ছবি: ডেইলি মেসেঞ্জার
বর্তমান জমানায় সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমের গুরুত্বকে অস্বীকার করার কোনো সুযোগ নেই। বিজ্ঞানের যেমন অভিশাপ রয়েছে ঠিক তেমনিভাবে সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমের বিশেষ করে ফেসবুকের মাধ্যমে ছড়িয়ে পড়া অতিকথন, ভুল কথন, মিথ্যা তথ্য, প্রোপাগান্ডা ইত্যাদির মাধ্যমে একটি সহজ বিষয়কে নিমিষেই জটিল ও দুর্ভেদ্য করে তোলা যায়। আবার বিপরীত দিকে দেখা যায় সামাজিক আন্দোলনের ক্ষেত্রেও ফেসবুক ব্যবহৃত হচ্ছে এবং একটি ইতিবাচক পরিবর্তনের ধারাও লক্ষ্য করা যাচ্ছে। ড. ইউনূসকে নিয়ে নতুন করে বলার কিছু নেই। তিনি একজন সম্মানিত মানুষ এবং বাংলাদেশের একমাত্র নোবেলবিদ। এই বিষয়ে কোনরূপ সন্দেহ নেই কিন্তু তাঁর এই পরিচয়কে কাজে লাগিয়ে সকল ধরনের আইনগত বিষয়কে মোকাবেলা করার কোনরূপ সুযোগ নেই। ক্লাসিক্যাল ক্রিমিনোলজির অন্যতম একটি প্রধান মূলনীতি হচ্ছে আইনের দৃষ্টিতে সকলেই সমান এবং বিচারক অপরাধের মাত্রা ও তীব্রতাকে বিবেচনায় নিয়ে আইনি কাঠামো অনুসরণ করেই বিচারের রায় প্রদান করেন। ড. ইউনূসের বিষয়ে বেশ কিছু বিষয়াদি বিচারাধীন রয়েছে এবং কিছু কিছু মামলার রায়ও হয়েছে। কর ফাঁকির মামলায় তিনি ইত্যবসরে কর আদায় করতে বাধ্য হয়েছেন। শ্রম আদালতের মামলার ক্ষেত্রেও রায় হয়েছে। এদিকে ফেসবুকে অনেকেই এ বিষয়গুলোকে নিয়ে মায়াকান্না শুরু করে দিয়েছে।
ড. ইউনূসের বিচারাধীন মামলা স্থগিত করতে বিশ্বনেতাদের চিঠির বিষয়েও সতর্ক করার চেষ্টা করেছে। তারা একটিবারের জন্যও চিন্তা করছে না আমাদের দেশের বিচার ব্যবস্থার উপর হস্তক্ষেপের মানে হচ্ছে দেশের সার্বভৌমত্বের উপর হামলা কিংবা হুমকির শামিল। কিন্তু বাংলাদেশের সরকার অত্যন্ত সাহসিকতার সঙ্গে দেশের চলমান বিচার ব্যবস্থার উপর বিদেশীদের ভরসা রাখার আহবান জানিয়েছে। ইতিপূর্বে যুদ্ধাপরাধীদের বিচার বন্ধেও বিদেশীদের কাছ থেকে টেলিফোন এসেছিল। একটা গোষ্ঠীই রয়েছে যারা বাংলাদেশের বিচারকাজকে প্রশ্নবিদ্ধ করতে উঁৎপেতে থাকে। না হলে বাংলাদেশের চলমান আইনে বিচারকাজকে প্রশ্নবিদ্ধ করতে তাদের এত মাথাব্যথা কেন? এখন ওদের সঙ্গে যুক্ত হয়েছে বাংলাদেশের কিছু সোস্যাশ মিডিয়ার ব্যবহারকারী। তারা বিভিন্নভাবে ড. ইউনূসের পক্ষে সাফাই গাইছে। তারা আদতে জানে না কিংবা জানতেও চাই না প্রকৃতঅর্থে ড. ইউনূসের বিরুদ্ধে কি কি ধরনের অভিযোগ রয়েছে। প্রকৃত সত্য না জেনে, সত্য উদঘাটন না করেই অতিমাত্রায় আবেগ প্রদর্শিত হচ্ছে সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমে। অথচ মামলাগুলোতে উভয় পক্ষের জন্য সমান সুযোগ রয়েছে। তদুপরি বিচার কাজকে ভিন্ন খাতে প্রবাহিত করবার তাড়না থেকেই ফেসবুকে মায়াকান্না জুড়ে দিয়েছে একটি গোষ্ঠী।
সংবাদে জানা যায়, গ্রামীণ টেলিকমের ২৬ বছরের কার্যক্রম চলাকালে প্রায় এক হাজার কোটি টাকার কর ফাঁকি দেওয়ার অভিযোগ আছে। এই দীর্ঘ সময়ে ড. মুহাম্মদ ইউনূস প্রতিবছর ১৫ থেকে ২৫ শতাংশ পর্যন্ত কর ফাঁকি দিয়েছেন এমন অভিযোগও আছে। ১৯৯৭ থেকে ২০০৫ সাল পর্যন্ত প্রতিবছর গ্রামীণ টেলিকমে ড. ইউনূস ২৫ শতাংশ কর ফাঁকি দেন। ওই সময় কর ছিল ৩৫ শতাংশ, দিয়েছেন মাত্র ১০ শতাংশ। ২০০৬ থেকে ২০০৮ সাল পর্যন্ত এই প্রতিষ্ঠানে ড. ইউনূস কর ফাঁকি দেন বছরে ২০ শতাংশ। ওই সময়ে কর ছিল ৩৫ শতাংশ, দিয়েছেন মাত্র ১৫ শতাংশ। ২০০৯ থেকে ২০২২ সাল পর্যন্ত ড. ইউনূস নিয়ন্ত্রিত গ্রামীণ টেলিকমে প্রতিবছর ১৫ শতাংশ কর ফাঁকি দেওয়া হয়েছে। ওই সময়ের মধ্যে কর ছিল ৩৫ শতাংশ, আর প্রদান করেছিলেন মাত্র ২০ শতাংশ।
ড. মুহাম্মদ ইউনূসের ট্যাক্স ফাইল বিশ্লেষণে উঠে এসেছে ২০০৩ সালের পর তিনি তাঁর ট্যাক্স ফাইলে ২০০৫-০৬ কর বছরে মোট ৯৭ কোটি চার লাখ ৬১ হাজার ১৯১ টাকা রেমিট্যান্স পাওয়ার কথা উল্লেখ করেছেন। কিন্তু ওই সময় তাঁর ব্যক্তিগত সাউথ ইস্ট ব্যাংকের অ্যাকাউন্টে রেমিট্যান্স পাওয়ার পরিমাণ ১১৫ কোটি ৯৮ লাখ ৯৬ হাজার ২৪ টাকা। অর্থাৎ ওই সময় তিনি ১৮ কোটি ৯৪ লাখ ৩৪ হাজার ৮৩৫ টাকার রেমিট্যান্স পাওয়ার তথ্য কর ফাঁকি দেওয়ার লক্ষ্যে তাঁর ব্যক্তিগত ট্যাক্স ফাইলে গোপন করেছেন।
সরকারকে কর ফাঁকি দেওয়ার লক্ষ্যে বিভিন্ন কর বছরে ড. ইউনূস ব্যক্তিগত ট্যাক্স ফাইলে নিজস্ব সাউথ ইস্ট ব্যাংকে প্রাপ্ত বিপুল পরিমাণ রেমিট্যান্সের তথ্য গোপন করেছেন। ২০০৭-০৮ অর্থবছরে তিনি রেমিট্যান্স পেয়েছেন ১৫ কোটি ১১ লাখ ৩১ হাজার ৪৭ টাকা। কিন্তু তিনি তাঁর ট্যাক্স ফাইলে প্রদর্শন করেছেন ৯ কোটি ১৪ লাখ ৫৮ হাজার ৪৮৯ টাকা। ব্যক্তিগত অ্যাকাউন্ট এবং ট্যাক্স বা কর ফাইলের সঙ্গে এখানে পার্থক্য রয়েছে পাঁচ কোটি ৯৬ লাখ ৭২ হাজার ৫৫৯ টাকা। ২০০০ সালের পর থেকে এমন প্রতিটি কর বছরে ড. মুহাম্মদ ইউনূস বিদেশ থেকে রেমিট্যান্স প্রাপ্ত হয়ে কোটি কোটি টাকার তথ্য গোপন করে সরকারের কর ফাঁকি দিয়েছেন। ২০০৫-০৬ কর বছর থেকে শুরু করে ২০২২-২৩ কর বছর পর্যন্ত সরকারকে কর ফাঁকি দেওয়ার লক্ষ্যে তিনি ১৮ কোটি ৯৪ লাখ ৩৪ হাজার ৮৩৫ টাকা রেমিট্যান্সের তথ্য গোপন করেন।
গ্রামীণ ব্যাংকের প্রতিষ্ঠালগ্ন থেকে ২০১০ সাল পর্যন্ত ব্যাংকটির এমডি হিসেবে দায়িত্বপালন করেছেন ড. মুহাম্মদ ইউনূস। অথচ এখন তার নিয়ন্ত্রণে রয়েছেন গ্রামীণ নামধারী প্রায় ৫০টি প্রতিষ্ঠান। এসব প্রতিষ্ঠানের আর্থিক সম্পদের পরিমান দশ হাজার কোটি টাকারও বেশি। পরিচালনা পর্ষদের গঠনতন্ত্র অনুযায়ী গ্রামীণ ব্যাংকের অংশীদারিত্ব ভিত্তিতে মূলধনের বন্টন অন্যান্য প্রতিষ্ঠানে হয়নি। যাদের জন্য ব্যাংক প্রতিষ্ঠিত তারাই মূলত উন্নয়নের বাইরে রয়ে গেলেন এবং এককভাবে একজন মালিক হয়ে উঠার কল্পকাহিনী কোনভাবেই গঠনতন্ত্রের কার্যাপ্রণালীতে সমর্থনযোগ্য নয়। অথচ ড. ইউনূস বার বার বলেন গ্রামীণ ব্যাংকের মালিক হলো সকল ঋণগ্রহীতা। তাহলে সেই ঋণ গ্রহীতাদের ন্যায্য পাওনা নিশ্চিতভাবেই বঞ্চিত করা হয়েছে এবং তাদের অর্থনৈতিক ও সামাজিক অবস্থান অধিকাংশেরই সুখকর নয়। ভিটে মাটি বিক্রি করে গ্রামীণ ব্যাংকের ঋণ পরিশোধের অহরহ নজির রয়েছে বাংলাদেশে।
ড. ইউনূস সাহেব রাজনীতিতে প্রতিষ্ঠা পেতে সর্ব রকমের চেষ্টা করেন। ২০০৬ সালে নোবেল বিজয়ের ৫ মাসের মধ্যেই ১/১১ এর রাজনৈতিক সংকটে তিনি নাগরিক শক্তি নামে একটি রাজনৈতিক দল গঠন করেন। যেখানে একজন নোবেলবিদ হিসেবে অন্য দেশের ব্যক্তিগত ক্রাইসিস ম্যানেজার হিসেবে কাজ করেন, উল্টো তিনি সংকটকে আরও তীব্রতর করতে কাজ করেছেন। জনগণের সাথে কোন রকমের যোগাযোগ ব্যতিরেকে তিনি জনগণের নেতা হিসেবে আবির্ভূত হতে চেয়েছেন, কিন্তু জনগণ তাকে প্রত্যাখান করেছে। ২০০৭ সালে ১/১১ সময়ে সেনা সমর্থিত সরকার ও পরাশক্তিধর দেশের প্রেসক্রিপশন ছিল মাইনাস-টু-নীতি, যাতে শেখ হাসিনা ও খালেদা জিয়াকে বাহিরে রেখে সামরিক সরকারের অধীনে কিংবা ড. ইউনূসকে রাষ্ট্র ক্ষমতায় রেখে তাদের স্বার্থ হাসিল করতে পারে সে মনোবাসনায় উজ্জীবিত হওয়ার আকাঙ্খা থেকেই মাইনাস টু ফর্মুলা বাস্তবায়নের উদ্যোগ গ্রহণ করা হয়। আর তাতে সাড়া দেন বাংলাদেশের একমাত্র নোবেলবিদ ড. ইউনূস।
এটি স্বত:সিদ্ধ যে বাংলাদেশের কোন দুর্যোগে ড. ইউনূস কিংবা তাঁর প্রতিষ্ঠানকে বাংলাদেশের মানুষ পাশে পাইনি। কোভিড-১৯, ইউক্রেন যুদ্ধ, দেশে বিরাজমান রাজনৈতিক অস্থিরতা, বৈদেশিক বন্ধুদের প্রভাব, হরতাল অবরোধের ক্ষয়ক্ষতি ইত্যাদি সংক্রান্তে কোন কাজে তাঁকে সহযোগিতা করতে পাওয়া যায়নি। উল্টো এসব সমস্যাকে জিইয়ে রেখে বাংলাদেশকে চাপে ফেলার রাজনীতিতে তাঁর সংযুক্ততার বিষয়ে অনেক রাজনীতিবিদ অভিযোগ করে থাকেন। প্রকৃতঅর্থেই তিনি‘রোহিঙ্গা’ সমস্যা, কোভিড-১৯ ও চলমান ইউক্রেন যুদ্ধের জন্য বাঙালিকে কোনো ধরনের সহায়তা বা পরামর্শ দিয়েছেন? স্বীকৃত যে, ড. মুহাম্মদ ইউনূস একজন জ্ঞানী-গুণী ক্ষমতাধর আন্তর্জাতিক ব্যক্তিত্ব। উল্টো বাংলাদেশের বিচার বিভাগ নিয়ে প্রশ্ন, বিদেশীদের দিয়ে বিচারকাজকে হস্তক্ষেপ করার দায়ভার থেকে তিনি বের হতে পারবেন কি? সবশেষ, গ্রামীণ ব্যাংকের প্রতিষ্ঠাতা ও নোবেলজয়ী অর্থনীতিবিদ ড. মোহাম্মদ ইউনূসকে ১১৯ কোটি টাকা কর পরিশোধের নির্দেশ দিয়েছেন হাইকোর্ট। ২০১১ সাল থেকে পরবর্তী ৫ পাঁচ বছরের জন্য তাকে এই অর্থ পরিশোধ করতে হবে। কাজেই ফেসবুক বোদ্ধাদের এ সকল বিষয়ে সর্বোচ্চ জেনে বুঝে উদ্ধারকারী হিসেবে আবির্ভূত হওয়া উচিত। তা না হলে সমাজের আস্তাকুঁড়ে তাদের নিক্ষেপ হতে হবে।
লেখক: সহকারী অধ্যাপক ও চেয়ারম্যান, ক্রিমিনোলজি এন্ড পুলিশ সায়েন্স বিভাগ, চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয়।
মেসেঞ্জার/হাওলাদার