ছবি : ডেইলি মেসেঞ্জার
বাংলাদেশ একটি নদীবাহিত দেশ যেখানে শতাধিক নদী প্রবাহিত হয়। এই নদীগুলোর পানি প্রবাহ এবং স্বাভাবিক গতির ওপর ভিত্তি করেই দেশের জলবায়ু এবং কৃষি নির্ভরশীল। কিন্তু বিগত কয়েক দশক ধরে বাংলাদেশকে প্রতিনিয়তই বন্যার মুখোমুখি হতে হচ্ছে, যার পেছনে একটি বড় কারণ ফারাক্কা বাঁধ।ভারতের ফারাক্কা বাঁধের গেট খোলার পর বাংলাদেশের বন্যা পরিস্থিতি একটি নতুন মাত্রা ধারণ করেছে। ফারাক্কা বাঁধ, গঙ্গা নদীর উপর নির্মিত একটি অভ্যন্তরীণ জলবায়ু প্রকল্প, বাংলাদেশের উত্তর ও মধ্যাঞ্চলে ভয়াবহ বন্যার সৃষ্টি করছে। ভারতীয় কর্তৃপক্ষের এই সিদ্ধান্ত বাংলাদেশের জনগণের জন্য এক বৃহৎ চ্যালেঞ্জ হয়ে দাঁড়িয়েছে, এবং এর ফলে সৃষ্ট পরিস্থিতি সুনির্দিষ্টভাবে বিশ্লেষণ করা প্রয়োজন।
ফারাক্কা বাঁধ: ইতিহাস ও প্রভাব
১৯৭৫ সালে নির্মিত ফারাক্কা বাঁধের উদ্দেশ্য ছিল কলকাতা বন্দরের নাব্যতা নিশ্চিত করা এবং গঙ্গার পানি পরিচালনা করা। তবে, এর নির্মাণের পর থেকেই বাংলাদেশের নদী ও পরিবেশে ব্যাপক প্রভাব পড়েছে। মূলত, গঙ্গার পানি প্রবাহ নিয়ন্ত্রণের কারণে পদ্মা, যমুনা ও অন্যান্য নদীগুলোর পানি প্রবাহে পরিবর্তন ঘটে, যা বাংলাদেশের নদীপ্রবাহের অবস্থা ও কৃষি ব্যবস্থা প্রভাবিত করেছে।
বন্যার কারণ এবং পরিস্থিতি
বাংলাদেশে বন্যা একটি প্রাকৃতিক ঘটনা, যা প্রধানত বর্ষাকালে ঘটে। কিন্তু ফারাক্কা বাঁধের প্রভাবে এই বন্যার মাত্রা ও ব্যাপকতা বেড়ে গেছে। বাঁধের কারণে গঙ্গার প্রধান শাখা পদ্মার পানিপ্রবাহ কমে গেছে, যার ফলে নদীর তলদেশ ভরাট হয়ে যাচ্ছে। অন্যদিকে, বর্ষার সময় অতিরিক্ত পানির চাপে বাঁধের গেট খুলে দেওয়া হয়, যা বাংলাদেশের নদীগুলোতে অতিরিক্ত পানি প্রবাহিত করে। ফলে নিম্নাঞ্চলগুলো প্লাবিত হয়।
কৃষি এবং জীববৈচিত্র্যের ওপর প্রভাব
বন্যার কারণে বাংলাদেশের কৃষি খাতে মারাত্মক প্রভাব পড়ছে। ফসলের ক্ষতি, মাটি ধস, এবং জলাবদ্ধতা কৃষি উৎপাদনে নেতিবাচক প্রভাব ফেলছে। ফলে দেশের খাদ্য নিরাপত্তা হুমকির মুখে পড়ছে। তাছাড়া, বন্যার পানিতে মাছের প্রজাতি এবং অন্যান্য জলজ প্রাণীর প্রজনন বাধাগ্রস্ত হচ্ছে, যা দেশের জীববৈচিত্র্যের ওপর দীর্ঘমেয়াদী প্রভাব ফেলছে।
বর্তমান পরিস্থিতি: গেট খোলার পরিণতি
ভারতের ফারাক্কা বাঁধের সব গেট খুলে দেয়ার ফলে পদ্মা নদীর পানি প্রবাহ উল্লেখযোগ্যভাবে বৃদ্ধি পেয়েছে। এতে করে বাংলাদেশের উত্তর ও মধ্যাঞ্চলে ব্যাপক বন্যার সৃষ্টি হয়েছে। হাজার হাজার হেক্টর কৃষি জমি জলমগ্ন হয়ে পড়েছে, ফলে ফসলের ব্যাপক ক্ষতি হচ্ছে। পাকা ঘরবাড়ি, শিক্ষা প্রতিষ্ঠান এবং স্বাস্থ্য কেন্দ্রসহ অন্যান্য অবকাঠামোও পানির নিচে চলে যাচ্ছে। এ ছাড়াও, বন্যার কারণে যোগাযোগ ব্যবস্থা বিপর্যস্ত হয়েছে, সড়কপথে চলাচল করতে গিয়ে মানুষ নানা সমস্যার সম্মুখীন হচ্ছে।
প্রাকৃতিক কারণ ও মানবসৃষ্ট প্রভাব
ফারাক্কা বাঁধের গেট খোলার ফলে বন্যার মাত্রা বাড়ার পাশাপাশি প্রাকৃতিক কিছু কারণও ভূমিকা রাখছে। অতিবৃষ্টি এবং বঙ্গোপসাগরে সৃষ্ট লঘুচাপ বন্যা পরিস্থিতিকে আরও খারাপ করছে। বর্ষা মৌসুমে প্রচুর বৃষ্টি হয়, যা নদীগুলোর পানির স্তর বৃদ্ধি করে। এছাড়া, বঙ্গোপসাগরে লঘুচাপ সৃষ্টির ফলে অতিরিক্ত বৃষ্টিপাত হয়, যা বন্যার মাত্রা আরও বাড়িয়ে দেয়। জলবায়ু পরিবর্তনের কারণে এরকম প্রাকৃতিক দুর্যোগের ঘনঘটা বৃদ্ধি পাচ্ছে, যা বন্যার প্রকৃতি ও মাত্রা পরিবর্তন করছে।
বন্যার প্রভাব: মানুষের জীবন ও স্বাস্থ্য
বন্যার ফলে শুধু ঘরবাড়ি ও কৃষি জমি নয়, মানুষের জীবন ও স্বাস্থ্যেও ব্যাপক প্রভাব পড়ছে। বন্যার কারণে স্যানিটেশন ব্যবস্থা ভেঙে পড়েছে, যার ফলে পানিবাহিত রোগের প্রাদুর্ভাব বেড়ে গেছে। ডায়রিয়া, কলেরা, এবং অন্যান্য রোগের বিস্তার মানুষের জন্য নতুন হুমকি সৃষ্টি করেছে। শিশু, বৃদ্ধ ও গর্ভবতী নারী বিশেষভাবে ঝুঁকির মধ্যে আছেন। সামাজিক নিরাপত্তা নেটওয়ার্ক ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছে এবং স্বাস্থ্যসেবার অভাব দেখা দিয়েছে।
বাংলাদেশের জন্য করণীয় পদক্ষেপ
- ত্রাণ ও পুনর্বাসন: নতুন করে বন্যাকবলিত এলাকাগুলোতে জরুরি ত্রাণ সহায়তা প্রদান করতে হবে। আশ্রয়কেন্দ্রগুলোর কার্যক্রম বৃদ্ধি করতে হবে এবং সেখানে প্রয়োজনীয় খাবার, পানি, ওষুধ এবং স্বাস্থ্যসেবা নিশ্চিত করতে হবে।
- অবকাঠামোগত উন্নয়ন: নদী তীর রক্ষা এবং বন্যা নিয়ন্ত্রণ বাঁধ মজবুত করার উদ্যোগ নিতে হবে। নদী খনন, পলি অপসারণ এবং নদী সংস্কার কাজে মনোযোগ দিতে হবে যাতে ভবিষ্যতে এমন পরিস্থিতি কমানো যায়।
- আন্তর্জাতিক সহযোগিতা: ভারতের সাথে সমন্বয় বজায় রাখতে হবে। ফারাক্কা ব্যারেজের গেট খোলার বিষয়টি নিয়ে উভয় দেশের মধ্যে প্রাথমিক আলোচনা ও পরিকল্পনা করা উচিত। যৌথভাবে নদীর পানি ব্যবস্থাপনা নিশ্চিত করার জন্য চুক্তি ও সমঝোতা করতে হবে।
- জলবায়ু পরিবর্তনের প্রভাব মোকাবেলা: জলবায়ু পরিবর্তনের প্রভাব কমানোর জন্য পরিকল্পিত উদ্যোগ গ্রহণ করা প্রয়োজন। আবহাওয়া পূর্বাভাসের উন্নয়ন, জলবায়ু অভিযোজন কৌশল এবং সঠিক তথ্যের ভিত্তিতে সিদ্ধান্ত গ্রহণ করা জরুরি।
ফারাক্কা বাঁধ ও আন্তঃদেশীয় সম্পর্ক
ফারাক্কা বাঁধের কারণে বাংলাদেশ ও ভারতের মধ্যে জলবণ্টন নিয়ে দীর্ঘদিন ধরে বিরোধ চলেছে। ১৯৯৬ সালে দুই দেশের মধ্যে গঙ্গা পানিবণ্টন চুক্তি স্বাক্ষরিত হয়, কিন্তু তা সত্ত্বেও সমস্যার সম্পূর্ণ সমাধান হয়নি। ভারতীয় কর্তৃপক্ষ যখন বাঁধের গেট খোলার সিদ্ধান্ত নেয়, তখন বাংলাদেশের কোনো মতামত নেওয়া হয় না, যা পরিস্থিতি আরও জটিল করে তোলে।
কীভাবে সমাধান সম্ভব?
ফারাক্কা বাঁধের সমস্যার সমাধান খুঁজতে হলে দুই দেশের মধ্যে সহযোগিতা এবং তথ্য বিনিময় বাড়াতে হবে। বাংলাদেশের নদীগুলোর পানিপ্রবাহের তথ্য ও তাৎক্ষণিক তথ্যের ভিত্তিতে সিদ্ধান্ত নেওয়া প্রয়োজন। এছাড়াও, বাঁধের বিকল্প হিসেবে পানি সংরক্ষণ ও ব্যবস্থাপনার জন্য উন্নত প্রযুক্তি ব্যবহার করা যেতে পারে।
ফারাক্কা বাঁধের গেটগুলো খুলে দেয়ার সিদ্ধান্ত এবং অতিবৃষ্টির কারণে বাংলাদেশের বন্যা পরিস্থিতি নতুন এক ভয়াবহ মাত্রা ধারণ করেছে। এই পরিস্থিতি মোকাবেলায় দেশের সকল স্তরে কার্যকর পদক্ষেপ গ্রহণ করা প্রয়োজন। প্রাকৃতিক দুর্যোগের পাশাপাশি মানুষের দ্বারা সৃষ্ট কারণগুলোও বিবেচনায় রেখে একটি সমন্বিত উদ্যোগ গ্রহণ করতে হবে। একমাত্র এমন পদক্ষেপই বাংলাদেশের জনগণের জীবন ও জীবিকা সুরক্ষিত করতে পারে এবং ভবিষ্যতের জন্য টেকসই সমাধান নিশ্চিত করতে পারে।
লেখক: আহমেদ শাহেদ, গণমাধ্যমকর্মী ও প্রফেশনাল ভয়েস ওভার আর্টিস্ট।
মেসেঞ্জার/সজিব