বৌদ্ধ ধর্মের প্রবক্তা গৌতম বুদ্ধ ঐতিহাসিক সত্যের আকর। আজ থেকে ২৫৬৬ মতান্তরে ২৫৬৭ বছর আগে তিনি আমাদের মানব সমাজের মাঝে পরম আর্শিবাদ রূপে আর্বিভূত হয়ে সর্ব মানব ও প্রাণী প্রজাতির সর্ব মাঙ্গলিক সত্য সুন্দরের বাতাবরণ খুলে দিয়েছিলেন। রাগÑদ্বেষÑমোহ মূলোচ্ছেদ করে তিনি করুণাসিন্ধু ভগবান। গৌতম বুদ্ধ জাগতিক জীবনের সমস্ত অরযুক্ত (সংসার-বত্তস্স অরনাং হতত্বা) রিপুকে জয় বা পরাভূত করে অর্হৎ হয়েছেন। তিনি সম্যক সম্বুদ্ধ ও বিদ্যা আচরণ সম্পন্ন কর্মবীর। তিনি সুগত, লোকবিদু, অনুত্তর ও দম্য পুরুষগণের যথার্থ সারথী। তিনি দেব-মনুষ্যগণের শাস্তা ও আমাদের অনন্ত জ্ঞানের আধার বুদ্ধ ভগবান।
এ নবগুন সম্পন্ন মানবপুত্র বুদ্ধের সর্ব মাঙ্গলিক সত্য সুন্দরের আরাধনায় আবিস্কৃত ধর্ম পরিপূর্ণভাবে বাস্তবের ভিত্তি মূলে প্রোথিত। তাঁর ধর্ম পর্যায় ক্রমিকভাবে সুব্যাখ্যাত, স্বয়ং প্রত্যক্ষকরণীয়, কালাকালহীন অর্থাৎ ‘এসো এবং দেখ’ বলার যোগ্য। এ ধর্ম সর্ব দুঃখ অন্তঃসাধনের নিরিখে নৈর্বানিক ও বিজ্ঞ, সুবিজ্ঞ জনগণ কর্তৃক নিজে নিজেই বা স্বয়ং জ্ঞাতব্য। এ বিশ্বে যত ধর্ম প্রবক্তা আবির্ভূত হয়েছেন বুদ্ধের মতো কেউ জনগণকে দৃপ্ত কণ্ঠে আহবান জানাতে পারেননি যে, ‘এসো এবং দেখ’, আমার আবিস্কৃত ধর্মকে প্রত্যক্ষভাবে যাচাই করে দেখ। যদি বিশ্বাসযোগ্য, হিতকর, তোমার জীবনের জন্য কল্যাণকর মনে কর, যদি ভালো লাগে তাহলে আমার এ ধর্মকে গ্রহণ কর। অন্ধভাবে এ ধর্ম গ্রহণ করতে যেওনা। তাঁর ধর্মদর্শনে অন্ধবিশ্বাসের কোন স্থান নেই। বিবেকের কষ্টি পাথরে যাচাই করে যুক্তি বুদ্ধি প্রয়োগ করে তিনি তাঁর ধর্মে অনুরক্ত হয়ে কায় বাক্য মনে গ্রহণ এবং সতত অনুশীলন করতে বলেছেন। কারণ বারংবার অনুশীলনেই মানুষ পূর্ণতার শীর্ষ চূড়ায় আরোহন করেন। এটিই তাঁর অধিত ধর্মের মূল মন্ত্র।
মানব বুদ্ধের সময়কালে তাঁর জীবদ্দশায় স¤্রাট, রাজা, বাদশা, শ্রেষ্ঠ, ধনী-গরিব, ব্রাহ্মণ, ক্ষত্রিয়, বৈশ্য, শুদ্র জাতি-ধর্ম-বর্ণ নির্বিশেষে বুদ্ধকে বিশ্বাস করেছিলেন। বুদ্ধকে ও তাঁর যুক্তি নির্ভর ধর্মকে গভীরভাবে আস্থায় নিয়েছিলেন। তাঁর যাপিত জীবনে অস্তর্লীন বাস্তবতার নিরিখে শ্রুতি-স্মৃতি ও অনুশীলনের মধ্য দিয়ে কথায়-বার্তায়, চলনে-বলনে, মন-মননে জীবনের প্রতিটি পর্যায়ে কায়-বাক্যে মনে আত্মস্থ করার পরাকাষ্ঠা প্রদর্শন করেছিলেন। জাতি-ধর্ম-বর্ণ ও ধনী গরীব নির্বিশেষে হাজার হাজার কুল পুত্র ও কুল পুত্রী তৃষ্ণা-দৃষ্টি-মানের জটা জালে আকীর্ণ সংসারের বা সংসার চক্রের সব কিছুকে ভয়ের চোখে অবলোকন করার আকাঙ্খা ও তাগিদ নিয়ে ভিক্ষু ও ভিক্ষুণী হিসেবে দীক্ষা নিয়েছিলেন। লক্ষ লক্ষ সাধারণ জনগণ থেকে শুরু করে স¤্রাট, রাজা বাদশা, শ্রেষ্ঠী, রাজ কন্যা, রাজমহিষী, পুর নারী, বারঙ্গনা, চন্ডাল কন্যা শরণাগত হয়েছিলেন বুদ্ধের গৃহী শিষ্য ও শিষ্যা হিসেবে । সত্য-সুন্দরের আকর, উদার মানবিক ঐশ্বর্যে পরিপূর্ণ ও অহিংসার মহামন্ত্রে উৎসর্জিত ধর্মবাণী সর্ব সাধারণের দ্বারে দ্বারে পৌঁছে দেওয়ার অভীস্পায় গঠিত হয়েছিল ভিক্ষু-ভিক্ষুণী পরিষদ বা সংঘ। যুগপৎভাবে গঠিত হয়েছিল উপাসক-উপাসিকা পরিষদ বা সংঘ। এ চতুপারিষদের কথা, শাসন-সদ্ধর্মের সুস্থিতি বিধানে তাঁদের সুমহান অবদানের কথা মহামানব বুদ্ধও স্বীকার করেছেন এবং প্রশংসা করেছেন। এ চতুপারিষদের মধ্যে ভিক্ষু ও ভিক্ষুণী সংঘ, যাঁদেরকে বুদ্ধ শাসন-সদ্ধর্মের ধারক-বাহক-রক্ষক হিসেবে সমধিক গুরুত্বারোপ পূর্বক বিবেচনায় নিয়ে তাদেরকে নিষ্পাপ ও নিস্কলুষ এবং সর্বজন প্রশংসিত জীবন দক্ষতা প্রদানের লক্ষ্যে বিনয়ের বিধি-বিধান প্রজ্ঞাপ্ত করেছিলেন। ভিক্ষু প্রাতিমোক্ষ ও ভিক্ষুণী প্রাতিমোক্ষ হল ভিক্ষু-ভিক্ষুণীদের শৃঙ্খলাপূর্ণ নিষ্পাপ ও নিস্কলুষ জীবন গঠনের অনন্য সাধারণ আকর গ্রন্থ। বুদ্ধ তাঁদেরকে বলেছিলেন- ‘বিনযো বুদ্ধ সাসনস্স আযু’ অর্থাৎ বিনয়কে বুদ্ধ শাসনের আয়ু হিসেবে শীরোধার্য রাখতে হবে।
এ জগত সংসারে সব কিছুকে ভয়ের চোখ অবলোকন করার আকাঙ্খা ও তাগিদ নিয়ে আগার থেকে অনাগারিক জীবনে আগত ভিক্ষু ভিক্ষুণীদের মধ্যে উৎকৃষ্ট ভিক্ষু-ভিক্ষুণীর লক্ষণ করণীয় মৈত্রী সূত্রে নিন্মরূপভাবে বর্ণিত হয়েছে-
১। ভিক্ষু-ভিক্ষুণীগণ সতত সদ্ধর্ম উপলব্ধির চেষ্টায় নিরত থাকবেন
২। ভিক্ষু-ভিক্ষুণীগণ ঋজু স্বভাব সম্পন্ন হবেন
৩। তাঁরা জীবনের প্রতিটি পর্যায়ে পরোপকার বৃত্তির অভ্যাস করবেন
৪। তাঁরা বুদ্ধের শাসন-সদ্ধর্মের বিধি বিধান ও বুদ্ধ কর্তৃক প্রদত্ত উপদেশ অন্তরঙ্গভাবে মেনে চলবেন
৫। তাঁরা সর্বতোভাবে ভদ্র থাকবেন
৬। তাঁরা সর্বক্ষেত্রে বিনয়ী ও নীতি-নৈতিকতা সম্পন্ন হবেন
৭। তাঁরা কোন প্রকার লাভ সৎকার বা কোন প্রকার উপহারের প্রত্যাশা করবেন না
৮। তাঁদের যা আছে তাই নিয়ে তাঁরা সন্তোষ্ট থাকবেন
৯। দৈনন্দিন গার্হস্থ্য কর্মাদি যথাসম্ভব কমানোর প্রচেষ্টায় তাঁরা সতত আত্মনিবেদিত থাকবেন
১০। ব্যক্তিগত তৈজসপত্র বা মালামাল যথাসম্ভব কম রাখার ব্যাপারে তাঁরা সচেষ্ট থাকবেন। যাতে দ্রুত ও হালকাভাবে সদ্ধর্ম প্রচার ও প্রসারে যথা ইচ্ছা ভ্রমণ করা যায়।
১১। তাঁরা সর্বক্ষণ প্রশান্ত ও গম্ভীর মূর্তিতে অবস্থান করবেন
১২। তাঁরা বিচার বিবেচনায় বিবেচক ও প্রাজ্ঞ হবেন
১৩। তাঁরা কোন কালেই রুঢ় আচরণ সম্পন্ন হবেন না
১৪। তাঁরা জীবনের কোন পর্যায়েই উপাসক ও উপাসিকাদের প্রতি আসক্ত হবেন না
১৫। তাঁরা ভিক্ষু ও ভিক্ষুণী অবস্থায় এমন কোন তুচ্ছ, হীন, জঘন্য, নিন্দনীয় কাজ করবেন না যার জন্য অপর বুদ্ধিমান, প্রজ্ঞাবান ধার্মিক ব্যক্তিবর্গের দ্বারা নিন্দিত হতে পারেন।
এছাড়াও তাঁরা হবেন নিরভিমানী এবং মৈত্রী পরায়ন। মৈত্রী সূত্রে বর্ণিত দিক নিদের্শনাই হবে ভিক্ষু-ভিক্ষুণীদের যাপিত জীবনের যুগপৎ পরিত্রাণ ও কর্মস্থান। ভিক্ষু-ভিক্ষুণীগণ পরস্পরকে প্রবঞ্চনা করবেন না, কাকেও অবজ্ঞা করবেন না, ক্রোধ ও হিংসার বশবর্তী হয়ে পরস্পরের দুঃখোৎপত্তির কারণ হবেন না ও কারও অমঙ্গল ইচ্ছা করবেন না।
ভিক্ষু-ভিক্ষুণীগণ হবেন নবগুণ সম্পন্ন
১। তাঁর সুপ্রতিপন্ন অর্থাৎ ¯্রােতাপত্তি মার্গ ও ফল লাভী হবেন
২। তাঁরা সোজাপথে প্রতিপন্ন অর্থাৎ সকৃদাগামী মার্গ ও ফল লাভী হবেন
৩। তাঁরা ন্যায় পথে প্রতিপন্ন অর্থাৎ অনাগামী মার্গ ও ফল লাভী হবেন
৪। তাঁরা সম্যক পথে প্রতিপন্ন অর্থাৎ অর্হত্ব মার্গ ও ফল লাভী হবেন
৫। তাঁরা সর্বস্তরের পুণ্যার্থী দায়ক-দায়িকা ও উপাসক-উপাসিকাগণের আহ্বানের যোগ্য হবেন
৬। তাঁরা সর্বস্তরের পুণ্যার্থী ব্যক্তিবর্গের পূজা ও সৎকারের যোগ্য হবেন
৭। তাঁরা সর্বস্তরের পুণ্যার্থী ব্যক্তিবর্গের দান গ্রহণ যোগ্য হবেন
৮। তাঁরা সমস্ত দেবতা-মনুষ্য নাগ- যক্ষগণের অঞ্জলীবদ্ধভাবে প্রণাম যোগ্য হবেন
৯। তাঁরা জগতে সর্বশ্রেষ্ঠ পূণ্যক্ষেত্র হিসেবে সদাসর্বদা অধিষ্ঠিত থাকবেন।
এখানে উল্লেখ্য ও বলে রাখা ভাল যে, কুলপুত্র ও কুলপুত্রীগণ জগত সংসারের সব কিছুকে ভয়ের দৃষ্টিতে অবলোকন করার তাগিদ নিয়ে ভিক্ষু ও ভিক্ষুনী সংঘের অর্ন্তভূক্ত হওয়া সংঘ সদস্যগণ কিন্তু আজীবন কায়- বাক্য-মনে উপরের বর্ণিত নবগুণ সম্পন্ন সংঘের সমপর্যায়ভূক্ত অধিষ্ঠিত হওয়ার ও থাকার আরাধনায় নিরত থাকেন। এখানে বর্ণিত নবগুণ সম্পন্ন সংঘের সম পর্যায়ভূক্ত হওয়ার সাধনা কিন্তু সর্বতোভাবে স্বকৃত কায়-বাক্য ও মন নির্ভর। মানুষ নিজ নিজ কর্মের উপর ভিত্তি করে ¯্রােতাপত্তি, সকৃতাগামী, অনাগামী ও অর্হৎ মার্গস্থ এবং ফলস্থ ভেদে আটটি স্তর পর্যায়ক্রমিকভাবে অধিগত হয়ে সর্ব দুঃখের অন্তঃসাধনকারী নির্বাণে অধিষ্ঠিত হতে পারেন। আবার নিজ নিজ কর্মের উপর ভিত্তি করে মানুষ নিপতিত হতে পারেন অনন্ত দুঃখ সাগরে।
এ জীবজগতের প্রাণীগণ কর্মের কারণে উন্নত-অবনত, ধনী-গরীব, জ্ঞানী-অজ্ঞানী, সুস্থ-বিকলাঙ্গ, হ্রস্ব-দীর্ঘ, সুন্দর-অসুন্দর, প-িত-মূর্খ, দৈহিক-মানসিকভাবে, স্বল্পায়ূ-দীর্ঘায়ু তথা জন্ম মৃত্যুগত বৈষম্যের অধিকারী হন। এক কথায়-‘কম্মং সত্তে বিভজ্জন্তি-যদিদং হীনপ্্পনী তত্তা যাযতি।’ এ কর্মই সর্বজীবের পুর্নজন্মের হেতু, কম্মই বন্ধু ও কর্মই জীবজগতের একমাত্র আশ্রয়। এ কারণে বুদ্ধের দৃপ্ত কণ্ঠের উচ্চারণ হল- “কম্মস্সকোম্হি, কম্ম দাযাদো, কম্মযোনি, কম্ম বন্ধু, কম্ম পটিসরণো, যং কম্মং করিসসামিÑকল্যাণং বা, তস্স দাযাদো ভবিস্সামী’তি পব্বজিতেন অভিনহং পচ্চবেক্তিব্বং।”
কর্মই নর-নারীর সবকিছুর আকর, কর্মই তাদের একমাত্র উত্তরাধিকার, কর্মই তাদেরকে জন্ম পরিগ্রহ করায়। এ কর্মই হল নর-নারীর একমাত্র প্রতিশরণ। যে যেরকম কর্ম সম্পাদন করবে সে সেরকম ফল বা বিপাক ভোগ করবে। পাপ কর্ম সম্পাদন করলে পাপ-পঙ্কিলময় ফল আর পুণ্য কর্ম সম্পাদন করলে পুণ্য-প্রশান্তিময় ফল বা বিপাক ভোগ করবেÑতা অবধারিত ও স্বতঃসিদ্ধ। এ কর্মই স্বত্বগণের মধ্যে এ জগতে বিভাজন রেখা টেনে দেয়। মানব প্রজাতির মধ্যে বৈষম্যের একমাত্র কারণ হলো এ কর্ম। এখানে সৃষ্টিকর্তা বা ঈশ্বরের কোন হাত আছে বা রয়েছে বলে মনে হয় না।
বুদ্ধের ধর্ম দর্শন মতে মানুষ নিজের কর্ম নিজেই সম্পাদন করে, নিজের ভবিষ্যৎ নিজেই গড়ে তোলে, নিজের পরিচয় নিজেই বহন করার শক্তিমত্তা দেখায়। এখানে কেউ কারো উপর নির্ভরশীল হয়ে দুঃখ মুক্তির বা সংসারাবর্ত থেকে মুক্তির দিশা পাওয়ার কোনো উপায় বা অবকাশ নেই। এটিই মহামানব বুদ্ধের দিক নির্দেশনা পূর্ণ নির্দেশ বা বিধান।
গোটা জীবনব্যাপী কায়-বাক্য ও মনোদ্বারে আমরা যে কর্ম করে যাচ্ছি নিরন্তর নিরবচ্ছিন্নভাবে তা আবার সম্যক দৃষ্টি ও মিথ্যা দৃষ্টি নির্ভর। সম্যক দৃষ্টি নির্ভর জ্ঞান সম্প্রযুক্ত কর্ম আমাদেরকে সুফল সুখ-সদ্গতি প্রদান করে আর মিথ্যাদৃষ্টি নির্ভর জ্ঞান বিপ্রযুক্ত কর্ম আমাদেরকে অনন্ত দুঃখ সাগরে আষ্ঠে পৃষ্ঠে বেঁধে রাখে। তাই আর্যগণের আচরিত অষ্ট মার্গ অবলম্বন করে পথ তোমার নিজস্ব উদ্যোগেই চলতে হবে। এখানে তথাগতগণ পথ প্রদর্শক মাত্র।
কিন্তু বড়ই দুঃখ ভারাক্রান্ত অন্তঃকরণে বলতে বাধ্য হচ্ছি যে, কালের বিবর্তনে পার্বত্য চট্টগ্রামস্থ বৌদ্ধ ভিক্ষু সংঘের মধ্যে নীতিগত, আদর্শগত, আচরণগত মনোজাগতিক অনেক পরিবর্তন সাধিত হয়েছে- যা বুদ্ধের মৌলিক ধর্ম দর্শনের পরিপন্থী বললে অতিশয়োক্তি দোষদুষ্ট হবে না। যেমনÑবর্তমান ভিক্ষু সংঘ সদস্যদের কেউ কেউ নিছক আত্মস্বার্থ-চরিতার্থ করণের অভিপ্রায়ে সংঘভেদাত্মক কথা বলে ও কাজ করে সহজ-সরল পুণ্যাকাক্সক্ষী বৌদ্ধ জনগণকে বিভ্রান্ত করার প্রয়াস পাচ্ছেন। কোন কোন সংঘকে দুঃশীলতা দোষে অভিযুক্ত করে তাদের নিজেদেরকে সচ্চচিরত্রবান বা সুশীলতার তকমা লাগিয়ে সহজ সরল পুণ্য প্রত্যাশী দায়ক-দায়িকাগণের মাঝে বিভ্রান্তি পূর্ণ বৈষম্য সৃষ্টির অপতৎপরতায় লিপ্ত রয়েছেন কেউ কেউÑযা বুদ্ধ বিনয়ের সুস্পষ্ট লঙ্ঘন হিসেবে গণ্য করা যায়। মার্গস্থ ও ফলস্থ ভেদে কোন স্তর লাভ না করা স্বত্ত্বেও কেউ কেউ নিজেকে অনুবুদ্ধ, শ্রাবক বুদ্ধ, ষড়বিজ্ঞা-লাভী ও অষ্ট সমাপত্তি লাভী হিসেবে আকারে ইঙ্গিতে অভিধাদি তারা পরিচয় দিতে স্বাচ্ছন্দ্য বোধ করেন। ক্ষেত্র বিশেষ উচ্ছিষ্ট ভোজী চাটুকার টাইপের জনগণের দ্বারা প্রদত্ত ঐসব অভিধাসমূহ নিপুণভাবে শত সহ¯্র জনগণের মাঝে উচ্চারিত হলেও নিবৃত্তকরণের পরিবর্তে তা তাঁরা বিনা বাক্য ব্যয়ে মেনে নিয়ে তাদেরকে আত্মতুষ্টিতে গদগদ থাকতে দেখা যায়। অথচ কোন ভিক্ষু ঐরূপভাবে মিথ্যার আশ্রয় নিয়ে নিয়ে মিথ্যা আত্ম জাহিরের ঘৃণ্য তড়িকায় আত্মগত হলে প্রাতিমোক্ষের চতুর্থ পারাজিকা দোষে দোষ দুষ্ট হয় আর ভিক্ষু শাসন থেকে চিরতরে পরাজিত হয় বলে প্রজ্ঞাপ্ত রয়েছে। নবগুণ সম্পন্ন ভিক্ষুদের কেউ কেউ এখন নববিধ গুণের সাথে আত্মচর্চা, আত্মসমীক্ষা, আত্মশুদ্ধির পরিবর্তের পরচর্চা, পরছিদ্রান্বেষণ, পরসমীক্ষা বা পরের শুদ্ধি-অশুদ্ধি সমীক্ষা করণের বিষয়াদিকে মুখ্য আচরণীয় কর্ম হিসেবে বেছে নিয়েছে।
অতীব শ্রদ্ধাভাজন, বৌদ্ধ জগতের অনন্য সাধারণ ব্যক্তিত্বের অধিকারী, অনন্য সাধারণ অবদানে দীপ্তোজ্জ্বল সর্বজন পূজ্য প্রয়াত মহাথেরোগণের ব্যাপারে কোন কোন ভিক্ষু মৃত্যুর পর তাঁরা সকলেই নরকে গমন করেছেন বলে ফেসবুকে স্ট্যাটাস দিয়ে অনন্ত অনন্ত পুণ্যের অথবা নরকের তথা নরকাগ্নির অংশভাগী হওয়ার পরাকাষ্ঠা প্রদর্শন করার প্রয়াস পাচ্ছেন। যেমন বুদ্ধগয়ার আন্তর্জাতিক ভাবনা কেন্দ্রের প্রতিষ্ঠাতা ও প্রখ্যাত বিদর্শন সাধক সর্বজন শ্রদ্ধেয় ডা. রাষ্ট্রপাল মহাথেরো মহোদয় ও পার্বত্য চট্টগ্রামের পার্বত্য ভিক্ষু সংঘের প্রতিষ্ঠাতা প্রয়াত শ্রাবক বুদ্ধ সাধনা নন্দ মহাস্থবির মহোদয়ের ভিক্ষু সীমায় উপাধ্যায় গুরু সর্বজন শ্রদ্ধেয় প্রয়াত অগ্রবংশ মহাথেরো মহোদয় এবং চট্টগ্রামের নন্দন কানন বৌদ্ধ বিহারের প্রয়াত অধ্যক্ষ দীপংকর শ্রীজ্ঞান মহাথেরো মহোদয়-যিনি প্রয়াত সাধনা নন্দ মহাথেরো মহোদয়ের শ্রামণের জীবনের দীক্ষা গুরু ছিলেন- এ তিনজন মহাথেরো মৃতে্যুর পর নরকে গমন করেছেন বলে জনৈক বন ভিক্ষু কর্তৃক ফেসবুকে স্ট্যাটাস দিয়ে সম্মানিত করণের পরিবর্তে অসম্মানিত করেছেন। যাঁরা প্রয়াত হয়েছেন তাঁদেরকে নিয়ে এরূপ ঘৃণ্য, কুরুচিপূর্ণ অপতৎপরতা কেন? পার্বত্য চট্টগ্রামের শিক্ষিত বৌদ্ধ সমাজ এ ব্যাপারে এতই নির্লিপ্ত কেন? ঐসব বন ভিক্ষুগণ কোন যুক্তিতে এরূপভাবে প্রয়াত মহাথেরোগণের নরক গমনের অভিশাপ করে চলেছেন? তাদের এরূপ বিধান দেওয়ার যোগ্যতাই বা কী? তাদেরকে এ অধিকার কে দিল? কেনই বা বৌদ্ধ সমাজ এতো নির্লিপ্ত!
আমার পর্যবেক্ষণে চন্দ্র সূর্যের মতো প্রতীয়মান হয় যে, আমার পিতা-মাতা, শিক্ষা-গুরু, দীক্ষাগুরুগণ আমার কাছে পরম পূজ্য ও দেবতা তুল্য। তাঁরা প্রয়াত হওয়ার পর সকলেই নরকে গমন করেছেন বলে যদি কোন ভিক্ষু ফেসবুকের কল্যাণে স্ট্যাটাস দিয়ে বিশ্বব্যাপী তা বিঘোষিত করে দেয়তা কি কোন সত্যিকার রক্ত মাংস গড়া সন্তান-সন্তুটি বিনা বাক্য ব্যয়ে মেনে নিতে পারে?
দীর্ঘ দু’য়েক যুগ আগে আনন্দ বিহারের একটি পূর্ণিমা উপলক্ষে আয়োজিত ধর্ম দেশনায় বুদ্ধের উদ্দেশে নিবেদিত আমিষ পূজা নিরামিষ পূজা সম্পর্কে আমি উপস্থিত দায়ক দায়িকাদের কাছে অনুপুঙ্খ বিশ্লেষণের প্রয়াস পেয়েছিলাম। বক্তব্য সমাপনান্তে একজন বিশিষ্ট বড়–য়া দায়ক একান্তে আমার কাছে এসে অনুরোধ করলেন যে, ভান্তে এভাবে দায়ক দায়িকাদের কাছে আমিষ পূজা আর নিরামিষ পূজা সম্পর্কে বলবেন না। কারণ এমনিতেই দায়ক-দায়িকাগণ নিয়মনিষ্ঠ পূজা, প্রার্থনাসহ ধর্মানুশীলন বিমুখ তদুপরি এরূপভাবে যদি আমিষ পূজার বিপরীতের বুদ্ধের নিরামিষ পূজার কার্যকারিতা, গ্রহণযোগ্যতা উচ্চকিতভাবে উচ্চারিত হয় তাহলে দায়ক-দায়িকাগণ আরও মন্দির বিমুখ হবে। আমি এ বিশিষ্ট বড়–য়া দায়ক কর্তৃক নিবেদিত অনুরোধটি গভীরভাবে মূল্যায়ন করে এ প্রতীতি জন্মেছে যে আদিবাসী বৌদ্ধ সম্প্রদায় জন্ম সূত্রে বৌদ্ধ হলেও কর্ম সূত্রে বৌদ্ধ নয় বিধায় বড়–য়ার বাবুর এ সনির্বন্ধ সতর্ক বার্তা।
রাঙ্গামাটিস্থ আনন্দ বিহারে স্থায়ীভাবে অবস্থানের সুবাদে মৈত্রী বিহারের প্রথম প্রধান অধ্যক্ষ আমার পরম হিতাকাঙ্খী প্রয়াত ভদন্ত বিমল বংশ মহাস্থবির মহোদয়ের বদান্যতায় পার্বত্য ভিক্ষু সংঘের সাধারণ সম্পাদক পদে অধিষ্ঠিত থাকাকালীন অনেক অনেক বয়োজ্যেষ্ঠ ভিক্ষুু সংঘের সান্নিধ্যে আসার সৌভাগ্য আমার হয়েছিল। আজ থেকে দু’আড়াই যুগ আগের দু’চার জন বিশিষ্ট বয়োজ্যেষ্ঠ মহাথেরো দায়ক দায়িকাদের সাথে আমাকে ‘ভিক্ষু পাতিমোক্ষ’ ও ‘মহাবর্গ’ সম্পর্কে আলাপ আলোচনা না করতে পরামর্শ দিয়েছিলেন। এ দুটি বই দায়ক দায়িকাদের হাতের নাগালের বাহিরে রাখার জন্য নির্দেশ দিয়েছিলেন কারণ ভিক্ষুদের অতি আবশ্যকভাবে প্রতিপালনীয় নিয়ম নীতি সমূহ সম্পর্কে দায়ক দায়িকাদের জ্ঞান ভা-ার সমৃদ্ধ হলে ভিক্ষুরা যথা ইচ্ছা চলাফেরা করতে পারবেন না। বার্মাদেশে বর্তমান মিয়ানমারেও এ দুটি বই দায়ক দায়িকাদের নাগালের বাহিরে সযতনে রাখার বিধান এখনো অব্যাহত আছে বলে জানা যায়। এ বিষয়টিও তাঁরা আমাকে দৃষ্টি আকর্ষণ করেছিলেন।
পার্বত্য বৌদ্ধ সমাজের হৃদস্পনান্দন তথাকথিত শ্রাবক বুদ্ধ সাধানানন্দ মহাস্থবির মহোদয়ের (বন ভান্তে) পার্বত্য বৌদ্ধ সমাজের ভাগ্যকাশে উদীয়মান সূর্য হিসেবে আর্বিভূত হওয়ার (সময় কাল ১৯৭৩ খ্রি হতে ২০১২ খ্রি) ব্যাপ্তি কালের মধ্যে তাঁর শিষ্যবর্গের মধ্যে অনেকে ¯্রােতাপত্তি, সকৃতাগামী, অনাগামী ও অর্হতের পর্যায়ে পৌঁছাতে সক্ষম হয়েছিলেন বলে সাধারণ জন সাধারণ কর্তৃক বহুল কথিত ও বিপুলভাবে সম্বর্ধিত। তাঁরা ধুতাঙ্গধারী। কেউ কেউ পাত্র পিন্ডিক, কেউ কেউ আরণ্যিক, কেউ কেউ গুহাশ্রয়ী অথবা রুক্ষমূলিক। বুদ্ধ কথিত ১৩ (তেরটি) ধুতাঙ্গের তাঁরা একচেটিয়া কারবারী মহামতি মহৎ জন। পার্বত্য আদিবাসী বৌদ্ধ সমাজে তাঁরা সম্যক মার্গ লাভী হিসেবে বন্দিত, নন্দিত, পরিগৃহীত এবং সম্বর্ধিত। তাঁরা আহবান যোগ্য, শ্রদ্ধার্ঘ্য নিবেদনযোগ্য ও দান প্রদানের অনুত্তর পূণ্য ক্ষেত্র। তাঁরা ডাক বিভাগের সর্ব উচ্চ পদস্থ কর্মকর্তা পোস্টমাস্টার জেনারেলর মতো মৃত ব্যক্তিদের উদ্দেশে নিবেদিত দানীয় সামগ্রীর বদৌলতে প্রাপ্ত পূণ্য আনিসংস, সরাসরি মৃত ব্যক্তির সন্নিধানে উপস্থিত করে আত্যন্তিক সুখ সদ্্গতির প্রদানের শক্তিমত্তার অধিকারী বলে তাঁদেরকে বিঘোষিত করেন। তাঁরা জনসমক্ষে কথায়-বার্তায়, চলনে-বলনে, আচার-আচরনে চমৎকার কিন্তু ভেতরে ভেতরে বর্ণচোরা।
তাঁরা সংসারবর্তের সবকিছুকে ভয়ের চোখে অবলোকন করার তাগিদ নিয়ে ভিক্ষুত্বে দীক্ষিত হলেও তথাকথিত ¯্রােতাপত্তি, সকৃতাগামী ও অনাগামী ফল লাভী হিসেবে দায়ক দায়িকাদের শ্রদ্ধা প্রদত্ত দানীয় সামগ্রীর যথেচ্ছ পরিভোগ ও বিপুল দান দক্ষিণার বদান্যতার আঙ্গুল ফুলে কলা গাছ হয়ে ভিক্ষু জীবনের ২০ বা ২৪ বসন্ত অতিক্রমনের পর অনাগারিক থেকে আগারে ফিরে গিয়ে টুকটুকে সুন্দরী নারীর পাণী গ্রহণের পরম পরাকাষ্ঠা প্রদর্শন করেছে ও প্রয়াত ব্যক্তিবর্গের উদ্দেশে নিবেদিত পুণ্য পুত অর্থ-বিত্ত পরিপূর্ণভাবে নিজস্ব পারিবারিক শান্তি স্বস্তায়নে ব্যবহার করার প্রয়াস পায় অবলীলাক্রমে। পার্বত্য বৌদ্ধ সমাজ তা দেখেও না দেখার ভাণ করে রয়েছে। স্থান বিশেষে পক্ষপাতিত্বের বাতাবরণ পরিলক্ষিত হচ্ছে।
পরিশেষে পার্বত্য বৌদ্ধ সমাজের কাছে আমার সকাতর নিবেদন হলÑবুদ্ধের এই ধর্ম-দর্শন গণতন্ত্রকে বিশ্বাস করে ও সমানাধিকারকে বিশ্বাস করে। নারী-পুরুষের সমতাকে বিশ্বাস করে। ভিক্ষু সংঘ ও দায়ক দায়িকা সংঘ সমভাবে শাসন-সদ্ধর্ম জ্ঞানে ঋদ্ধ ও সমৃদ্ধ থেকে বুদ্ধের ধর্ম-দর্শনে অবদান রাখুক এবং ভিক্ষু সংঘ ও দায়ক-দায়িকা সংঘের ঐক্যবদ্ধ প্রচেষ্টায় বুদ্ধের শাসন-স্বদ্ধর্ম সুস্থিত থাকুক-এটি সর্বতোভাবে কামনা করা যেতে পারে। কারণ বুদ্ধের ধর্ম দর্শন শুধু মাত্র ভিক্ষুদের জন্য একচেটিয়া বা একচ্ছত্র আধিপত্য বাদের ধর্ম-দর্শন নয়। সবকিছু ভিক্ষু সংঘের মেজাজ মর্জির উপর নির্ভর করে ধর্মীয় আচার-অনুষ্ঠানের একচ্ছত্র আধিপত্যবাদিতার হাতিয়ার ভিক্ষুদের হাতে তুলে দেয়া কতটুকু যৌক্তিক ও সামাজকিভাবে কল্যাণকর তা সুবিবেচনার সময় এখন সমুপস্থিত। কারণ, সংঘ ক্ষেত্রে প্রতি অমাবস্যা ও পূর্ণিমায় যেভাবে বর্ণচোরা মার্গ-লাভী, ত্রিবিদ্যা লাভী, ষড়ভিজ্ঞা লাভী, অষ্টসমাপত্তি লাভী, অনুবুদ্ধ ও শ্রাবক বুদ্ধের আর্বিভাব ঘটছে ও অর্হৎ বর্গের আর্বিভাব ঘটছে তাতে এসব মার্গ লাভী বর্ণচোরা অর্হৎ বর্গের পদভারে গোটা পার্বত্য চট্টগ্রাম ভবিষ্যতে টলটলায়মান হতে বাধ্য। এখনো মাঝে মাঝে স্থান বিশেষে পার্বত্য ভিক্ষু সংঘ ও বন সংঘের ভিক্ষুদের মধ্যে দুঃশীল ও শীলবন্ত এ বিষয়টি নিয়ে বাদ-বিসংবাদ, উত্তপ্ত বাক্য বিনিময়, সংঘভেদাত্মক আবহ সৃষ্টির তড়িকা পরিলক্ষিত হয়Ñযা বুদ্ধের অহিংসার ধর্ম-দর্শনের সম্পূর্ণ বিপরীত বলে আমার দৃঢ় বিশ্বাস। অতএব, সাধু সাবধান।
লেখকঃ অধ্যক্ষ,আনন্দ বিহার, তবলছড়ি, রাঙ্গামাটি এবং অধ্যক্ষ, শাক্যমুনি বৌদ্ধ বিহার, মিরপুর-১৩, ঢাকা-১২১৬।
মেসেঞ্জার/এমএএন