ঢাকা,  শনিবার
২১ ডিসেম্বর ২০২৪

The Daily Messenger

বাস্তব জীবনে শিক্ষা গুরুর ভূমিকা

প্রকাশিত: ১৪:১৫, ২৬ মার্চ ২০২৪

আপডেট: ১৪:২০, ২৬ মার্চ ২০২৪

বাস্তব জীবনে শিক্ষা গুরুর ভূমিকা

ছবি : মেসেঞ্জার

২০০১-২০০৪ সাল আমার জীবনের খুবই গুরুত্বপূর্ণ অধ্যায়। কারণ এই চার বছর আমি কুষ্টিয়া কেন্দ্রীয় বাস টার্মিনালে লালন শাহ টি স্টলে চা বিক্রি করেছি। যেই টি স্টলটি এখনো আছে। কারন আমার বাবা ভ্যান চালিয়ে তিন ভাই-বোন আর আমার অসুস্থ মায়ের চিকিৎসা খরচ টানতে হিমসিম খাচ্ছিলেন। ২০০৩ সালে আমার মায়ের তিন-তিনটা অপারেশন করতে হয় যার দরুন আমার বাবার শেষ সম্বল ২ বিঘা জমিও বিক্রি করতে হয়েছিলো যার দরুণ আমার পুরো পরিবার রাস্তায় এসে পড়ে। 

আমি চা ঘুটতাম আর ডিপোতে যে বাসগুলো ঢুকত আর বের হত আমি সেগুলোর নাম পড়তাম। দোকানদার প্রবির মিত্র এটা খেয়াল করতেন। উনি আমার বাবার সাথে কথা বলে তার বাসায় আমাকে রাখেন এবং ১৫ নং জুগিয়া দক্ষিণ পাড়া সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয়ে ভর্তি করিয়ে দেন। তিনিই আমার প্রথম শিক্ষক কারন তিনি নিজেও শিক্ষিত ছিলেন। পাশাপাশি স্কুলে গুরু হিসাবে পাই সদর উদ্দিন স্যারকে।

প্রাথমিক বিদ্যালয় পাস করার পর প্রাথমিক বিদ্যালয়ের শিক্ষক সদর উদ্দিন স্যার নিজেই ফর্ম তুলে আমাকে কুষ্টিয়া জিলা স্কুলে ভর্তি পরীক্ষা দেওয়ান এবং মেধা তালিকায় ৭ম হই। বাসা থেকে স্কুল অনেক দূর। ভাড়া দিতে পারব না বলে আমাকে একটা হিরো সাইকেল কিনে দেন।

জিলা স্কুলে গুরু হিসাবে পাই শামসুর রহমান স্যারকে। ২০০৭ সালে ৭ম শ্রেণীতে উঠে স্যারকে প্রস্তাব দিয়েছিলাম, আপনার বাসায় একটা রুম আমাকে দেন, তৃতীয় শ্রেণিতে ভর্তি পরীক্ষা দেওয়ানোর জন্য কিছু শিক্ষার্থীকে পড়াবো। আমিই পড়াবো, আপনি শুধু মাথার উপর ছাদ হয়ে থাকবেন। শিষ্যের প্রতি গুরুর অগাধ আস্থা থাকতে হয়, তবেই গুরু শিষ্যের আত্তা এক হয়ে যায়। স্যার অনুমতি দিলেন, আমার ক্লাসে বন্ধুদের বললাম প্রচারের জন্য। প্রচারণায় দারুন কাজ হলো, দুই ব্যাচে ৪৩ জন ছেলে মেয়ে নিয়ে যাত্রা শুরু করলাম। বছর শেষে ৩৮ জন চান্স পেল। আর পিছন ফিরে তাকাতে হয়নি। 

২০০৭ সাল থেকে ২০১১ সাল পর্যন্ত কোনোদিন জিলা স্কুলে টিফিনের পর ক্লাস করতে পারিনি। কারন ব্যাচ পড়াতাম। তবুও স্যারদের কোনো অভিযোগ ছিল না। কারণ সবসময় মেধা তালিকায় থাকতাম। 

জিলা স্কুল থেকে মাধ্যমিকে ভালো ফলাফল করলাম। উচ্চ মাধ্যমিকে ভর্তি হলাম কুষ্টিয়া সরকারি কলেজে। সেখানে গুরু হিসাবে পেলাম আহসান কবির রানা স্যারকে। কলেজে উঠার পর সামছুর রহমান স্যারকে বললাম, এবার আপনি এডমিশন ব্যাচ চালান আমি আমার গ্রামে কোচিং সেন্টার খুলব। 

স্যারের দোয়া নিয়ে ২০১২ সালের জানুয়ারি মাসের ৭ তারিখে কয়েকজন বন্ধু কে নিয়ে এলাকায় চালু করলাম Learning Home Kindergarten & Art school এবং Learning Home Coaching Centre. আট বছর সুনামের সাথে পরিচালনা করলাম। আমার স্কুল এবং কোচিংয়ে বিশ্ববিদ্যালয়ের ডিপার্টমেন্টের অনেক বন্ধু ও বড়ভাই পরিদর্শন করেছেন। সংগত কারনে একটা সময় স্কুল আর কোচিং বাদ দেই এবং বাসায় টিউশনি শুরু করি।

এইচ এস সি তে উচ্চতর গনিতের কারনে রেজাল্ট খারাপ হলো। বন্ধু-বান্ধব এবং কলেজের স্যাররা সহ সবাই বলল আবার পরিক্ষা দেওয়ার জন্য। কিন্তু একমাত্র আমার গুরু রানা স্যার বলল তুই বিশ্ববিদ্যালয়ে ভর্তি পরীক্ষা দে। বায়োলজিক্যাল ইউনিটে পরিক্ষা দিবি। তোর নিশ্চিত চান্স হবে। চান্স পাওয়ার জন্য কখনো এ+ বা গোল্ডেন এ+ লাগে না। আল্লাহর রহমতে বরিশাল বিশ্ববিদ্যালয় এবং যশোর বিজ্ঞান ও প্রযুক্তি বিশ্ববিদ্যালয়ে চান্স হলো। 

চান্স পাওয়ার পর পড়লাম আরেক বিপদে। মায়ের মেরুদন্ডের Spinal Cord Injury (SCI) সমস্যা ধরা পড়লো। রাজশাহী মেডিকেল কলেজের নিউরোমেডিসিনের ডাক্তার আহমাদ বললেন উপায় দুইটা এক অপারেশন যা অনেক টাকার দরকার। সফল হওয়ার সম্ভাবনা ১০ শতাংশ আর বিফল হলে লাইফ টাইম প্যারালাইজড। বিকল্প পন্থা হলো, যতদিন বাঁচবে ঔষধ খেয়ে বাঁচতে হবে। সপ্তাহে ১৩০০/= টাকার ঔষধ। বাবার সাথে আলাপ করে বিকল্প টাই বেছে নিলাম। কারণ বাবার অবস্থাও ভালো না। সারাজীবন হাড়ভাঙা পরিশ্রম  করেছেন। ২০১৩ সালে ভ্যান চালানো বাদ দিয়ে আকাবা নারসারিতে ৭০০০/= বেতনে কাজ শুরু করেন। যা আমার বিভাগীয় শিক্ষক শ্রদ্ধেয় তানভীর আহমেদ স্যার জানেন। উনি আকাবা নারসারিতে মাঝে মাঝেই যেতেন। 

একদিকে আমার ক্যাম্পাস অন্যদিকে পরিবার এবং মায়ের মেডিসিনের খরচ। সব মিলায়ে আমি অন্ধকারে পতিত হলাম। যখন কি করব কিছুই বুঝে উঠতে পারছিলাম না তখন মাথার উপরে ছায়া হিসাবে পেলাম বিভাগীয় শিক্ষক ড. মো. আশরাফুজ্জামান জাহিদ স্যারকে। যিনি বুদ্ধি দিলেন, সাহস দিলেন, পাশাপাশি সামনে অগ্রসর হতে পথ দেখালেন। তার কাছ থেকেই শিখলাম কিভাবে সমস্যা মোকাবিলা করে সামনে আগাতে হয়। ক্যাম্পাস জীবনে এবং ক্যাম্পাসের বাইরে সব খানে স্যারকে পাশে পেয়েছি।

এছাড়াও ডিপার্টমেন্টের সকল স্যার এবং ম্যামদের সহযোগিতা পেয়েছি। বিশেষ করে পেয়েছি তানভীর আহমেদ স্যার এবং রাজিব কান্তি রায় স্যারকে। তানভীর স্যারের কাছ থেকে মায়ের চিকিৎসার ব্যাপারে বহু সাহায্য সহযোগিতা ও পরামর্শ পেয়েছি। আর রাজিব স্যার তো সবসময় আমার স্কুল আর কোচিংয়ের ব্যাপারে খোঁজ-খবর নিয়েছেন। আমার মায়ের খোঁজ-খবর নিয়েছেন। অসম্ভব সরল ও সুন্দর মনের মানুষ তিনি। রাজিব স্যার বলতেন, সাজ্জাদ কষ্টের দিন একদিন কেটে যাবে ভাই, সুখের দিন একদিন আসবেই। আর আরেকজনের কথা না বললেই নয় তিনি হলেন আমার থিসিস সুপারভাইজার ফাতেমা তুজ জোহরা ম্যাম। তিনি আমার থিসিস সহ বিভিন্ন বিষয়ে দিক নির্দেশনা দিয়ে সহায়তা করেছেন ম্যাম।

জাহিদ স্যারের সহযোগিতায় হলে ঠাঁয় হলো বিশ্ববিদ্যালয়ের শহীদ মসিয়ূর রহমান হলের ২১৫ নং রুমে। রুমমেট হিসেবে বন্ধু নাসরুল অনেক হেল্প করেছে। ২১৫ নং রুমে আরেকজন নিভৃতচারি মানুষ ছিলেন, যাকে আমার জীবনে বড় ভাই হিসাবে এবং গাইড হিসেবে পেয়েছি তিনি শুভাশিস দাস শুভ (স্যার)। দাদা শিখিয়েছেন কিভাবে লাইফে ব্যালেন্স করে চলতে হয়। কুষ্টিয়া – যশোর, যশোর – কুষ্টিয়া ৫ টা বছর হাড়ভাংগা পরিশ্রম গেছে আমার। কিন্তু কসম শখ করে করিনি। পেটের দায়ে। সবার সহযোগিতায় শেষমেশ অনার্স এবং মাস্টার্স শেষ করি। 

এরপর, টিউশনি ও সরকারী চাকরির পরীক্ষা পাশাপাশি চলতে থাকলো। কিছু মানুষ আমার টিউশনি করানো পছন্দ করত না। কিন্তু টিউশনি বাধ্য হয়েই করাতাম। কারন মানুষ উপদেশ দেয়, কিন্তু উপদেশে পেট ভরে না। আর সত্য হল এই যে, টিউশনি করিয়েই আমি মায়ের চিকিৎসা করাচ্ছি, ছোট দুই বোনের বিয়ে দিয়েছি, বাড়ি করেছি, মাঠে জমি করেছি, একটা বাইক ও কিনেছি। আরও সত্য হলো আমি যে কয়টা সরকারি চাকরি তে প্রিলি, রিটেন টিকেছি এই টিউশনি করিয়েই টিকেছি। কিন্তু ভাগ্য খারাপ এখনো সরকারি চাকরি ধরা দেয়নি।

এদিকে বয়স শেষ হয়ে যাচ্ছে, আবার এলাকায় মানুষ বাঁকা কথা বলে। আর কতকাল টিউশনি করাব? তাই শেষমেষ সিদ্ধান্ত নিলাম চাকরিতে ঢুকবো। সিভি দিলাম ক্যাম্পাসের ছায়া ড. মো. আশরাফুজ্জামান জাহিদ স্যারকে। শুধু বললাম, স্যার অমুক জায়গায় আপনার রিকমেন্ডেশন লাগবে, আমি জব করবো। ব্যাস, রিকমেন্ডেড। আমি এখন জব করছি। পাশাপাশি সরকারি চাকরিরও চেষ্টা অব্যাহত রেখেছি। 

রানা স্যার বলতেন, পরিশ্রম করবি, হালাল খাবি; অন্যায়ের সাথে আপস করবি না, দেখবি শত ষড়যন্ত্রও তোকে টলাতে পারবে না। তাই, জীবনে একাডেমিক শিক্ষকের বাইরেও এমন কিছু শিক্ষক দরকার; যারা বাস্তব জীবনে সকল বাস্তবতায় আপনাকে পথ দেখাবে।

সাজ্জাদ হোসাইন, সাবেক শিক্ষার্থী, পুষ্টি ও খাদ্য প্রযুক্তি বিভাগ, যশোর বিজ্ঞান ও প্রযুক্তি বিশ্ববিদ্যালয়।

মেসেঞ্জার/দিশা