ছবি : ডেইলি মেসেঞ্জার
আপনি ইতিহাসের নিবিষ্ট পাঠক, পৌরাণিক চরিত্রগুলো আপনাকে বেলা-অবেলায় হাতছানি দিয়ে ডাকে। লোকায়ত বাংলার ভাগ্য বিড়ম্বিত চরিত্র বেহুলা আপনাকে মোহগ্রস্ত করে। সেই মোহে আপনি বেহুলার স্মৃতি বিজড়িত বগুড়ার গোকুল গ্রামে বেহুলার পদচিহ্ন অনুসরণ করতে গিয়ে দেখলেন, আবর্জনা বোঝাই পচা, গলা, দুর্গন্ধযুক্ত করতোয়া নদী আপনার জন্য অপেক্ষা করছে। কিংবা বাংলার প্রত্যন্ত জনপদের মাটি মানুষের জীবন-জীবিকা, সংগ্রাম, আন্দোলন আপনাকে আন্দোলিত করে। আখতারুজ্জামান ইলিয়াস কথিত কাৎলাহার বিল ও সন্নিহিত জনপদের মানুষের জীবনযাত্রা অবলোকনের জন্য আপনি ঢাকা থেকে বগুড়ায় পদার্পণ করতে চাচ্ছেন ; তাহলে মনে রাখবেন শহরের প্রবেশমুখে বনানীতে নিশ্চিতভাবে জমে থাকা আবর্জনার স্তূপ আপনাকে স্বাগত জানাবে।
উত্তরবঙ্গের প্রবেশদ্বার খ্যাত বগুড়া শহর মৌর্য, গুপ্ত, পাল, সেন এবং সুলতানি শাসনের উত্তরাধিকার বহন করে চলেছে। প্রাচীন বাংলার রাজধানী এই শহর। সার্কের সাংস্কৃতিক রাজধানীও এই শহর। বর্তমানে উত্তর, দক্ষিণ, পূর্ব, পশ্চিম যে কোনো প্রান্ত থেকে এই শহরে প্রবেশ করতে চাইলে আপনাকে কোনো রাজবংশের ঐতিহ্য নয়; মুখোমুখি হতে হবে সড়কের মোড়ে মোড়ে জমে থাকা মিউনিসিপ্যাল বর্জ্যের। অভ্যর্থনা জানাবে পুন্যবত নদী করতোয়ার কালো দূষিত দুর্গন্ধযুক্ত পানির আবহ এবং পৌরসভার সীমানা জুড়ে ছড়িয়ে থাকা ইটভাটাগুলোর ভয়াবহ দূষণ। অবস্থাদৃষ্টে মনে হতে পারে এখানে আদৌ কোনো নগর কর্তৃপক্ষ কাজ করে কিনা। মনে প্রশ্ন জাগতে পারে বগুড়া কি ক্রমে আবর্জনার নগরীতে পরিণত হতে চলেছে?
নগর হিসেবে বগুড়ার গোড়াপত্তনের ক্ষেত্রে করতোয়া নদীর একটি গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা রয়েছে। এই নদীর তীরে প্রাচীন নগরী পূন্ড্রবর্ধনের অবস্থান। মৌর্য, গুপ্ত, পাল ও সেন রাজন্যবর্গ করতোয়ার প্রবাহকে লক্ষ্য করে তাদের সমর কৌশল রচনা করেছেন , দুর্গপ্রাকারের ডিজাইন করেছেন এবং বহির্বিশ্বের সঙ্গে তাঁদের ব্যবসা বাণিজ্য পরিচালনা করেছেন। কিন্তূ বর্তমানে করতোয়ার সেই প্রমত্তা রূপ আর নেই। মানুষ বা পন্য পরিবহন দূরের কথা পলি বহনের মত ক্ষীনধারাও বর্তমানে নেই। যা আছে তা শুধুই আবর্জনা। শিবগঞ্জ থেকে প্রবেশ করে করতোয়া নদী বগুড়া পৌর এলাকার প্রায় মাঝ বরাবর উত্তর থেকে দক্ষিনে প্রবাহিত হয়েছে যা পৌর এলাকাকে পূর্ব ও পশ্চিমে প্রায় সমান দুটি অংশে বিভক্ত করেছে। শিবগঞ্জের রায়নগর থেকে বগুড়া পৌর এলাকায় প্রবেশের পর সামান্য দক্ষিণ-পূর্ব দিকে বাঁক নিয়ে লাহিড়ীপাড়ায় এসে আবার দক্ষিণ-পশ্চিমে বাঁক নিয়ে বগুড়া রংপুর মহাসড়কের পূর্ব পার্শ্ব দিয়ে গোকুলে পৌঁছেছে করতোয়া। এই পুরো প্রবাহ পথে নদীতে ক্ষীণ ধারার সঙ্গে কচুরিপানার আধিক্য চোখে পড়ে। কোথাও কোথাও নদীবক্ষে চাষাবাদ হতে দেখা যায়। এখানে মহাসড়ক সংলগ্ন ধাওয়াকোলা এলাকায় করতোয়া নদীতে শ্যালো ইঞ্জিন চালিত ড্রেজার দিয়ে মাঝে মাঝে বালু উত্তোলনের মত অবৈধ কর্মকাণ্ড চলতে দেখা যায়। গোকুল থেকে আরও দক্ষিণে সদরের নওদাপাড়া মৌজায় এসে নদীটি মম ইন ইকো পার্কের আগ্রাসনের শিকার হতে দেখা যায়। পার্কের হোটেল, রেস্টুরেন্ট ও দর্শনার্থীদের যাবতীয় ময়লা আবর্জনা এখানে নদীতে নিক্ষেপ করা হয়। আরো দক্ষিণ দিকে অগ্রসর হয়ে ৬ নং ওয়ার্ডের চেলো পাড়ার কাছে শহরের সবচেয়ে বড় কাঁচাবাজার ফতেহ আলী বাজার ও রাজাবাজার এর কাছে পৌঁছালে নদীবক্ষে যতদূর দৃষ্টিগোচর হয় শুধু মরা, পচা, গলা, দুর্গন্ধযুক্ত আবর্জনার স্তুপ চোখে পড়ে। এখানে দুই বাজারের যাবতীয় বর্জ্য, পশু জবাইয়ের বর্জ্য, আশেপাশের শৌচাগার, ড্রেন ও নালার সংযোগ নদীতে মিশে ভয়াবহ দূষণ ছড়াচ্ছে এবং নদী মশার প্রজনন ক্ষেত্রে পরিণত হয়েছে। এভাবে ক্রমাগত দক্ষিণে এগোতে থাকলে বৌবাজারের কাছে এসপি ব্রিজ হয়ে ১১ নং ওয়ার্ডের চক লোকমান সন্নিহিত বেজোড়া ব্রিজ পর্যন্ত পৌর এলাকার শেষ অবধি অর্থাৎ সাবগ্রাম পর্যন্ত করতোয়া নদী ক্রমশ ক্ষীণ থেকে ক্ষীনতর ধারায় পরিণত হয়েছে। পৌর এলাকায় করোতোয়া নদীর এই করুণ পরিণতির অন্যতম কারণ হচ্ছে অবৈধ দখল, দূষণ এবং নদীতে আবর্জনা নিক্ষেপের অপরিণামদর্শী প্রতিযোগিতা । এক্ষেত্রে নগর কর্তৃপক্ষের যেন তাকিয়ে দেখা ছাড়া অন্য কোন করণীয় নেই। বগুড়া সদরের দক্ষিণ-পশ্চিম দিয়ে প্রবাহিত করতোয়ার শাখা নদী ভাদাই বা ভদ্রাবতীর পরিণতিও করতোয়ার অনুরূপ। বনানীর কাছে সাজাপুরে এসে ভদ্রাবতী নদীও পচা, মজা, দুর্গন্ধযুক্ত আধারে পরিণত হয়েছে। উল্লেখ্য যে রিভার এন্ড ওয়াটার প্যারামিটার ২০১১-২০১৬” শীর্ষক গবেষণায় দ্রবীভূত অক্সিজেন(DO) এর ভিত্তিতে বাংলাদেশের সবচেয়ে দূষিত পাঁচটি নদীর একটি হিসেবে করতোয়া নদীর নাম উল্লেখ করা হয়েছে।
আধুনিক নগর ব্যবস্থাপনার অন্যতম নির্দেশক হচ্ছে সুষ্ঠু বর্জ্য ব্যবস্থাপনা। একটি নগরে প্রতিদিন উৎপাদিত গৃহস্থালী বর্জ্য, শিল্প বর্জ্য, ও চিকিৎসা বর্জ্যগুলি কি প্রক্রিয়ায় অপসারিত হচ্ছে অথবা আদৌ অপসারিত হচ্ছে কিনা তার উপর নির্ভর করে নগরের ভৌত পরিবেশ। ১৮৭৬ সালে প্রতিষ্ঠিত দেশের অন্যতম প্রাচীন এবং আয়তনে সর্ববৃহৎ বগুড়া পৌরসভায় বর্জ্য ব্যবস্থাপনা পরিচালিত হচ্ছে সনাতন মহল্লা ভিত্তিক সংগঠন CBO (Community based organisation) এর মাধ্যমে। পরিচ্ছন্নতা কর্মীর অভাব, যানবাহনের সল্পতা, পর্যাপ্ত সংখ্যক ডাম্পিং পয়েন্ট না থাকা এবং পৌর কর্তৃপক্ষের যথাযথ তদারকির অভাবে বর্তমানে পুরো পৌর এলাকা যেন ময়লার ভাগাড়ে পরিণত হয়েছে। পশ্চিমের প্রবেশ পথ গোদারপাড়া এলাকা, তিনমাথা রেলগেট থেকে আজিজুল হক কলেজ হয়ে সপ্তপদী পর্যন্ত পুরো সড়কের দুই পার্শ্ব উন্মুক্ত ডাস্টবিনে পরিণত হয়েছে। উল্লেখ্য যে এই পথে বগুড়ার অন্যতম হেরিটেজ স্থাপনা বগুড়া রেলওয়ে স্টেশন অবস্থিত। ১৮৯৯-১৯০০ সালে সান্তাহার থেকে ফুলছড়ি পর্যন্ত বাংলাদেশে মিটারগেজ রেলপথের সূচনা লগ্নের স্টেশন বগুড়া। ফলে বগুড়া রেলওয়ে স্টেশনের সম্মুখভাগের অপরিচ্ছন্ন পরিবেশ বগুড়া শহরের নেতিবাচক ভাবমূর্তি তৈরি করছে। একইভাবে শহরের দক্ষিণের প্রবেশ পথ বনানীর রেশম উন্নয়ন বোর্ড থেকে ঠনঠনিয়া, খান্দার, কারমাইকেল সড়কের কৃষিফার্ম এলাকা, সেউজগাড়ি পানির ট্যাংক এলাকা, উত্তরের প্রবেশ মুখ ফুলবাড়ী শিল্পকলা একাডেমির সামনে, আরো দক্ষিণে অগ্রসর হলে দত্তবাড়ি এলাকা হয়ে ফতেহ আলী বাজার সন্নিহিত এলাকা, নূরানী মোড় থেকে রানার সিটি এলাকা, সিভিল সার্জনের বাসভবন সংলগ্ন স্থান, মফিজ পাগলার মোড় থেকে দক্ষিনে জেলা জজের বাসভবনের গেট সন্নিহিত রাস্তার পূর্ব ও পশ্চিম পার্শ্ব, এসপি ব্রিজের পূর্ব পার্শ্বের আবর্জনার স্তুপ বগুড়া পৌর এলাকার বর্জ্য ব্যবস্থাপনার করুন চিত্র তুলে ধরছে।
বাংলাদেশ পরিসংখ্যান ব্যুরো প্রকাশিত মিউনিসিপাল বর্জ্য ব্যবস্থাপনা সমীক্ষা ২০২২ অনুসারে দেশের নগর এলাকায় মাথাপিছু দৈনিক উৎপাদিত কঠিন বর্জ্যের পরিমাণ ৫০০ গ্রাম এবং প্রতি বর্গকিলোমিটারে দৈনিক উৎপাদিত কঠিন বর্জ্যের পরিমাণ প্রায় তিন টন। এই হিসেবে বগুড়া পৌর এলাকায় প্রতিদিন প্রায় ৩০০ টন আবর্জনা তৈরি হয়। আধুনিক বর্জ্য ব্যবস্থাপনা না থাকায় এবং বর্জ্য সংগ্রহ, পরিবহন ও ভাগাড়ে জমা করার পুরো প্রক্রিয়াটির কোনোটি সঠিকভাবে প্রতিপালিত না হওয়ায় বর্জ্যগুলি পুরো শহরের সড়ক, মহাসড়ক, অলিগলি, নদী-নালা, পুকুর, জলাশয়, কৃষিক্ষেত্রে ছড়িয়ে পড়ছে এবং ড্রেনেজ সিস্টেমকে জ্যাম করে দিয়ে নানাভাবে দূষণ ছড়িয়ে পড়ছে। যা মৃত্তিকা দূষণের মাধ্যমে মৃত্তিকার উপকারী অনুজীব কে ক্ষতিগ্রস্ত করে ক্ষতিকর অনুজীব ছড়িয়ে পড়ার আশঙ্কা বাড়িয়ে দিচ্ছে, ভূপৃষ্ঠস্থ ও ভূগর্ভস্থ পানির আধারকে ক্ষতিগ্রস্ত করে বিশুদ্ধ সুপেয় পানির প্রাপ্যতাকে হুমকির মুখে ফেলছে এবং পানিবাহিত রোগ ছড়িয়ে পড়ার সম্ভাবনা বাড়িয়ে দিচ্ছে। একইভাবে বায়ু দূষণ বৃদ্ধি পাচ্ছে এবং চর্মরোগ সহ বিভিন্ন ধরনের সংক্রামক রোগ ছড়িয়ে পড়ার মাধ্যমে এই নগরে মানুষের বসবাসযোগ্যতাকে হুমকির মুখে ফেলছে। যা মোটেও কাম্য নয়।
কার্যকর বর্জ্য ব্যবস্থাপনা পরিবেশগত পরিচ্ছন্নতার একটি গুরুত্বপূর্ণ দিক। পরিবেশের উপর বর্জ্যের নেতিবাচক প্রভাব কমানোর জন্য প্রয়োজন যথাযথ বর্জ্য পৃথকীকরণ, পুনর্ব্যবহার ও বিপদজনক বর্জ্যের সঠিক নিষ্পত্তি ব্যবস্থা। এটি সনাতন সিবিও পদ্ধতিতে সম্ভব নয়। আধুনিক বর্জ্য ব্যবস্থাপনা পদ্ধতি অবলম্বন করলে ল্যান্ডফিলে পাঠানো বর্জ্যের পরিমাণ কমানো সম্ভব, সম্পদ সংরক্ষণ সম্ভব এবং দূষণের ঝুঁকিও সর্বনিম্ন পর্যায়ে নামিয়ে আনা সম্ভব। বগুড়া পৌরসভাকেও সেই পথেই হাঁটতে হবে। এটি বাস্তবায়নের জন্য প্রয়োজনে বিদেশী রাষ্ট্রের উন্নত কোন নগর কর্তৃপক্ষের সঙ্গে যৌথ অংশীদারিত্বে যাওয়া যেতে পারে, পাবলিক প্রাইভেট পার্টনারশিপে (PPP) এটি করা যেতে পারে অথবা কোনো সংস্থাকে দায়িত্ব দিয়েও এটি করা যেতে পারে। দরকার শুধু পৌর কর্তৃপক্ষের সদিচ্ছা ও কর্মতৎপরতার। তবে যেভাবেই করা হোক না কেন দেশের বৃহত্তম পৌরসভা তথা ঐতিহাসিক ও পুরাতত্ত্বিকভাবে গুরুত্বপূর্ণ বগুড়া পৌর এলাকায় আধুনিক বর্জ্য ব্যবস্থাপনা বাস্তবায়ন এখন সময়ের দাবি।
মেসেঞ্জার/মুমু