজ) তিনটি, মুসলিম লীগ চারটি, ওয়ার্কার্স পার্টি তিনটি ও স্বতন্ত্র থেকে ৩২টি আসন পায়।

আবার ১৯৮৮ সালে ভোটার হাজিরা ছিল ১ শতাংশের সামান্য কিছু বেশি। অবশ্য নির্বাচন কমিশন দাবি করে, ৫৫ শতাংশ মানুষ ভোট দিয়ে গেছে। জাতীয় পার্টি ২৫১ সিট হাত করে। অজ্ঞাত পরিচয় ৭৬টি রাজনৈতিক দল নিয়ে রাজনৈতিক ভাগ্যান্বেষী আ স ম রব ৩২ লাখ ভোট ও ১৮টি আসন পান, স্বতন্ত্র এমপি হন ২৫ জন, ফ্রিডম পার্টি দুই ও শাহজাহান সিরাজ তিনটি আসন পান। মূলত জিয়াউর রহমান ও এরশাদ নির্বাচনকে একটি খেলায় পরিণত করেছিলেন।

এরশাদের পতনের পর দ্বিতীয় দফায়  তত্ত্বাবধায়ক সরকারের অধীনে ১৯৯১ সালের ২৭ ফেব্রুয়ারি বিচারপতি  সাহাবুদ্দীন আহমদের অধীনে যে নির্বাচন সম্পন্ন হয় তা ব্যাপকভাবে গ্রহণযোগ্যতা পায় । এবং বলা হয় বাংলদেশে গণতন্ত্রের দ্বিতীয় যাত্রা শুরু ।

১৯৯১ সালের সংসদে ৭৬টি দল দুই হাজার ৩৫০ জন প্রার্থী অংশ নিয়েছিলেন। স্বতন্ত্র প্রার্থী ছিলেন ৪২৪ জন। ফলাফলে দেখা যায়  বিএনপি ১৪০, আওয়ামী লীগ ৮৮, জাপা ৩৫, জামায়াত ১৮, সিপিবি ৫, বাকশাল ৫, স্বতন্ত্র ৩, ন্যাপ (মো:) ১, গণতন্ত্রী পার্টি ১, ওয়ার্কার্স পার্টি ১, জাসদ সিরাজ ১, ইসলামী ঐক্যজোট ১ ও এনডিপি ১ টি করে আসনে বিজয়ী হয়।মোট ভোটার অংশগ্রহণ ছিল ৫৫.৫৪ শতাংশ।

ক্ষমতায় গিয়ে বিএনপি আবার পুরাতন চেহারায় ফিরে আসে, তত্ত্বাবধায়ক ব্যবস্থা বাতিল করে দলীয় সরকারের অধীনে নির্বাচনের প্রস্তুতি নেয়। আওয়ামী লীগ তার সমমনা দলের আন্দোলনের মুখে, ১৯৯৬ সালের ১৫ ফেব্রুয়ারির একতরফা নির্বাচনের মাধ্যমে গঠিত সংসদে   রাতের আঁধারে আবার ও পাস হলো তত্ত্বাবধায়ক সরকার ব্যবস্থা সংযুক্ত করে  ১৫ দিনের মাথায়  বিদায় নেয় খালেদাজিয়ার সরকার।

বিচারপতি হাবিবুর রহমানের নেতৃত্বে গঠিত তত্ত্বাবধায়ক সরকারের অধীনে নির্বাচনে ২১ বছর পর আওয়ামী লীগ ক্ষমতায় আসে। ৩৭.৪৪ শতাংশ ভোট পেয়ে ১৪৬ আসন পায় আওয়ামী লীগ। বিএনপি ৩৩.৬০ শতাংশ ভোট পেয়ে ১১৬ আসন, জাতীয় পার্টি ২৯৩ আসনে নির্বাচন করে ১৬.৪০ শতাংশ ভোট পেয়ে ৩২ এবং জামায়াত ৮.৬১ শতাংশ ভোট পেয়ে ৩ আসন পায়।

আবার ২০০১ সালের ১ অক্টোবর চারদলীয় জোট দুই-তৃতীয়াংশ সংখ্যাগরিষ্ঠতা নিয়ে বিজয়ী হয়। নির্বাচনে বিএনপি ২৫২ আসনে প্রার্থী দিয়ে ৪০.৯৭ শতাংশ ভোট পেয়ে ১৯৩ আসন লাভ করে। আওয়ামী লীগ ৩০০ আসনে প্রার্থী দিয়ে ৪০.১৩ শতাংশ ভোট পেয়ে ৬২ আসন, জাতীয় পার্টি ২৮১ আসনে প্রার্থী দিয়ে ৭.২৫ শতাংশ ভোট পেয়ে ১৪ আসন, জামায়াত ৩১ আসনে প্রার্থী দিয়ে ৪.২৮ শতাংশ ভোট পেয়ে ১৭ আসনে বিজয়ী হয়। ২০০১ সালের বিএনপির দুর্নীতি দু;শাসন, ভূয়া ভোটার তালিকা প্রণয়ণ,বিচারপতির অবসরের বয়সসীমা বাড়িয়ে দলীয় পছন্দের বিচারপতিকে তত্ত্বাবধায়ক সরকার প্রধান করার প্রচেষ্টা, সব যখন ব্যার্থ হয় রাষ্ট্রপতি ও তত্ত্বাবধায়ক সরকার প্রধান বনে যাওয়া নিয়ে জন্ম নেয় এক এগারোর সেনা সমর্থিত তত্ত্বাবধায়ক  সরকার ।

২০০৮ সালের ২৯ ডিসেম্বর নির্বাচন। জোট আর মহাজোটের এই নির্বাচনে জাতীয় পার্টি ছিল আওয়ামী লীগের জোট শরিক। অপর দিকে বিএনপির নেতৃত্বাধীন ২০ দলীয় জোট। নির্বাচনে আওয়ামী লীগ ৪৯ শতাংশ ভোট পেয়ে ২৫৯ আসনে বিজয়ী হয়। বিএনপি ৩৩ দশমিক ২ শতাংশ ভোট পেয়ে ৩০ আসনে বিজয়ী হয়।  ৭ শতাংশ ভোট পেয়ে জাতীয় পার্টি ২৭ আসন। ৪ দশমিক ৬ শতাংশ ভোট পেয়ে জামায়াত দুই আসনে বিজয়ী হয়। হাসানুল হক ইনু ও মঈন উদ্দিন খান বাদলের দল মশাল মার্কা নিয়ে তিনটি আসন পায়।

২০১৪ সালে বাংলাদেশে দশম জাতীয় সংসদ নির্বাচন অনুষ্ঠিত হয়। যেখানে বিএনপির খালেদা জিয়া নেতৃত্বাধীন প্রধান বিরোধীজোট তত্ত্বাবধায়ক সরকার ব্যবস্থার পুনঃপ্রবর্তনের দাবিতে নির্বাচন বর্জন করে। যার ফলে ৩০০টি আসনের মধ্যে ২৩৪টি আসন আওয়ামী লীগ লাভ করে এবং এর মধ্যে ১৫৩টি আসনে বিনা প্রতিদ্বন্দ্বিতায় মহাজোটের প্রার্থীরা নির্বাচিত হন এবং বিভিন্ন মাধ্যমে নির্বাচনটিকে ‘প্রশ্নবিদ্ধ’ হিসেবে বলা হয়েছে। এসময় শেখ হাসিনার নেতৃত্বাধীন মহাজোট সরকার গঠন করে। রওশন এরশাদের নেতৃত্বে জাতীয় পার্টি সংসদে বিরোধীদলের ভূমিকা পালন করে। যদিও এসময়কালে বেশ কয়েকবার বিরোধীদলের ভূমিকা নিয়ে সমালোচনা হয়েছে। পরবর্তীতে বিভিন্ন সময় আন্দোলন, সহিংসতা ও বিরোধীদের গ্রেফতারের ঘটনা ঘটেছে। ২০১৮ সালে ও একই পথে হাঁটে বিএনপি নির্বাচনে অংশ্ নিয়ে ও নির্বাচনের দিন শেষ সময়ে এসে নির্বাচন থেকে সরে দাঁড়ানোর ঘোষনা দেয়। যদি তাঁদের বেশ কয়েকজন সেই  নির্বাচনে বিজয়ী  হয়ে শপথ নিয়ে সংসদে ও যোগ দিয়েছিলেন।

আওয়ামী লীগ  যে কাজটি করেছে বা করতে চেষ্টা করেছে সেই হোঁচট খাওয়া গণতন্ত্রকে টেনে তোলার চেষ্টা করেছে, সাংবিধানিক ভাবে  গণতন্ত্রকে সুসংগঠিত করার চেষ্টা করেছে। পৃথিবীর কোন দেশেই তত্ত্বাবধায়ক সরকার ব্যবস্থা চালু নেই। ১৯৯০ সালে এরশাদ সরকারের পতনের পর বিশেষ অবস্থায় , সময়ের প্রয়োজনে  যে ত্বত্ত্বাবধায়ক  সরকার ব্যবস্থা গড়ে উঠেছিল , বিএনপি ১৯৯৬ সালে সেই প্রক্রিয়াকে ব্যাহত করে, একই অবস্থায় আওয়ামী লীগ ২০০১ সালে ৫ বছর রাষ্ট্র পরিচালনার পর শান্তিপূর্ণ ভাবে ত্বত্তাবধায়ক প্রধান  লতিফুর রহমানের সরকারের হাতে ক্ষমতা হস্তান্তর করেছিল। কিন্তু ২০০১ সালে বিএনপি আবার সেই প্রক্রিয়াকে প্রশ্নবিদ্ধ করে তোলে  তত্বাবধায়ক সরকার ব্যবস্থাকে অস্বীকার করে। আওয়ামী লীগের দুইবারের নির্বাচন নিয়ে প্রশ্ন উঠতে পারে, সেই সুযোগ আছে,  এবং আওয়ামী লীগ ও তা অস্বীকার করে না। বরং নানান  ভাবে আকারে ইঙ্গিতে সেটি স্বীকার করে নেন দলটির নেতারা।

রাত পোহালেই বাংলাদেশে দ্বাদশ সংসদ নির্বাচন, বহু চড়াই উৎরাই পেরিয়ে, দেশের বৃহৎ একটি রাজনৈতিক দলের ভোট বর্জনের মধ্য দিয়ে অনুষ্ঠিত হতে যাচ্ছে এবারের নির্বাচন। যদি ও শুরুতে বিএনপি যে ঝড়ের আভাস দিয়েছিল, শেষ পর্যন্ত আসলে তার কিছুই হয়নি। ৭ জানুয়ারী  হরতাল ঘোষনার মধ্য দিয়েই সেই ঝড়ের সমাপ্তি হয়েছে। ৭ তারিখে  সাধারণ ভোটারদের কেন্দ্রে আসা প্রতিহত করার চেষ্টা এবং জ্বালাও পোড়াও করে  বা করার চেষ্টা করে কতটা সফল হবে কিংবা মনোবল ভাঙ্গা বিএনপির মাঠ পর্যায়ের নেতা কর্মীরা আদতে মাঠে নামবেন কী না সেটি ও  দেখার বিষয়। কারণ নির্বাচন প্রচারণা কালীন সময়ে কোথাও বিএনপির সমর্থক কর্মীরা স্বতন্ত্র প্রার্থী, কোথাও জাতীয় পার্টি, কোন কোন জায়গায় তৃণমূল বিএনপি বা অন্য কোন প্রার্থীর সাথে মাঠে প্রচারণায় অংশ নিয়েছেন বলেও  দেখা গেছে। 

নৌকা বনাম আওয়ামী লীগ কিংবা স্বতন্ত্র বনাম আওয়ামী লীগ যে ভাবেই যে নামেই ডাকা হোক না কেন , বাংলাদেশের মানুষ যে  নির্বাচনী আমেজের জন্য অপেক্ষা করে, সে আমেজ কিছু কিছু আসন ছাড়া, প্রায় সব জায়গায় জমে উঠেছে। সাধারণ মানুষের অংশগ্রহণই গণতন্ত্রের সৌন্দর্য। তাঁদের অংশগ্রহণই সুংগঠিত করবে রাজনৈতিক গণতন্ত্রকে।

লেখক- সাংবাদিক, কলামিষ্ট

মেসেঞ্জার/ফারদিন