ঢাকা,  শনিবার
২১ ডিসেম্বর ২০২৪

The Daily Messenger

বাংলাদেশের প্রথম সরকার : দৃপ্ত শপথে বলীয়ান

প্রকাশিত: ১৮:০০, ১০ এপ্রিল ২০২৪

আপডেট: ১৮:১৩, ১০ এপ্রিল ২০২৪

বাংলাদেশের প্রথম সরকার : দৃপ্ত শপথে বলীয়ান

ছবি : মেসেঞ্জার

১৯৭১ সালের ২৫ মার্চ রাতে ঘুমন্ত নিরীহ বাঙালি জনতার উপরে সাঁড়াশি আক্রমণের মধ্য দিয়ে পাকিস্তানের পোড়ামটি নীতির বাস্তবায়ন শুরু হয়। এরই প্রেক্ষিতে ২৬ মার্চ প্রথম প্রহরে বঙ্গবন্ধু বাঙালির স্বাধীন রাষ্ট্রের আকাঙ্ক্ষা বাস্তবে রূপ দিতে ঘোষণা দেন “আজ থেকে বাংলাদেশ স্বাধীন। 

রাতের আধারে আচমকা এমন গণহত্যাযজ্ঞে সমগ্র বাঙালি কিংকর্তব্যবিমূঢ় হয়ে পড়েন। বিভিন্ন জায়গা থেকে বেছে বেছে রাজনৈতিক নেতা, সাংবাদিক, বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষক সহ ছাত্র-জনতার উপরে হত্যাযজ্ঞ চালায় ইয়াহইয়া ও জুলফিকার আলী ভুট্টোর নেতৃত্বাধীন পাকিস্তানি সামরিক বাহিনী। গ্রেপ্তার করা হয় বাঙালির অবিসংবাদিত নেতা, পাকিস্তানের তৎকালীন সংখ্যাগরিষ্ঠ দলের নেতা বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানকে। সহস্র সাধারণ জনগণ গণহত্যা এড়াতে ভারতে আশ্রয় নেন। তৎকালীন প্রধানমন্ত্রী ইন্দিরা গান্ধীর নেতৃত্বে ভারতের সরকার ও জনগণ সেসময়ে এদেশের জনগণকে আশ্রয় দিয়ে মানবতার এক উজ্জ্বল দৃষ্টান্ত স্থাপন করেছেন। নেতৃত্বশূন্য এমন অবস্থায় গণহত্যা এড়াতে ও পরবর্তী কৌশল ঠিক করতে আওয়ামী লীগসহ বিভিন্ন রাজনৈতিক দলের নেতারা প্রতিবেশী ভারতে আশ্রয় নেন। তাজউদ্দিন আহমেদ সহ কতিপয় রাজনৈতিক নেতা ভারত সরকারের সাথে যোগাযোগ স্থাপনের চেষ্টা করেন এবং মুক্তিযুদ্ধ পরিচালনায় ভারতের হস্তক্ষেপ ও সহযোগিতা কামনা করেন। 

বঙ্গবন্ধু ব্যতিরেকে অন্য কোনো নেতাই বাংলাদেশের রাজনৈতিক পরিমণ্ডলের বাইরে পরিচিত ছিলেন না। তাজউদ্দীন আহমদ যদিও আওয়ামী লীগের তৎকালীন সাধারণ সম্পাদক ছিলেন তথাপিও প্রতিবেশী ভারতের রাজনৈতিক পরিমণ্ডলে তাঁর পরিচয় নিশ্চিত করার জন্য অর্থনীতিবিদ রেহমান সোবহানকে প্রয়োজন পড়েছিল। বঙ্গবন্ধুর রাজনৈতিক ব্যক্তিত্ব তাঁর সহকর্মী সকলকে ছায়ায় ঢেকে দিয়েছিল। তাজউদ্দিন আহমদ শুরুতেই ভারতের সমর্থন আদায়ে কিছুটা চ্যালেঞ্জের সম্মুখীন হন। ভারতের অর্থনৈতিক বাস্তবতায় ভিন্ন একটি দেশের যুদ্ধে নিজেকে জড়িয়ে ফেলার মত অবস্থা ছিল না। প্রধানমন্ত্রী হিসেবে ইন্দিরা গান্ধী বা তাঁর মত ক্যারিশম্যাটিক কেউ ক্ষমতায় না থাকলে হয়ত বাংলাদেশের পক্ষে যুদ্ধের ফলটা এভাবে আসত না। ভারত সরকারের পক্ষ থেকে যখন জানানো হয় যে যুদ্ধে সমর্থন ও সহযোগিতার জন্য নিয়মতান্ত্রিক সরকার গঠন করলে ভারতের পক্ষ থেকে কাজ করা সহজ হবে। ইন্দিরা গান্ধীর সাথে আলোচনার পরে আওয়ামী লীগের এমএনএ ও এমপিএ দের সমন্বয়ে কুষ্টিয়া জেলার সীমান্তে একটি সভা আহবান করেন এবং সকলের পরামর্শের ভিত্তিতে তাজউদ্দিন আহমদ বাংলাদেশ সরকার গঠনের উদ্যোগ নেন। এই এমএনএ ও এমপিএ গণ সকলেই ১৯৭০ সালের সাধারণ নির্বাচনে জয়ী হয়েছেন। স্বাভাবিক সময় থাকলে ওনারাই পাকিস্তানের সরকার গঠন করতেন। এই অধিবেশনেই বাংলাদেশ সরকারের মন্ত্রীসভা গঠিত হয়। 

ইতোমধ্যে ভারতের প্রধানমন্ত্রী ইন্দিরা গান্ধীর সাথে সাক্ষাতে বঙ্গবন্ধুর নির্দেশে ২৬ মার্চই বাংলাদেশ স্বাধীন হয়েছে এবং গণপরিষদ ও জাতীয় পরিষদের নির্বাচিত প্রতিনিধিদের সমন্বয়ে সরকার গঠনের বিষয়টি জানান। তাজউদ্দিন আহমদের সাথে এইসময়গুলোতে ব্যরিস্টার আমিরুল ইসলাম ছিলেন। এভাবেই বাংলাদেশের প্রবাসী সরকারের যাত্রা শুরু হয়। প্রবাসী বাংলাদেশ সরকারের মূল লক্ষ্য ছিল বাংলাদেশের পক্ষে বহির্বিশ্বের সমর্থন আদায় করা, মুক্তিযুদ্ধে অংশ নিতে আগ্রহী তরুণদের যুদ্ধের প্রশিক্ষণ ও অস্ত্র সরবরাহ করা, বাংলাদেশ থেকে শরণার্থী হয়ে আশ্রয় নেওয়া জনগণকে ত্রাণ ও চিকিৎসা সহায়তা সমন্বয় করা। আজউদ্দিন আহমদ ভারত সরকারের সর্বত্র বাংলাদেশের মানুষের মুক্তিকামী মনোভাব পৌঁছে দিয়েছেন। বাংলাদেশের জনগণ নিজেরাই যুদ্ধ করে দেশকে স্বাধীন করতে পারবে বলে যে দৃঢ় মনোভাব পোষণ করে তা উপলব্ধি করেই ভারত সরকার বাংলাদেশের যুবক-তরুণদের সামরিক প্রশিক্ষণ ও অস্ত্র প্রদানের বিষয়টি গুরুত্ব সহকারে বিবেচনায় নেয়। 

পাকিস্তানী সেনাবাহিনীর গণহত্যাযজ্ঞ শুরু হওয়ার মাত্র দুই সপ্তাহের মাথায় বাংলাদেশ সরকার গঠন করে মুক্তিযুদ্ধের সকল ফ্রন্ট সমন্বয়ের সিদ্ধান্ত নিঃসন্দেহে পাকিস্তানি সেনাবাহিনীর প্রতি একটি চটোপাঘাত এবং বিশ্ব দরবারে বাঙালির মুক্তির আকাঙ্ক্ষার প্রতিফলন। ১০ এপ্রিল বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানকে প্রেসিডেন্ট হিসেবে রেখে সৈয়দ নজরুল ইসলামকে অস্থায়ী রাষ্টপতি, তাজউদ্দীন আহমদকে প্রধানমন্ত্রী, ক্যাপ্টেন এম মনসুর আলীকে অর্থমন্ত্রী, খন্দকার মোশতাককে পররাষ্ট্র, আইন ও সংসদ বিষয়ক মন্ত্রী, এ এইচ এম কামারুজ্জামানকে স্বরাষ্ট্র, ত্রাণ ও কৃষি বিষয়ক মন্ত্রণালয়ের দায়িত্ব দিয়ে গণপ্রজাতন্ত্রী বাংলাদেশের সরকার গঠন করা হয়। এই গণপ্রজাতন্ত্রের সর্বাধিনায়ক হিসেবে বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানকে ঘোষণা করা হয়। 

১০ এপ্রিল স্বাধীন বাংলাদেশের একটি ঘোষণাপত্র পাঠ করেন অধ্যাপক এম ইউসুফ আলী। এটিতে বাংলাদেশের মহান স্বাধীনতা আন্দোলনের পেছনের ঐতিহাসিক সংগ্রামের বর্ণনা ও যৌক্তিকতা প্রমাণ করা হয় এবং ভবিষ্যতে বাংলাদেশ বিশ্বের বুকে একটি শান্তিকামী, নিয়মতান্ত্রিক, ন্যায়বোধসম্পন্ন জাতিরাষ্ট্রের আকাঙ্ক্ষা প্রকাশ করা হয়। এই ঘোষনাপত্রে মুক্তিযুদ্ধে বাংলাদেশের করণীয় সম্পর্কে নির্দেশনা দেওয়া হয়। এই ঘোষণাটি বাংলাদেশের মুক্তিকামী মানুষের নিকটে একটি গুরুত্বপূর্ণ নির্দেশনা হিসেবে এসেছিল। প্রকৃতপক্ষে বাংলাদেশের মুক্তিযুদ্ধ ছিল একটি জনযুদ্ধ। বাংলাদেশের স্বাধীনতার আকাঙ্ক্ষা বাস্তবায়নের জন্য কোনো গেরিলা বা সামরিক নীতি বা পথ পরিক্রমা ছিল না। ছিল না কোনো প্রশিক্ষিত বাহিনী। মাত্র এক দুমাসের প্রশিক্ষণে সাধারণ খেটে খাওয়া শ্রমিক, কৃষক, বিশ্ববিদ্যালয়/ কলেজের ছাত্র-শিক্ষক, রাজনৈতিক কর্মী, গৃহিনী সকলেই হয়ে উঠেছেন পাকা যোদ্ধা। এই স্বল্প প্রশিক্ষিত মুক্তিবাহিনী দীর্ঘ নয় মাস যুদ্ধ করে বিশ্বের অন্যতম শক্তিশালী পাকিস্তানি সেনাদের ঘুম হারাম করে দিয়েছে। 

প্রথম বাংলাদেশ সরকারের অন্যতম সফল উদ্যোগ ছিল বহির্বিশ্বে বাংলাদেশের পক্ষে প্রচারনা ও সমর্থন আদায়। বাংলাদেশের পক্ষে আবু সাঈদ চৌধুরী, ব্যারিস্টার আমিরুল ইসলাম, রেহমান সোবহানসহ প্রবাসী বাংলাদেশিরা এক্ষেত্রে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করেছেন। পাশ্চাত্যের সরকারগুলো পাকিস্তানের পক্ষাবলম্বন করলেও বাংলাদেশ সরকারের পক্ষ থেকে ওসব দেশগুলোর জনগণের নিকটে পৌছানোর কৌশল বাংলাদেশের জন্য বহির্বিশ্বের জনগণের সহানুভূতি আদায়ে তাৎপর্যপূর্ণ ভূমিকা রেখেছে। 

বাংলাদেশের জাতির জনক বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানকে গ্রেফতার বা বন্দি করতে পারলে এদেশের মানুষের মুক্তির আকাঙ্ক্ষা স্তিমিত হয়ে যাবে এমনটাই আশা করেছিল পাকিস্তানি কর্তৃপক্ষ। কিন্তু যুগ যুগ ধরে গড়ে ওঠা বঙ্গবন্ধুর রাজনৈতিক সহচররা পাকিস্তানি কর্তৃপক্ষের এমন স্বপ্নকে দুরাশায় পরিণত করেছিল খুব দ্রুতই স্বাধীন বাংলাদেশ সরকার গঠন করে। পরবর্তীতে স্বাধীনতা যুদ্ধচলাকালীন কর্মকাণ্ড সমন্বয় করে এই সরকার। বাংলাদেশের মানুষকে নেতৃত্বশূন্যতার দিকে ঠেলে দেওয়ার পাকিস্তানি লক্ষকে ধুলিস্যাৎ করে দেয় বাংলাদেশের প্রথম সরকার গঠন এবং পরবর্তীতে উক্ত সরকারের কর্মকাণ্ড। বাঙালি লড়ে যায় স্বাধীনতার দৃপ্ত শপথে বলীয়ান হয়ে। 

লেখকঃ প্রভাষক ও পরিচালক (অতিঃ দাঃ), বিডিইউ ক্যারিয়ার সেন্টার, বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান ডিজিটাল ইউনিভার্সিটি, বাংলাদেশ 

মেসেঞ্জার/সজিব