শেখ হাসিনার সরকার পতনের পর অন্তর্বর্তীকালীন সরকারের শাসনাধীন বাংলাদেশের বিরুদ্ধে অর্থনৈতিক নিষেধাজ্ঞা আরোপসহ পদক্ষেপ নিতে যুক্তরাষ্ট্রের প্রেসিডেন্ট নির্বাচনে জয়ী রিপাবলিকান নেতা ডোনাল্ড ট্রাম্প প্রশাসনের কাছে পৌঁছাতে জোর চেষ্টা-তদবির চালাচ্ছে ভারতীয় বংশোদ্ভূত মার্কিনীরা। তারা বাংলাদেশের ওপর পদক্ষেপ নিতে ট্রাম্প প্রশাসন ও মার্কিন কংগ্রেসকে কাজে লাগাতে চাইছে বলে ভারতের সংবাদ সংস্থা পিটিআইকে জানিয়েছেন ভারতীয় হিন্দু আমেরিকান কমিউনিটির এক নেতা ভারত বড়াই, যিনি পেশায় একজন চিকিৎসক।
ভারত বড়াই বলেন, ট্রাম্প ক্ষমতা গ্রহণের পরই বাংলাদেশের বিরুদ্ধে তারা কাজ শুরু করবেন। মার্কিন নির্বাচনের আগে বাংলাদেশে সংখ্যালঘু বিশেষ করে হিন্দু সম্প্রদায়ের ওপর নির্যাতনের অভিযোগ তুলে ডোনাল্ড ট্রাম্প যে পোস্ট দিয়েছিলেন সেটি তাদের উদ্বুদ্ধ করেছে। আর এ বিষয়টি কাজে লাগিয়েই বাংলাদেশের ওপর নিষেধাজ্ঞা দিতে তারা ট্রাম্পকে উদ্বুদ্ধ করার চেষ্টা করবেন। হিন্দু এই নেতা আরও বলেন, তাদের (বাংলাদেশ) তৈরি পোশাক রপ্তানি যদি বন্ধ হয়ে যায়, যা তাদের ব্যবসার ৮০ শতাংশ, তাহলে বাংলাদেশের মানুষ খাবে কী?
ভারত বড়াই আরও দাবি করেন, বাংলাদেশের ওপর এ ধরনের চাপ হিন্দুসহ অন্যান্য সংখ্যালঘুদের ওপর চলা কথিত নির্যাতন বন্ধে সহায়ক হবে। তিনি বলেন, ‘পরিস্থিতির উন্নতি না হলে আমরা হিন্দু আমেরিকানরা বাংলাদেশের বিরুদ্ধে ব্যবস্থা নিতে কংগ্রেসের প্রতিও আহ্বান জানাব।’ এছাড়া হিন্দুদের ওপর নির্যাতন বন্ধে বাংলাদেশ সরকারের ওপর ভারতেরও নিষেধাজ্ঞা আরোপ করা উচিত বলে মনে করেন এই ভারতীয় আমেরিকান।
বড়াই বলেছেন, বাংলাদেশে গণতান্ত্রিকভাবে নির্বাচিত সরকার উৎখাতে বহিরাগত হস্তক্ষেপ নিয়ে অনেকেই আলোচনা করছেন। এখন মুসলমানদের মধ্যেও মতপার্থক্য তৈরি হয়েছে। কেউ কেউ মনে করেন, এই অভ্যুত্থান আমেরিকান ডেমোক্র্যাটদের পরিকল্পনার অংশ, যা পাকিস্তান ও বাংলাদেশে প্রভাব ফেলেছে। তিনি মনে করেন, পাকিস্তানেও ইমরান খানের সরকারেরও পতন ঘটেছে জো বাইডেন প্রশাসনেরই ইন্ধনে।
বাংলাদেশ বিরোধী এই অপতৎপরতা চালিয়ে আসলে ফায়দা কী তাদের? মোটা দাগে আমরা দুটি কারণ উল্লেখ করতে পারি— সংখ্যালঘু নির্যাতন নিয়ে অপপ্রচার এবং রাজনৈতিক ইস্যু।
যুক্তরাষ্ট্রের প্রেসিডেন্ট নির্বাচনে বিজয়ী রিপাবলিকান প্রার্থী ডোনাল্ড ট্রাম্প নির্বাচনের আগে এক্সে (সাবেক টুইটার) এক পোস্টে বাংলাদেশে সংখ্যালঘুদের ওপর সহিংসতার নিন্দা জানান। ওই পোস্টে তিনি বলেন, ‘আমি বাংলাদেশে হিন্দু, খ্রিষ্টান ও অন্যান্য সংখ্যালঘুদের ওপর বর্বরোচিত সহিংসতার তীব্র নিন্দা জানাচ্ছি। দেশটিতে দলবদ্ধভাবে তাঁদের ওপর হামলা ও লুটপাট চালানো হচ্ছে। বাংলাদেশ এখন পুরোপুরিভাবে একটি বিশৃঙ্খল অবস্থার মধ্যে রয়েছে। আমার আমলে এটি কখনো ঘটত না। কমলা (হ্যারিস) ও জো (বাইডেন) সারা বিশ্বে ও যুক্তরাষ্ট্রে হিন্দুদের উপেক্ষা করেছেন। তারা ইসরায়েল থেকে ইউক্রেন পর্যন্ত এবং আমাদের দক্ষিণ সীমান্ত পর্যন্ত সর্বত্র ব্যর্থ হয়েছেন। কিন্তু আমরা যুক্তরাষ্ট্রকে আবার শক্তিশালী করব এবং শান্তি ফিরিয়ে আনব। আমরা হিন্দু আমেরিকানদের রক্ষা করব ও চরমপন্থী বামদের ধর্মবিরোধী এজেন্ডার বিরুদ্ধে লড়াই করব। আমরা আপনার স্বাধীনতার জন্য লড়ব। আমার প্রশাসনের অধীনে এটাই হবে।’
যুক্তরাষ্ট্রের সাবেক ও নবনির্বাচিত এই প্রেসিডেন্টের বক্তব্য পর্যালোচনা করলে আমরা দেখতে পাই, তার পোস্টের মূল উদ্দেশ্য ছিলো যুক্তরাষ্ট্রে অবস্থানরত বিপুল পরিমাণ ভারতীয়দের ভোট নিজে পক্ষে নেওয়ার একটা প্রয়াস ছিলো তার এই এক্স পোস্ট। তিনি বাংলাদেশবিরোধী পোস্ট করেছেন—বিষয়টা মোটেও এমনটা নয়। একটি সরকারের পতনের পর নতুন অন্তর্বর্তীকালীন সরকারের গুছিয়ে উঠতে কিছুটা সময় লাগবে, এটাই স্বাভাবিক।
বাংলাদেশে সংখ্যালঘু নির্যাতনের বিষয়ে যুক্তরাষ্ট্রের প্রেসিডেন্ট নির্বাচনে বিজয়ী ডোনাল্ড ট্রাম্পকে ভুল তথ্য দেওয়া হয়েছে বলে জানান অন্তর্বর্তীকালীন সরকারের প্রধান উপদেষ্টার প্রেস সচিব শফিকুল। তিনি মনে করেন, যুক্তরাষ্ট্রের প্রেসিডেন্ট হিসেবে দ্বিতীয় মেয়াদে দায়িত্ব নেওয়ার পর উনি দেখতে পারবেন আসলে কী ঘটেছে। আমরা মনে করি, সংখ্যালঘু নির্যাতন নিয়ে প্রচুর অপতথ্য বা ভুল তথ্য প্রচার করা হয়েছে। ঢাকায় যুক্তরাষ্ট্রের দূতাবাস রয়েছে, তারা দেখবে বাংলাদেশে কী ঘটছে বা সংখ্যালঘু নির্যাতনের ঘটনা আদৌ ঘটেছে কি না। যুক্তরাষ্ট্রের সদ্য বিজয়ী প্রেসিডেন্ট তখন নিশ্চয়ই প্রকৃত চিত্র জানতে পারবেন।
হিন্দু বৌদ্ধ খ্রিস্টান কাউন্সিলের করা একটা রিপোর্টে ধর্মীয় কারণে হিন্দু সম্প্রদায়ের ৯ ব্যক্তির মৃত্যু হয়েছে বলে উল্লেখ করা হয়। অথচ নেত্র নিউজের এক রিপোর্টে প্রত্যেকটা মৃত্যুর কারণ তুলে ধরা হয়েছে। তাতে দেখা গেছে মৃত্যুগুলোর পেছনে ধর্মীয় কারণ ছিল না। বেশির ভাগ ক্ষেত্রে রাজনৈতিক সংশ্লিষ্টতা অথবা ব্যক্তিগত শত্রুতার জেরে মৃত্যুর ঘটনা ঘটেছে। কিন্তু এসব মৃত্যু গণমাধ্যমে বিশেষ করে সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমে ভারতীয়দের বিভিন্ন অ্যাকাউন্ট থেকে ঢালাওভাবে সংখ্যালঘু নির্যাতন হিসেবে অপপ্রচার চালানো হয়েছে।
ভারত বড়াইয়ের মন্তব্যে বাংলাদেশে মার্কিন নিষেধাজ্ঞার আরোপের পেছনে রাজনৈতিক সংশ্লিষ্টতারও ইঙ্গিত পাওয়া যায়। তার দাবি, বহিরাগত হস্তক্ষেপে নির্বাচিত সরকারের উৎখাত হয়েছে। যদিও তার পেছনে কোনো প্রমাণ বা যুক্তি তিনি দেননি। অনেকে মনে করেন, অন্তর্বর্তীকালীন সরকারের ওপর বৈদেশিক চাপ প্রয়োগ করে আবারও হাসিনা সরকারকে ক্ষমতা ফেরানোর অপচেষ্টা করা হচ্ছে। যদিও সেটা কতটুকু যুক্তিযুক্ত তা এখনই বলা যাচ্ছে না। রাজনৈতিক দল হিসেবে সব দলেরই চেষ্টা থাকবে ক্ষমতায় বসা। কিন্তু দেশের বিরুদ্ধে অর্থনৈতিক নিষেধাজ্ঞা আরোপের মাধ্যমে, দেশের ক্ষতি করে অনিয়মতান্ত্রিক উপায়ে দেশের ক্ষমতা দখলের অপচেষ্টা চালাবেন চারবারের প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা—এটা আমরা দেখতে চাই না।
সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমে ভারতীয় হিন্দু আমেরিকানদের এসব অপতৎপরতার বিরুদ্ধে ঐক্যবদ্ধ প্রতিবাদের ডাক উঠেছে। গোটা জাতি ঐক্যবদ্ধ হয়ে বিশ্বব্যাপী যার যার অবস্থান থেকে বাংলাদেশ বিরোধী যে কোনো ধরনের ষড়যন্ত্র রুখে দেওয়ার আহ্বান জানিয়েছেন তারা। বিশেষজ্ঞরা এই অপচেষ্টাকে কেবলই শিশুসুলভ, হিংসাত্মক ও বৃথা বলে মনে করেন। তারা ব্যাখ্যা করে বলেন, আন্তর্জাতিক সম্পর্ক বজায় রাখার ক্ষেত্রে যুক্তরাষ্ট্রের মত একটি বড় দেশের রয়েছে নিজস্ব দৃষ্টিভঙ্গি ও সুদৃঢ় নীতি। মার্কিন সরকার কোনো গোষ্ঠীর উদ্দেশ্যপ্রণোদিতভাবে সরবরাহ করা মিথ্যা তথ্য যাচাই না করেই একটি দেশের বিরুদ্ধে ব্যবস্থা নেবে এমনটা আশা করা কেবলই মুর্খতা ও বোকামি।
অতীতে এমন কোনো দৃষ্টান্ত দেখা যায়নি। আর বাংলাদেশের মতো একটি বাণিজ্যিক ও কৌশলগত সহযোগী দেশের বিরুদ্ধে এমন পদক্ষেপ গ্রহণ তো প্রশ্নই আসে না। বাংলাদেশের সাথে আমেরিকার বাণিজ্যচুক্তি শুধু বাংলাদেশের জন্যেই নয়, বরং উভয় দেশের স্বার্থে হয়। বাংলাদেশের টেক্সটাইলেই যুক্তরাষ্ট্রের সুবিধা বেশি। বিকল্প কোনো দেশ থাকলে অনেক আগেই তাদের থেকে আমদানি করতো তারা। কারোর ব্যক্তিগত স্বার্থ হাসিলের জন্য এত বড় বাণিজ্য বন্ধ করে যুক্তরাষ্ট্রের জাতীয় স্বার্থ জলাঞ্জলি দেওয়া ট্রাম্পের নীতি নয়।
লেখক: গণমাধ্যমকর্মী।
মেসেঞ্জার/ইএইচএম