ছবি: মেসেঞ্জার
বিএনপির ছাত্রবিষয়ক সম্পাদক ও আলোচিত হাওয়া ভবনের প্রভাবশালী কর্মকর্তা রকিবুল ইসলাম বকুলের কাছে জিম্মি হয়ে পড়েছে বিএনপিসহ বিভিন্ন অঙ্গ ও সহযোগী সংগঠনের নেতাকর্মীরা। বিএনপির ভ্যানগার্ড হিসাবে পরিচিত জাতীয়তাবাদী ছাত্রদলের একক নিয়ন্ত্রণ বকুলের। অর্থের বিনিময়ে কমিটি গঠন, সরকারের সাথে সখ্যতা, নেতাকর্মীদের ফোন না ধরা, প্রতিহিংসা পরায়নসহ অসংখ্য অভিযোগ উঠেছে সাবেক এই ছাত্রনেতার বিরুদ্ধে।
সম্প্রতি জাতীয়তাবাদী ছাত্রদলের ২৬০ সদস্যের আংশিক কমিটি গঠনের পর আরো বেপরোয়া হয়ে উঠেন বকুল। কেননা রাকিবুল ইসলাম রাকিব ও নাসির উদ্দিন নাসিরের নেতৃত্বাধীন ছাত্রদলের কেন্দ্রীয় কমিটি বকুলের পছন্দ মতো করা হয়। সেই কমিটির বিরুদ্ধে অনাস্থা প্রকাশ করায় পুলিশ-প্রশাসন দিয়ে ছাত্রদলের সাবেক দুই যুগ্ম সম্পাদককে গ্রেপ্তার করানো হয়। পদবঞ্চিত একাধিক নেতার বাসায় ডিবি গিয়ে তল্লাসী চালানো হয়েছে।
বিএনপির সংশ্লিষ্ট সূত্র জানায়, বিএনপিতে অত্যন্ত প্রভাবশালী বকুল সিন্ডিকেট। হাওয়া ভবনের সাবেক এই কর্মকর্তা বিএনপির ভারপ্রাপ্ত চেয়ারম্যান তারেক রহমানেরও ঘনিষ্টজন বলে পরিচিত। হাওয়া ভবনে থাকাকালীন পুলিশ-প্রশাসনের বিষয়টি দেখভাল করতেন বকুল। যে কারণে পুলিশ প্রশাসনের তার ব্যক্তিগত যোগাযোগও ভালো।
২০০৬ সালের ২৮ অক্টোবর বিএনপি ক্ষমতা ছেড়ে দিলে দৃশ্যপটের বাইরে চলে যান তিনি। এক এগারোর সরকারের আমলে নিজের অর্থ-সম্পদ রক্ষার্থে মালয়েশিয়াতে অবস্থান নেন। আলিশান জীবন-যাপন শুরু করেন। পরবর্তীতে আওয়ামী লীগ সরকার গঠন করলে আবার দেশে ফিরে আসেন তিনি। কোন প্রকার মামলা ছাড়াই প্রকাশ্যে রাজনীতি শুরু করেন।
তবে এক সময়ে বিএনপির ভারপ্রাপ্ত চেয়ারম্যানের সাথে তার দূরত্বও তৈরি হয়। কিন্তু কৌশুলি বকুল লন্ডনে তারেক রহমানের আশাপাশে তার লোক নিয়োজিত করে স্বরুপে ফেরেন। ২০১৮ সালের ৩০ ডিসেম্বর নির্বাচনে বিএনপির মহাসচিবের আপত্তি সত্ত্বেও খুলনা থেকে তাকে মনোনয়ন দেয়া হয়। খুলনার রাজনীতিতে প্রবেশ করে নোংরামী শুরু করেন।
খুলনা বিএনপি মহানগরের সভাপতি ও কেন্দ্রীয় সাংগঠনিক সম্পাদক নজরুল ইসলাম মঞ্জুকে দল থেকে অব্যাহতির নেপথ্যে ভূমিকা রাখেন তিনি। খুলনা বিএনপির দুর্গ ভেঙ্গে চুরমার করে দেন। এরপর খুলনা মহানগর বিএনপির ১নং সদস্য পদ গ্রহণের মাধ্যমে বিএনপিতে প্রকাশ্যে রাজনীতিতে আসেন বকুল। পরবর্তীতে বিএনপির ছাত্রবিষয়ক সম্পাদক হন ছাত্রদলের সাবেক এই সহ-সভাপতি।
পুলিশ প্রশাসনে স্ত্রীকে ঢাল হিসাবে ব্যবহার:
জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয়ের সাবেক ছাত্রী শিল্পিকে এক প্রকার ভাগিয়ে বিয়ে করেন বকুল। নিজের হাতে চাকুরি দেয়া শিল্পীর সাজানো সংসার ভেঙ্গে নিজের স্ত্রী করে নেন বকুল।
২৪তম ব্যাচের পুলিশ কর্মকর্তা শিল্পি বর্তমানে উচ্চ শিক্ষার্থে অষ্ট্রেলিয়াতে আছেন। চলতি মাসেই দেশে ফিরবেন। এই স্ত্রী শিল্পীকে পুলিশ প্রশাসনে ঢাল হিসাবে ব্যবহার করেন বকুল। তার স্ত্রীর প্রশাসনে ভালো অবস্থান রয়েছে। ২০১৭ সালে প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার সফরসঙ্গী হিসাবে জাতিসঙ্গ সফরে যান।
গ্রেপ্তার না হওয়ার অজানা রহস্য: বকুলের পৈত্রিক নিবাস কুষ্টিয়ার ভেড়ামারায়। দুই ভাই ও দুই বোনের মধ্যে সবার বড় বকুল। আওয়ামী লীগের যুগ্ম সাধারণ সম্পাদক মাহবুবুল আলম হানিফের সম্পর্কে বোন হোন বকুলের মা। সেই সূত্রে হানিফ-বকুল সম্পর্কে মামা ভাগিনা। হানিফের সাথে বকুলের ব্যবসা বাণিজ্যও আছে। তাদের গভীর সম্পর্কের কারণে আজ পর্যন্ত কখনোই গ্রেপ্তার হননি এই বকুল। কিছুদিন আগে বকুলের বাবা মারা গেলে ভেড়ামারাতেই দাফন সম্পন্ন করা হয়।
খুলনাতে আধিপত্যে : বাবার চাকুরি সূত্রে খুলনাতে বসবাস করেন বকুল পরিবার। সেই থেকেই খুলনার রাজনীতিতে আধিপত্যে শুরু। ভেড়ামারা মামা হানিফের বিরুদ্ধে নির্বাচন না করার সিদ্ধান্ত আছে তাদের। এই কারণেই খুলনায় প্রতিষ্ঠিত হওয়ার কার্যক্রম শুরু করেন তিনি। বর্তমানে খুলনাতেই আলিশান বাড়ি হাঁকাচ্ছেন আলোচিত বকুল।
ছাত্রদলের সাবেক নেতারা জানান, ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের ফজলুল হক হলের সাবেক জিএস ছিলেন বকুল। পরবর্তীতে ছাত্রদলের কেন্দ্রীয় সহ-সভাপতি হন তিনি। এরপর হাওয়া ভবনে কর্মকর্তা হওয়ার পর তারই বন্ধু আজিজুল বারী হেলালকে ছাত্রদলের সাধারণ সম্পাদক ও সভাপতি করেন তিনি। পরবর্তীতে ছাত্রদল, যুবদল, স্বেচ্ছাসেবক দলে নিজের অনুসারীদের পদ দিয়ে অন্দর মহলে আলোচনায় থাকতেন তিনি।
এবার বকুলের টার্গেট রিজভীর স্থলাভিষিক্ত হওয়া: রকিবুল ইসলাম বকুলের পরবর্তী টার্গেট হলো বিএনপির যুগ্ম মহাসচিব (দফতর)। বর্তমান বিএনপির সিনিয়র যুগ্ম মহাসচিব রুহুল কবীর রিজভী আহমেদকে কৌশলে বিএনপির স্থায়ী কমিটির সদস্য বানিয়ে তিনি নিজে দফতরের দায়িত্ব নিতে চান। বিএনপির দফতরের একক নিয়ন্ত্রণ প্রতিষ্ঠায় তিনি মরিয়া হয়ে উঠেছেন।
নেতাদের বিরুদ্ধে পুলিশ-প্রশাসন ব্যবহার:
বিএনপির একাধিক নেতা জানান, বকুল সবচেয়ে প্রতিহিংসা পরায়ন। তার বিরুদ্ধে দলের ভেতরে কেউ অবস্থান নিলে পুলিশ-প্রশাসনকে ব্যবহার করেন তিনি। তার প্রয়োজনে নেতা বা কর্মীদের সাথে যোগাযোগ রাখেন। প্রয়োজন ফুরিয়ে গেলে ছুড়ে ফেলেন। এই ধরণের নেতা দলের জন্য ভয়ংকর। ছাত্রদলের আংশিক কমিটির পর সম্প্রতি আটক ছাত্রদলের সাবেক যুগ্ম সম্পাদক মারজুক আহমেদ বকুলের বিরুদ্ধে ফেসবুকে স্ট্যাটাস দিয়েছিলেন। তার পরিণতি শুধু গ্রেপ্তারে শেষ নয়, ১৬৪ জবানবন্দি দেওয়ানো হয়। তার উপর প্রচন্ড নির্যাতনও চালানো হয়।
বকুল পরিকল্পনা বাস্তবায়ন করে নয়ন: বকুলের লাঠিয়াল হিসাবে পরিচিত রবিউল ইসলাম নয়ন। পুলিশ মার্ডার থেকে শুরু করে অসংখ্য মামলার আসামী নয়ন প্রকাশ্যে ঘুরে বেড়ালেও তাকে গ্রেপ্তার করা হয় না। বকুলের সহায়তায় প্রশাসনের সাথে নয়নের যোগাযোগ করানো হয়। বিএনপির কোন নেতা বা কর্মীকে সাইজ করতে নয়নকে ব্যবহার করেন বকুল। সম্প্রতি পদবঞ্চিত কয়েকজনকে পিটিয়েছে নয়নের ক্যাডার বাহিনী। নয়নও বকুলের ছত্রছায়া আরো বেপরোয়া হয়ে উঠে।
নাসিরের পর এবার মুন্নাকে যুবদল সভাপতি বানাতে লন্ডন যাত্রা: ছাত্রদলের বর্তমান সাধারণ সম্পাদক নাসিরকে নয়নের পছন্দ মতো নেতা বানাতে বাধ্য হন বকুল। একইভাবে যুবদলের সদ্য সাবেক সাধারণ সম্পাদক মোনায়েম মুন্নাকে সভাপতি বানানোর জন্য নয়ন বকুলকে প্রচন্ড চাপ দিচ্ছেন। যুবদলের কমিটি অনুকূলে রাখবার জন্য দ্রুত লন্ডনে পাড়ি দেয়ার পরিরিকল্পনাও করেছেন বকুল।
সানির উপর একক নিয়ন্ত্রণ বকুলের:
তারেক রহমানের পিএস সানির সব কিছুই দেখাশোনা করেন বকুল। সানি এক অর্থে বকুলের কথার বাইরে যান না। ২০১৮ সালের নির্বাচনের আগে সানির বোন এবং জামাই স্বয়ং প্রধানমন্ত্রীর সাথে সাক্ষাত করেন। সেটির ব্যবস্থা করেছিলেন বকুল নিজে।
ব্রাক্ষণবাড়িয়া ছাত্রদলের কমিটি গঠন নিয়ে তীব্র অসন্তোষে বেকায়দায় পড়ে যান সানি। পরবর্তীতে বকুলের নির্দেশে সানির কথামতো ব্রাক্ষণবাড়িয়া জেলা ছাত্রদলের সভাপতিকে পল্টনে ডেকে এনে বেধড়ক পিটুনি দেন যুবদল নেতা নয়ন ও ছাত্রদল নেতা নাছির। পরে সেই মারার দৃ্শ্যের ভিডিও নাছিরের মোবাইল থেকে সানিকে পাঠানো।
বিএনপির নেতাকর্মীরা জানান, বকুল বিভিন্ন কমিটি বাণিজ্য করে অঢেল সম্পদের মালিক হয়েছেন। ২০২৩ সালের ২৮ অক্টোবরের পরের আন্দোলন সংগ্রামের সব অর্থ এককভাবে খরচ করেছেন বকুল। দলের প্রচুর অর্থ নিজে আত্মসার্থ করেছেন বলে জানিয়েছেন ত্যাগী এবং পরিশ্রমীরা।
তারা আরো জানান, জরুরি প্রয়োজনে টেলিফোনে বিএনপির ভারপ্রাপ্ত চেয়ারম্যানকে পাওয়া গেলেও বকুলকে কখনো পাওয়া যায় না। নির্দিষ্ট সংখ্যক ব্যক্তির বাইরে তিনি কারোর সাথে কথা বলেন না। সরকারের এজেন্ট বকুলকে অবিলম্বে দল থেকে অব্যাহতি দেয়ার দাবি জানিয়েছেন ভুক্তভোগীরা। এ বিষয়ে বকুলের বক্তব্য জানার জন্য একাধিকবার তার মোবাইলে যোগাযোগ করা হলে তাকে পাওয়া যায়নি।
মেসেঞ্জার/তারেক