ছবি : মেসেঞ্জার
শান্তিতে নোবেলজয়ী অর্থনীতিবিদ অধ্যাপক মুহাম্মদ ইউনূস মনে করেন ২০০৭ সালে বাংলাদেশে সেনা সমর্থিত তত্ত্বাবধায়ক সরকারের সময় তার রাজনৈতিক দল গঠনের উদ্যোগ ভুল ছিলো। বিবিসি বাংলাকে দেওয়া এক বিশেষ সাক্ষাৎকারে অধ্যাপক ইউনূস দাবি করেছেন, তখন সেনা সমর্থিত সরকারের অনুরোধের পরও তিনি সরকার প্রধানের দায়িত্ব নেননি। পরবর্তীতে সবার অনুরোধে রাজনৈতিক দল গঠনের উদ্যোগ নিয়েছিলেন। এই উদ্যোগটি শুরুর পর দশ সপ্তাহের মধ্যেই তিনি সেখান থেকে সরে আসেন। অধ্যাপক ইউনূস প্রশ্ন রাখেন, “দশ সপ্তাহের সেই ঘটনার জন্য সারাজীবন আমাকে খেসারত দিতে হবে?”
ড. ইউনূসের এই বক্তব্য থেকে মনে হয় রাজনৈতিক দল গঠনের কারণেই তাঁকে বিভিন্ন মামলায় বিচারের মুখোমুখি হতে হচ্ছে। কিন্তু আদতে বিষয়টি তা নয়, প্রচলিত আইনে সংশ্লিষ্ট ব্যক্তিসকল সংক্ষুব্ধ হয়ে মামলা করেছে এবং রাষ্ট্রের প্রচলিত আইন অনুযায়ী বিচার কাজ পরিচালিত হচ্ছে। কিছু কিছু মামলায় ড. ইউনূসের বিরুদ্ধে শাস্তি প্রদান করা হয়েছে এবং তিনি বর্তমানে জামিনে রয়েছেন।
বিবিসি বাংলার সাথে সাক্ষাৎকারে ড. ইউনূস ওয়ান ইলেভেনের সময় রাজনৈতিক দল গঠন ও তত্ত্বাবধায়ক সরকারের প্রধান হিসেবে দায়িত্ব গ্রহণের নিমিত্তে অনুরোধ ও সুপারিশের বিষয়ে পত্রিকায় বিবৃতি প্রদান করেন। তিনি মনে করেছেন এবং ভেবে বসে আছেন নোবেল পুরস্কারকে সামনে রেখে তিনি কিংবা তাঁর অধীনস্ত প্রতিষ্ঠানের অনিয়মের বিরুদ্ধে কেউই মুখ খুলবে না। কর ফাঁকি, ট্যাক্স ফাঁকি, শ্রমিকদের ন্যায্য অধিকার থেকে বঞ্চিত করার বিরুদ্ধে সংক্ষুব্ধরা কথা বলবে না। এ বিষয়টিই মূলত ড. ইউনূসের জন্য কাল হয়ে দাঁড়িয়েছে। তিনি চেয়েছিলেন সরকার নিজস্ব ব্যবস্থাপনায় হয়তো অনুকম্পা করতে পারে। কিন্তু সরকার চেয়েছে আইন তার নিজস্ব গতিতে চলুক এবং প্রতিটি ঘটনার পুঙ্খানুপুঙ্খ বিশ্লেষণের মধ্যদিয়ে ঘটনার সত্যতা নিশ্চিত হউক।
শুধু তাই নয়, ড. ইউনূস বিভিন্ন মামলাকে ভিন্নখাতে প্রবাহিত করবার উদ্দেশ্যে বিশ্ব বরেণ্য প্রতিষ্ঠিত ব্যক্তিবর্গের মাধ্যমে সরকারকে বিচার বন্ধে খোলা চিঠি প্রদান করেন। ভিন্ন দেশের নোবেলবিদ ও সরকার প্রধানদের দ্বারা বাংলাদেশের বিচার ব্যবস্থাকে অবৈধভাবে হস্তক্ষেপ করার মানেই হল দেশের স্বাধীনতা ও সার্বভৌমত্বকে খাটো করা, দেশের বিচার ব্যবস্থায় অন্যদের হস্তক্ষেপ এবং সেটি মেনে নিয়ে বিচার বন্ধ করা কার্যত একটি রাষ্ট্রের দুর্বলতাকে অন্যদের সামনে তুলে ধরা যেটি কোনভাবেই মানানসই হতে পারে না। একটি দেশের দুর্বলতা হতে পারে অন্যদের সুযোগ করে দেওয়া এবং এর প্রেক্ষিতে বিরোধী গোষ্ঠী একটি সুযোগ লুফে নিতে পারে। শুধু তাই নয় একটি দেশের সার্বভৌমত্বের প্রশ্নে আপস করবার কোনোরূপ সুযোগ নেই।
রাজনীতি করার অন্যতম প্রধান শর্ত হচ্ছে জনগণের সঙ্গে একীভূত হতে হবে, জনগণের বিপদে আপদে পাশে দাঁড়াতে হবে। জনগণের সঙ্গে সম্পৃক্ততা না রেখে হুট করে একটি রাজনৈতিক দল ঘোষণা করলে সেটি কখনোই আলোর মুখ দেখে না। এ বিষয়টি ড. ইউনূস না বোঝেই নাগরিক শক্তি নামে একটি রাজনৈতিক দল গঠনের সিদ্ধান্ত গ্রহণ করেছেন।মূলত উচ্চাকাঙ্খা থেকে তিনি এ ধরনের সিদ্ধান্ত গ্রহণ করেছেন, এ সিদ্ধান্ত গ্রহণে মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের সঙ্গে সঙ্গে বাংলাদেশের সামরিক বাহিনীর যোগসূত্রতা ছিল। ফলাফলস্বরূপ, দেশের জনগণ ড. ইউনূসকে প্রত্যাখান করেছেন এবং তাঁর উদ্যোগে অঙ্কুরোদগম হওয়ার পূর্বে উদ্যোগটি ভেস্তে যায়।
২০০৭ সালে ওয়ান ইলেভেনের পর সেনা সমর্থিত তত্ত্বাবধায়ক সরকারের সময় বাংলাদেশের রাজনীতিতে বেশ গুরুত্বপূর্ণ হয়ে উঠেছিলেন মুহাম্মদ ইউনূস। তখন সাবেক প্রধানমন্ত্রী বেগম খালেদা জিয়া ও বর্তমান প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনাকে বাদ দিয়ে একটা রাজনীতির চেষ্টা চলছিলো। সেই সময় অধ্যাপক ইউনূসের নেতৃত্বে একটি দল গঠনের আলোচনাও ছিলো জোরালোভাবে। সাক্ষাৎকারে এ বিষয়ে সব প্রশ্নের খোলামেলা উত্তর দেন অধ্যাপক ইউনূস। তিনি বলেন, সেই সময় সেনাবাহিনী তো আমার কাছেই আসলো। তারা আমাকে বললো, আপনি সরকার প্রধান হবার দায়িত্ব গ্রহণ করেন। তারা আমাকে বলেছিলো, বাংলার মসনদ আপনার হাতে। আপনি এটাতে বসেন। আমি বলেছি, নাহ আমি তো বসবো না। আমি তো রাজনীতি করি না। আমি তো রাজনীতির মানুষ না।
তিনি আরও বলেন, বারে বারে আমাকে বোঝানোর চেষ্টা করা হলো। কখনো ভয় দেখানো হলো, কখনো উৎসাহ দেওয়া হলো যে এটা মস্ত বড় সম্মানের বিষয়। আমি প্রতিবারই জবাব দেয়ার চেষ্টা করেছি আমি এই দায়িত্ব গ্রহণ করবো না। তারা তারপরও আসার কথা বললো। কিন্তু আমি আমার অবস্থান পরিবর্তন করবো না বলেই জানিয়েছিলাম।
এমন পরিস্থিতিতে নাগরিক শক্তি নামে একটি দল গঠনের উদ্যোগের কথা তিনি জানান। তিনি বলেন, আমাকে নানা রকম চাপের মধ্যে ফেলা হলো। তখন আমি সবাইকে চিঠি দিলাম, সবার মতামত নিতে থাকলাম। পক্ষে বিপক্ষে নানা মত আসলো। তখন দলের নাম কী হবে সেটা নিয়ে কৌতুহল ছিলো। তখন আমি একটা নাম দিলাম নাগরিক শক্তি। পরবর্তী একটা সময় বলে দিলাম নাহ আমি আর এই রাজনীতিতে নাই, আমি রাজনীতি করতে চাই না”। তবে রাজনৈতিক দল গঠনের সেই সিদ্ধান্ত ভুল ছিলো বলে তিনি মনে করেন। তখন যদি তিনি বৈতরণী পার হতে পারতেন তাহলে কি এ ধরনের প্রশ্নের মুখোমুখি তিনি হতেন-এটা একটি গুরুত্বপূর্ণ বিষয়। বাংলাদেশের একটি পত্রিকার সাংবাদিক তো টেলিভিশন টকশোতে বলেই দিলেন-১/১১ এর সময়ে ডিজিএফআই প্রদত্ত তথ্য কোন ধরনের যাচাই বাছাই ব্যতিরেকে পত্রিকায় সংবাদ করেছিলেন এবং সে জন্য তিনি ক্ষমাও চেয়েছেন।
বর্তমান সরকার ২০০৯ সালে ক্ষমতায় আসার পর পদ্মাসেতু নির্মাণের উদ্যোগ নেয়। সে সময় অর্থায়নে রাজিও হয় বিশ্ব ব্যাংক। কিন্তু মাঝপথে সেই অর্থায়ন আটকে যায় দুর্নীতির অভিযোগে। এরপর বিভিন্ন সভা-সমাবেশে প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা অভিযোগ তোলেন অধ্যাপক মুহাম্মদ ইউনূস প্রভাবিত করার কারণেই আটকে গিয়েছিলো পদ্মাসেতুর অর্থায়ন। বিবিসি বাংলা সাক্ষাৎকারে এসব বিষয় নিয়ে সরাসরি কথা বলে অধ্যাপক ইউনুসের সাথে। জবাবে তিনি বলেন, “আমার বাধা দেয়ার তো কোনো কারণ নাই। দেশের মানুষের স্বপ্ন পদ্মা সেতু। এটা বাধা দেওয়ার প্রশ্ন আসছে কেন।? বিশ্ব ব্যাংক তো আমার প্রভাবিত করার জন্য অপেক্ষা করে নাই। তারা তো বলছে দুর্নীতি হয়েছে। সে সময়ের সেই ঘটনা প্রবাহ তুলে ধরেন নোবেলজয়ী এই বাংলাদেশি অর্থনীতিবিদ।
ড. ইউনূস বলেন, দুর্নীতি হয়েছে এমন কারণ দেখিয়ে তখন বিশ্ব ব্যাংক বিভিন্নজনকে প্রকল্প থেকে সরানোর কথা বলেছে। সরকার তাদের সরিয়েছিলো। শেষ পর্যন্ত একজনকে সরাতে রাজি হলো না সরকার। তখন পরিষ্কারভাবে বিশ্ব ব্যাংক বলেছিলো, না সরালে টাকা দেবে না। সরকার তখন রাজি হলো না। তারা টাকা বন্ধ করে দিলো। তাহলে এখানে আমাকে কেন দোষ দেয়া হচ্ছে? পদ্মা সেতুর বিষয়ে বিশ্ব ব্যাংকের সাথে তার কোন যোগাযোগ হয়নি বলেও দাবি করেন তিনি। দীর্ঘ এই সাক্ষাৎকারে অধ্যাপক মুহাম্মদ ইউনূস তার কর্মজীবন, ক্ষুদ্র ঋণ, গ্রামীণ ব্যাংক প্রতিষ্ঠাসহ নানা বিষয়ে তার খোলামেলা বক্তব্য তুলে ধরেন। কিন্তু যে বিষয়টি এখন খুব জোরালোভাবে দাঁড় করানো যায় সেটি হচ্ছে, ড. ইঊনূসের বিরুদ্ধে মামলার প্রতিউত্তরে তিনি যেভাবে বৈশ্বিক নেটওয়ার্ককে কাজে লাগাচ্ছেন পদ্মা সেতুর বিবাদমান ইস্যুতে তিনি কেন তাঁর বন্ধুদের বাংলাদেশের পক্ষে কাজে লাগান নি? জনমানুষের মনে চাউর রয়েছে ড. ইউনূস কেবলমাত্র নিজের জন্যই সব কিছুই করেন, দেশের জন্য দেশের মানুষের জন্য ইতিবাচক কোন ধরনের উদ্যোগ গ্রহণ করেননি কিংবা করতে পারেননি।
লেখক: সহকারী অধ্যাপক ও সভাপতি, ক্রিমিনোলজি এন্ড পুলিশ সায়েন্স বিভাগ, চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয়।
মেসেঞ্জার/দিশা