সংসদ সদস্য (মহিলা আসন ৪৪)। ছবি : সৌজন্য
বাংলাদেশ বিশ্বের শীর্ষস্থানীয় তামাক ব্যবহারকারী দেশের মধ্যে অন্যতম। বাংলাদেশে আনুমানিক তিন কোটি আটাত্তর লক্ষ মানুষ তামাক সেবন করে এবং এর মধ্যে প্রায় এক কোটি বিরানব্বই লক্ষই ধূমপান করে। (সূত্র: গ্লোবাল এডাল্ট টোব্যাকো সার্ভে বাংলাদেশ ২০১৭)। সিগারেট ব্যবহারের এই হার উল্লেখযোগ্য, অর্থবহ ও দীর্ঘমেয়াদে কমিয়ে আনার পথে বিভিন্ন প্রতিবন্ধকতা রয়েছে। যে বিষয়গুলোকে প্রতিবন্ধকতা হিসেবে চিহ্নিত করা হয় সেগুলোর মধ্যে একটি বিষয়কে আপাতদৃষ্টিতে হালকাভাবে নেয়া হলেও বিষয়টি বেশ গুরুত্বপূর্ণ। বিষয়টি হলো-খুচরা বা একক শলাকা বিক্রি।
বাংলাদেশ তথা সমগ্র পৃথিবীতে একটি ব্যাপক সমস্যা হচ্ছে একক শলাকা বা পৃথকভাবে সিগারেট বিক্রি হওয়া এবং যা প্যাকেটের অংশ হিসাবে বিক্রি হয় না। একটি পুরো প্যাকেটের চাইতে একটি একক শলাকা ক্রয় করা অনেক সস্তা, যা শিশু, তরুণ ও স্বল্প আয়ের মানুষসহ যারা মূল্য সংবেদনশীল তাদের কাছে সিগারেটকে সহজলভ্য করে তোলে। এ সহজলভ্যতা তরুণদের ধূমপান শুরু করাকে সহজ করে তোলে এবং অন্যদেরকে ধূমপান ছাড়তে বা কমাতে নিরুৎসাহিত করে।
সিগারেটের খুচরা শলাকা বিক্রি তামাকের নেশা ধরে রাখতে ভূমিকা রাখে বিধায় পৃথিবীর কমপক্ষে ৮০টি দেশে সিগারেটের খুচরা শলাকার বিক্রি নিষিদ্ধ, যদিও বাংলাদেশে এটা এখনও বৈধ। বাংলাদেশের সর্বত্রই খুচরা শলাকার বিক্রি হয়।
সিগারেটের প্যাকেট বিক্রির চাইতে খুচরা শলাকার বিক্রির হার অনেক বেশি এবং এর ভোক্তাদের অধিকাংশই তরুণ। তামাক শিল্পের বৈশ্বিক নজরদারি সংস্থা স্টপিং টোব্যাকো অর্গানাইজেশনস এন্ড প্রোডাক্টস (এসটিওপি)-এর তথ্যমতে, বাংলাদেশে এক প্যাকেট সিগারেটের দাম যেখানে ৮০ - ২৮৪ টাকা সেখানে একটি খুচরা শলাকার দাম মাত্র ৫ টাকা। ফলে আয়হীন তরুন সমাজ ও নিম্ন আয়ের মানুষেরা খুব সহজেই সিগারেট ক্রয় করতে পারে।
এছাড়া, খুচরা শলাকা ক্রয়ের কারণে এর ক্রেতা ধূমপায়ীরা সিগারেটের প্যাকেটের বিদ্যমান সচিত্র স্বাস্থ্য সতর্কবার্তা দেখতে পায় না। তথ্যের এই ঘাটতি পুরো প্যাকেটের ক্রেতাদের তুলনায় খুচরা শলাকার ক্রেতাদের স্বাস্থ্যকর সিদ্ধান্ত নেয়ার ক্ষমতায় প্রভাব ফেলে এবং ফলস্বরুপ স্বাস্থ্য বৈষম্যের অবনতি ঘটতে পারে।
খুচরা শলাকা আয়ের ক্ষেত্রে বৈষম্য তৈরি করে এবং দরিদ্র ধূমপায়ীকে আরও দরিদ্র করে। যদিও পুরো প্যাকেটের চাইতে একটি শলাকা সস্তায় ক্রয় করা যায় কিন্তু প্রতিটি সিগারেটের দাম হিসাবে পুরো প্যাকেটের চাইতে চাইতে একক শলাকার প্রকৃত ব্যয় বেশি। ফলস্বরূপ নিম্ন আয়ের মানুষেরা খুচরা মলাকা ক্রয়ের ফলে উচ্চ আয়ের মানুষদের তুলনায় প্রতিটি সিগারেটের জন্য বেশি অর্থ ব্যয় করে। এতে করে তাদের অর্থনৈতিক অবস্থার অবনতি ঘটে।
বাংলাদেশে বিদ্যমান ধূমপান ও তামাকজাত দ্রব্য ব্যবহার (নিয়ন্ত্রণ) আইন ২০০৫ (সংশোধিত ২০১৩) এ খুচরা শলাকা বিক্রির বিষয়ে কোনো নিষেধাজ্ঞা নেই। এমতবস্থায় ২০৪০ সালের মধ্যে টেকসই উন্নয়ন অভীষ্ট (এসডিজি) অর্জনের লক্ষ্যে তামাকমুক্ত বাংলাদেশ গঠনে এই বিদ্যমান আইনকে আরো শক্তিশালী ও বাস্তবমূখী করতে গণপ্রজাতন্ত্রী বাংলাদেশ সরকারের স্বাস্থ্য মন্ত্রণালয় ছয়টি সংশোধনীর প্রস্তাব করেছে। সেগুলোর মধ্যে অন্যতম একটি সংশোধনী হলো-খুচরা শলাকা ও মোড়কবিহীন বিক্রয় নিষিদ্ধ করা।
খুচরা শলাকা ও মোড়কবিহীন বিক্রয় নিষিদ্ধ করা ছাড়া অন্যান্য প্রস্তাবগুলো হলো- বিক্রয়কেন্দ্রে তামাকজাত দ্রব্য প্রদর্শন নিষিদ্ধ করা, তামাক কোম্পানির সকল সামাজিক দায়বদ্ধতা কার্যক্রম নিষিদ্ধ করা, ধূমপানের জন্য নির্ধারিত স্থান বাতিল করা, ই-সিগারেট ও হিটেড টোব্যাকো আমদানি ও বিক্রয় নিষিদ্ধ করা, এবং সিগারেটের প্যাকেটের গায়ে স্বাস্থ্যঝুঁকির চিত্র ৫০ ভাগ থেকে বাড়িয়ে ৯০ ভাগ করা।
তামাক সেবনের কারণে মৃত্যুর মিছিল প্রতিনিয়ত বেড়েই চলছে। বাড়ছে তামাক সেবনের কারণে বিভিন্ন রোগাক্রান্ত মানুষের সংখ্যা। এই ভয়াবহ পরিস্থিতি থেকে মুক্তি পেতে তামাক নিয়ন্ত্রণ আইন সংশোধন করে প্রয়োগ করার কোনো বিকল্প নেই। প্রত্যাশা যে, একটি তামাকমুক্ত সুস্থ-সবল জাতি গঠনের লক্ষ্যে প্রস্তাবিত সংশোধনীগুলো অতিদ্রুত পাস করে আইনে রূপদানের জন্য সরকার তথা সংশ্লিষ্ট কর্তৃপক্ষ দ্রুত যথাযথ পদক্ষেপ নেবেন।
লেখক: সংসদ সদস্য (মহিলা আসন ৪৪), গণপ্রজাতন্ত্রী বাংলাদেশ সরকার
মেসেঞ্জার/তারেক